ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মেজর অশোক তারা সেদিন যেভাবে উদ্ধার করেন বন্দী বঙ্গবন্ধু পরিবারকে

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১০ এপ্রিল ২০১৭

মেজর অশোক তারা সেদিন যেভাবে উদ্ধার করেন  বন্দী বঙ্গবন্ধু পরিবারকে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পেছনে সবুজের বুকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় আলোকচিত্র। একই মঞ্চে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সস্ত্রীক মেজর অশোক তারা। ভারতীয় এই বীরই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ১৯৭১ এর ১৭ ডিসেম্বর। যখন সবেমাত্রই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু মুক্ত হয়নি বঙ্গবন্ধুর পরিবার। ধানম-ির সুরক্ষিত বাড়িটিতে ডজনখানেক পাকিস্তানী সৈন্য তখনও অস্ত্র উঁচিয়ে পাহারা দিচ্ছে। বিধ্বস্ত বাংলাদেশে তখনও চারপাশে ভয় আর শঙ্কা কাটেনি। ১৭ ডিসেম্বর মেজর অশোক তারাই মুক্ত করে এনেছিলেন দেশের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারকে। এমন বন্ধুর বীরত্বগাথাই মেজর অশোককে পাশে পেয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলছিলেন হাসিনা। শনিবার দিল্লীতে বাংলাদেশের বন্ধু বীরদের সম্মাননা জানানোর অনুষ্ঠানের পর ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়াকে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘শেখ হাসিনাজি আমাকে এবং আমার স্ত্রী আভাকে দেখে খুব খুশি হয়েছেন। তিনি মোদিজিকে বলেছেন, আমি তাকে এবং তার পরিবারকে নিরস্ত্র অবস্থায় একা উদ্ধার করেছি।’ টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো মেজর অশোক তারার বর্ণনায় তুলে ধরেছেন বিপদ সঙ্কুল ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর কথা। সাহসী এই বীর ১৯৬৩ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ফরটিন গার্ডস বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। দীর্ঘ সময় ভারতীয় সেনা বাহিনীতে কাজ করার পর ১৯৯৪ সালে তিনি কর্নেল পদমর্যাদা নিয়ে অবসর গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের জুনে তাকে ‘ফ্রেন্ড অব বাংলাদেশ’ পদকে ভূষিত করেন। সত্যিই তিনি বাংলাদেশের হৃদয়ের বন্ধু। অশোক বলছেন ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, ওই সময় ঢাকায় বইছিল শীতল হাওয়া। বাংলাদেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। তার একদিন আগেই পাকবাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু তখনও পাকবাহিনীর কাছে বন্দী বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার। ভারত সরকারের বার্তা এল উদ্ধার করতে হবে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে। বার্তা পেয়েই অশোক তিন সহযোগীসহ সেনা গাড়িতে করে ধানম-ি যাচ্ছিলেন। পথে পথে তখনও যুদ্ধের ক্ষত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ধ্বংস লীলা তাকিয়ে রয়েছে সবখানেই। মানুষের মধ্যে ঘোর আতঙ্ক বিরাজ করছে। অশোক বলছেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে ধানম-ির যে বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে, তার একটু আগেই একটা জটলা দেখে তারা থামলেন। সামনে একটি পোড়া গাড়ি। ভেতরে চালকের আসনে একজন মরে পড়ে আছে। গুটিকয়েক লোক ভিড় করে দেখছিলেন। তারা ভারতীয় সৈন্য বলতেই মানুষগুলো তাদের জানায় এখানকার অবস্থা ভাল নয়। সামনে এগুলে বিপদ হতে পারে। কিন্তু ফিরে যেতে তো তারা আর আসেননি। সামনে এগুনোর কোন বিকল্প ছিল না। বাড়িটি ঘিরে ছিল এক ডজন পাকিস্তানী সৈন্য। অত্যন্ত সুরক্ষিত বাড়িটির দিকে তারা সকলে রাইফেল তাক করে ছিল। পরিস্থিতি ভয়াবহ যাতে না হয় সেজন্য নিজের সঙ্গিদের কাছে অস্ত্র রেখে অশোক তারা নিরস্ত্র অবস্থায় সামনে পা বাড়ালেন। কয়েক পা আগাতেই বাধ সাধলো পাকিস্তানী সেনারা। সকর্ত করা হলো তাকে আর কাছে আসলেই গুলি করা হবে। যে কোন পরিস্থিতিতে নির্দেশ পাওয়া মাত্র বঙ্গবন্ধু পরিবারকে হত্যা করার আদেশ তো ছিলই ওই পাকিস্তানী সৈন্যদের কাছে। রাইফেল যখন অশোক তারার দিকে তখনও থামলেন না তিনি। হিন্দী আর পাঞ্জাবিতে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যুদ্ধ শেষ হয়েছে, বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানী সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেছে। এমনিতেই পাকিস্তানী এই সেনা দলটি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। অনেকটা উদভ্রান্ত। কিংকর্তব্য বিমুড় মনে হচ্ছিল তাদের। মেজর অশোক তাদের বললেন, তোমরা অস্ত্র নামিয়ে ফেলে আত্মসমর্পণ করলে তাদের পাকিস্তানে ফিরে যেতে দেয়া হবে। তারা পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে যেতে পারবেন। আর যেহেতু যুদ্ধ শেষ তাই অন্য কোন পদক্ষেপ নেয়া তাদের জন্য শুভ হবে না। কিন্তু পাকিস্তানী এই ছোট সেনা দলটির কাছে তাদের পরাজিত হওয়ার খবর ছিল না বলে মনে করেন তিনি। অশোক তারা তখন তাদের বলেন, ‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ১৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ গতকাল আত্মসমর্পণ করেছে, ঢাকায় তাদের ক্ষমতার পতন হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানী সৈন্যরা তা বিশ্বাস করতে চাইছিল না। অশোক তারা বলেন, ‘আমি তাদের বললাম, যদি এটা সত্যি না হতো, তবে একজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা নিশ্চয়ই তাদের সামনে অস্ত্র ছাড়া এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না।’ নিজের কথার প্রমাণ হিসেবে মাথার ওপর উড়তে থাকা কয়েকটি ভারতীয় হেলিকপ্টারও দেখিয়ে দিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানী সেনা দলটি পরিস্থিতি দেখে মানতে বাধ্য হয়, তারা হেরে গেছেন। তখন বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে তারার সঙ্গে বেরিয়ে আসতে দেয় তারা। সেই সময় কথা উল্লেখ করে অশোক বলছেন তখন তিনি ২৯ বছরে পা দিয়েছেন। সাহসী অফিসার হিসেবে তার সুনাম ছিল বটে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে উদ্ধার করার এই মিশনটি সকলের কাছ থেকে আড়াল করা হয়েছিল। চৌকস অশোক তারাকে নির্দেশ দেয়া হয় সকলকে আড়াল করে কোন রকম রক্তপাত ছাড়াই মিশন শেষ করতে হবে। পাছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের কারো ক্ষতি হবে বিবেচনা করেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তার কাছে নির্দেশ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী এবং পরিবারকে উদ্ধার করতে হবে, যাদের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ২৪ বছর বয়সী কন্যা শেখ হাসিনা এবং তার সন্তানরাও। অশোক তারার উদ্ধার করা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল ভারতীয় সেনারা। সেই যুদ্ধে ৩ হাজার ৮৪৩ জন ভারতীয় বীর বাংলাদেশের জন্য জীবন উৎস্বর্গ করে। তবে ১৭ ডিসেম্বরের মধ্য দিয়ে অশোক তারার মতো কয়েকজন বীর যোদ্ধার সঙ্গে আজীবনের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু পরিবারের। মোদির সঙ্গে মহান ৭১ এ নিজের উদ্ধার হওয়ার এই ঘটনা বর্ণনাই প্রমাণ করে শেখ হাসিনা কখনও সেই সম্পর্ককে শ্রদ্ধা জানাতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুল করেন না।
×