ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কক্সবাজার বেতার

মৃত, প্রবাসী ও কারাগারে বন্দীর নামে ভুয়া বিল

প্রকাশিত: ০৯:২৫, ১ জুলাই ২০১৭

মৃত, প্রবাসী ও কারাগারে বন্দীর নামে ভুয়া বিল

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ কক্সবাজার বেতারে প্রবাসী, জেলহাজতে বন্দী এবং মৃতের নামেও ভুয়া বিল জমা করা হয়েছে। আঞ্চলিক পরিচালক হাবিবুর রহমানের সিল ও স্বাক্ষরযুক্ত ১২টি ভাউচারে এসব বিল অনুমোদনের জন্য জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে পাঠানো হলে সন্দেহ জাগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের কোষাগার থেকে বিপুল টাকা বেহাত হচ্ছে বুঝতে পেরে জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সুকোমল বড়ুয়া ভুয়া বিল ফেরত পাঠিয়েছেন। সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ২১ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান রামুর প্রতিভাবান শিল্পী ও সাংবাদিক আবীর বড়ুয়া। কিন্তু চলতি বছরের মে ও জুন মাসে দুই দফা মৃত আবীর বড়ুয়া ও তার সঙ্গীরা কক্সবাজার বেতারের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন বলে ৯ হাজার টাকাসহ দশ হাজার টাকার সম্মানী অনুমোদনের জন্য বিল জমা করা হয়েছে। একই ভাবে গোষ্ঠীভিত্তিক অনুষ্ঠানে আরও অংশ নিয়েছেন বলে ভুয়া বিলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রয়াত শিল্পী ক্যাছেন (ক্যাছেন রাখাইন), প্রয়াত নাট্যশিল্পী তাহানুল কবির রানা, প্রয়াত শিল্পী ওকেছেন রাখাইন ও ইমং চৌধুরী। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এ তালিকা থেকে বাদ যায়নি কয়েক বছর আগে থেকে লন্ডনে বসবাসরত বেতারের সাবেক অনুষ্ঠান ঘোষক নাজমুল আহাম্মদ মুন্না এবং প্রায় এক বছর আগে থেকে কারাগারে অন্তরীণ বেতারের শিল্পী সেলিমের নামও। শুধু তাই নয়; মৃত, জীবিত এবং প্রবাসী শিল্পীদের দস্তখত নকল করে নামে-বেনামে ভুয়া কন্ট্রাক্ট দেখিয়ে শুধুমাত্র মে-জুন মাসেই ১৯ লাখ টাকার বিল করেছেন কক্সবাজার বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক হাবিবুর রহমান। তালিকায় দেখা গেছে, চলতি বছরের জুন মাসে পাঁচটি পৃথক বিলে ২৯০ শিল্পীর নামে ৯ লাখ ৫৯ হাজার ২৫ টাকা এবং মে মাসে সাতটি বিলে ৪২২ শিল্পীর নামে ৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৭৫ টাকাসহ মোট ১৯ লাখ ৫৫ হাজার ৬শ’ টাকা বিল করেছেন তিনি। এরমধ্যে এ দুই মাসে ১০৭টি গোষ্ঠীভিত্তিক অনুষ্ঠান দেখানো হয়েছে। গোষ্ঠীভিত্তিক এসব অনুষ্ঠানের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ও সর্বনিম্ন তিন হাজার ২শ’ টাকা বিল করা হয়। সে হিসাবে দুই মাসের বিলের সিংহভাগই গোষ্ঠীভিত্তিক অনুষ্ঠানের বিল। শিল্পীদের অভিযোগ, মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি অনুষ্ঠান ছাড়া কোন অনুষ্ঠানই এ দুই মাসে রেকর্ডিং হয়নি। সেখানে ১০৭টি দলগত পরিবেশনা। বিষয়টি অবাস্তব এবং বিস্ময়করও বটে। জানা যায়, মে মাসের ১৩৭ নম্বর বিলের ৬০ জনের তালিকার ৫২ নম্বর ক্রমিকে আছেন প্রয়াত মেধাবী নাট্যকর্মী তাহানুল কবির রানা। যদিও তার শুদ্ধ নাম ছিল তাহানুল বশির রানা। ২০১১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান থিয়েটারের রানা। একই মাসের ১৩১ নম্বর বিলের ৭ নম্বর ক্রমিকে বেতারের শিল্পী সেলিম প্রায় এক বছর আগে থেকে একটি মামলায় কারাগারে আছেন। এ তালিকায় ১৯ নম্বরে শিল্পী মৃত ওকেছেন। ১৩৩ নম্বর বিলের ৯ এবং ৫৪ নম্বরে কক্সবাজার বেতারের সাবেক অনুষ্ঠান ঘোষক নাজমুল আহাম্মদ মুন্না চার বছর ধরে আছেন লন্ডনে। এ তালিকার ১৪ নম্বরে ইমং চৌধুরী এবং ৫৮ নম্বর ক্রমিকে প্রয়াত শিল্পী সাংবাদিক আবীর বড়ুয়ার নাম। ২০১৫ সালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের রাখাইনদের বর্ষা উৎসব চলাকালে সাগরে ইমংয়ের সলিলসমাধি হয়। জুনের ১৫০ নম্বর বিলে ৬০ নম্বর ক্রমিকে আছেন কক্সবাজারের সাবেক জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অমিতোষ সেন। অথচ প্রায় ছয় মাস আগে এ কর্মকর্তা অন্যত্র বদলি হন। কক্সবাজার জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সুকোমল বড়ুয়া জনকণ্ঠকে জানান, বিলগুলোর বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বেতার কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক হাবিবুর রহমানের কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে। শিল্পী শহিদুল ইসলাম বলেন, অনুষ্ঠান ঘোষণার জন্য বেতারে নিয়মিত যাই কিন্তু গত ছয় মাসে কোন গোষ্ঠীভিত্তিক তো দূরের কথা, কোন একক অনুষ্ঠানও করেছি বলে আমার মনে পড়ছে না। আমার নামে এটা ভুয়া বিল। বেতারের নাট্য প্রযোজক স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, কক্সবাজারে সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে হাতোগোনা ১০ থেকে ১৫টি। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে বেতারে দুই মাসে ১০৭টি গোষ্ঠীভিত্তিক ভুয়া অনুষ্ঠান দেখানো হয়েছে। তদন্ত করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে দাবি করে তিনি আরও বলেন, যাদের নামে এ অনুষ্ঠান দেখানো হয়েছে সেসব নামের অস্তিত্বই কক্সবাজারে নেই। এটি বড় ধরনের জালিয়াতি। কক্সবাজার বেতারের কয়েক শিল্পী জানান, দেড় বছর আগে আঞ্চলিক পরিচালক হাবিবুর রহমান যোগদানের পর থেকে বিশেষ দিবসের কয়েকটি অনুষ্ঠান ছাড়া সব রেকডিং এক প্রকার বন্ধ করে দেন। শুধুমাত্র হাতেগোনা কয়েক শিল্পীকে দিয়ে কয়েকটি অনুষ্ঠান ছাড়া বেশিরভাগ অনুষ্ঠানই পুনঃপ্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু রেকর্ডিং বন্ধ থাকলেও প্রতি মাসে নামে-বেনামে লাখ লাখ টাকার ভুয়া বিল দেখিয়ে শিল্পীদের সম্মানী খাতের এসব টাকা আত্মসাত করা হচ্ছে।
×