ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

১৪ পদের ৮টিতে নীল প্যানেল জয়ী

সুপ্রীমকোর্ট বারে সরকার সমর্থক প্যানেলের পরাজয়ের নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৫ মার্চ ২০১৭

সুপ্রীমকোর্ট বারে সরকার সমর্থক প্যানেলের পরাজয়ের নেপথ্যে

আরাফাত মুন্না ॥ ঢাকা আইনজীবী সমিতির (ঢাকা বার) পর এবার সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতিতেও (সুপ্রীমকোর্ট বার) কর্তৃত্ব হারাল সরকার সমর্থকরা। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা জয়নুল আবেদীন সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। আর বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন টানা পঞ্চমবারের মতো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে সরকার সমর্থক আইনজীবীদের পাঁচটি সংগঠনের মোর্চা সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদে চরম সমন্বয় হীনতা দেখাছে। সমন্বয় হীনতাই সমন্বয় পরিষদের পরাজয়ের প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বিচার বিভাগকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির এমন মন্তব্য সরকার সমর্থক প্রার্থীদের পরাজয়ের পেছনে কাজ করেছে বলে তারা মনে করেন। শুক্রবার সকালে ঘোষিত ফলাফলে সভাপতি ও সম্পাদকসহ সমিতির ১৪টি পদের আটটিতেই বিএনপি-জামায়াত সমর্থক জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল বা নীল প্যানেলের প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। আর আওয়ামী লীগ সমর্থক সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ বা সাদা প্যানেল পেয়েছে একটি সহসভাপতি, একটি সহসম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষসহ মোট ছয়টি পদ। আগামী এক বছর এই নতুন কার্যনির্বাহী কমিটিই দেশের শীর্ষ আদালতের আইনজীবী সমিতির নেতৃত্ব দেবে। বুধ ও বৃহস্পতিবার সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০১৭-১৮ মেয়াদের নির্বাচনে ভোটগ্রহণের পর নির্বাচন পরিচালনা উপ-কমিটির আহ্বায়ক এ ওয়াই মশিউজ্জামান এই ফলাফল ঘোষণা করেন। সমন্বয় পরিষদের নির্বাচনী কর্মকা-ে যুক্ত ছিলেন এমন একাধিক নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, সমন্বয় পরিষদের অঙ্গ সংগঠনগুলোর মধ্যে এবার চরম অসমন্বয় ছিল। আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ও বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের বাইরে অন্য তিনটি সংগঠন এই জোটে থাকলেও নির্বাচনে তাদের কোন প্রার্থী দেয়া হয়নি। ফলে তাদের প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। তারা বলেন, গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির একাংশ আবু ইয়াহিয়া দুলালকে সহসভাপতি পদে মনোয়ান দেয়ার দাবি জানায়। পরে মনোনয়ন না পেয়ে দুলাল সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ১০১ ভোট পান। এছাড়া সমন্বয় পরিষদের আরেকটি সংগঠন জাতীয় আইনজীবী ফেডারেশন থেকে অশোক কুমার ঘোষকে মনোনয়ন দাবি জানানো হয়। তিনিও মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ৪০ ভোট পান। এখানে আওয়ামী লীগের সম্পাদক প্রার্থী রবিউল আলম বুদু মাত্র ৭০ ভোট কম পেয়ে হেরে যান। আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ও বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের বাইরে অন্য তিন সংগঠনকে নির্বাচনেও সক্রিয় দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, এবার নির্বাচনে ঢাকার বাইরের ভোটারদের আনার জন্যও কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের সাবেক উপমন্ত্রী ভিরেন্দ্র দেব নাথ সম্ভুর মতো অনেকেই এবার ভোট দিতে ঢাকায় আসেনি। এবার আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রার্থী আবদুল মতিন খসরু হেরেছেন মাত্র ৩৩ ভোট কম পেয়ে। এছাড়া চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি ও উত্তরবঙ্গ আইনজীবী সমিতির ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়ার পর দুই প্রার্থীকে একত্রিত হয়ে ভোট চাইতেও দেখা যায়নি। যা সমন্বয় হীনতার প্রমাণ রাখে বলে জানান নির্বাচন কার্যক্রম যুক্তরা। প্রধান বিচারপতি নানা বক্তব্য নির্বাচনে প্রভাব ফেলে উল্লেখ করে নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১৪ মার্চ অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ-সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশে রাষ্ট্রপক্ষের বারবার সময় নেয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের কাছে ব্যক্তি কিছু নয়, প্রতিষ্ঠানই বড়। বিচার বিভাগকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যকে পুঁজি করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্ররোচনা যোগাতে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া বিভিন্ন আইনজীবী সমিতি সফরে গিয়ে প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের বিরুদ্ধে ঢালাও ভাবে যে বিরূপ মন্তব্য করেছেন, এসবের প্রভাবও নির্বাচনে পড়েছে। গত বছর সভাপতিসহ আটটি পদে জয়ী হয়ে সরকার সমর্থক সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ দীর্ঘদিন পর সুপ্রীমকোর্ট বারের নেতৃত্ব পেয়েছিল। তার আগে টানা পাঁচ বছর এ সংগঠনের কর্তৃত্ব ছিল বিএনপি-জামায়াতপন্থী জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের হাতে। নির্বাচনের ফলাফল ॥ নতুন সভাপতি জয়নুল আবেদীন জয় পেয়েছেন মাত্র ৩৩ ভোটের ব্যবধানে। তার পাওয়া ১ হাজার ৯২৮ ভোটের বিপরীতে সাবেক আইনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক আবদুল মতিন খসরু পেয়েছেন ১ হাজার ৮৯৫ ভোট। সম্পাদক পদে বিজয়ী মাহবুব উদ্দিন খোকন তার প্রতিদ্বন্দ্বী বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ সুপ্রীমকোর্ট শাখার সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম বুদুর চেয়ে ৭০ ভোট বেশি পেয়েছেন। খোকনের ১ হাজার ৯১৬ ভোটের বিপরীকে বুদু পেয়েছেন ১ হাজার ৮৪৬ ভোট। আওয়ামী লীগ সমর্থক প্যানেল থেকে মোঃ অজিউল্লাহ সহ-সভাপতি, রফিকুল ইসলাম হিরু কোষাধ্যক্ষ এবং মোঃ শফিকুল ইসলাম সহ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া এ বি এম নূরে আলম উজ্জ্বল, কুমার দেবুল দে ও মোঃ হাবিবুর রহমান হাবিব জয় পেয়েছেন সদস্য পদে। অন্যদিকে, বিএনপি-জামায়াত সমর্থক প্যানেল থেকে উম্মে কুলসুম বেগম রেখা সহ-সভাপতি এবং শামীমা সুলতানা দিপ্তী সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। এ প্যানেল থেকে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন আয়েশা আক্তার, মৌসুমি আক্তার, মুহাম্মদ হাসিবুর রহমান ও শেখ তাহসিন আলী। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার দুই দিনে উৎসবমুখর পরিবেশে মোট ৫ হাজার ৮১ ভোটারের মধ্যে ৩ হাজার ৯২৮ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। বৃহস্পতিবার রাত ১১টা থেকে ভোট গণনা শুরু হয় চলে শেষ রাত পর্যন্ত। পরে সকালে ফলাফল ঘোষণা করা হয় সকাল সাড়ে সাতটায়। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাতটি সম্পাদকীয় ও সাতটি নির্বাহী সদস্য পদে এবারের এই নির্বাচনে এবার মোট ৩১ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
×