ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

নির্মূল কমিটির ১৩ দফা কর্মসূচী ঘোষণা

প্রকাশিত: ০২:১২, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

নির্মূল কমিটির ১৩ দফা কর্মসূচী ঘোষণা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পাঠ্যসূচীতে জামায়াত-হেফাজতি ভাবধারার মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সংযুক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ বলেছেন, উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাকে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করার আন্দোলনে সবাইকে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এ আহ্বান জানান সংগঠনের নেতারা। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার শিকার ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ও পরিবেশ দূষণ রোধে ৮ম জাতীয় সম্মেলনের আগে ৩০লাখ বৃক্ষরোপন কর্মসূচীরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের ২৫মার্চ ৪৬ তম জাতীয় গণহত্যা দিবস থেকে এই কর্মসূচী শুরুর কথা জানান সংগঠনের নেতারা। গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতির স্বীকৃতি আদায়ে সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক উদ্যোগ বাড়ানোর দাবিও জানানো হয়েছে সংবাদ সম্মেলন থেকে। সপ্তম জাতীয় সম্মেলনের গৃহীত প্রস্তাব ও কর্মসূচীর আলোকে নির্মূল কমিটির পরবর্তী কার্যক্রম তুলে ধরতেই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে ১৩ দফা কার্যক্রম তুলে ধরেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। দুইদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সম্মেলনে ৭১ সদস্য বিশিস্ট নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়েছে। ১৩ দফা কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের তরুণদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে পাঠাগার আন্দোলন জোড়দার করা, ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সমাজ গড়ে তোলার আহ্বানে সমমনা সকল সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় করে ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল প্রতিহত করতে চলমান আন্দোলনকে আরো বেগবান করা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যাকারী, মানবতাবিরোধী অপরাধী ও মুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াত ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলীম লীগ, এবং এসব সংগঠনের উদ্যোগে গঠিত শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, আল শামস, মুজাহিদ বাহিনী প্রভৃতি ঘাতক বাহিনীর বিচার চলতি বছর শুরু না হলে ২০১৮ সালের এজন্য বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়া। ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে আসতে আইনী লড়াইসহ সমমনা সংগঠনগুলোর সঙ্গে যৌথ কর্মসূচী নেয়া, সকল পর্যায়ের স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার পাঠ্যসূচীতে জামায়াত-হেফাজতি ভাবধারার মৌলবাদি সাম্প্রদায়িক সংযুক্তি বাতিল করে সংবিধানে ঘোষিত রাষ্ট্রের চার মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা না হলে এর বিরুদ্ধে কেন্দ্র থেকে আরম্ব করে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শক্তিশালী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে। এ কাজের কেন্দ্র থেকে আরম্ভ করে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে নির্মূল কমিটির সকল শাখায় সাংস্কৃতিক স্কোয়াড এবং তথ্যপ্রযুক্তি সেল গঠন করতে হবে। সকল সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, বঞ্চনা, বৈষম্য ও নির্যাতন অবসানের লক্ষে আশু করণীয় হিসেবে ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন, ‘জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন’, গঠন এবং ‘সংখ্যালঘু কল্যাণ মন্ত্রণালয়’ প্রতিষ্ঠার দাবিতে জনমত গঠনের পাশাপাশি আইনী লড়াই অব্যাহত রাখা। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস মোকাবেলায় দেশের সকল জেলা উপজেলায় প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও সাম্প্রদায়িক কর্মকা-ে জড়িত ব্যক্তিদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করা, দেশের যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা প্রদর্শন হয় না ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন হয় না সেসব প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের তালিকা তৈরী করা, সারাদেশে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা স্বাধীনতাবিরোধীদের খোজে বের করে তালিকা তৈরী করা, ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য নির্মূল কমিটির সকল বৈদেশিক শাখাকে সমমনা সব সংগঠনকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের আইনপ্রণেতার কাছে গণহত্যার ভয়াবহতা সহ তথ্যপ্রমান উপস্থাপন করা। এই লক্ষে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের গণহত্যার তথ্য প্রমাণ তুলে ধরে গণহত্যা গবেষক, মানবাধিকারকর্মী ও আইনপ্রণেতাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করতে হবে। সাংগঠনিক কার্যক্রম জোড়দার, পূর্ব ঘোষিত সকল কর্মসূচী অব্যাহত রাখা, সহ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার শিকার ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতি চির সবুজ রাখার পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ রোধে দেশে ও বিদেশে নির্মূল কমিটির সকল শাখা সমমনা সকল সংগঠনের সহযোগিতায় ৮ম জাতীয় সম্মেলনের আগে ৩০ লাখ বৃক্ষরোপন করা হবে। এই কর্মসূচী চলতি বছরের ২৫মার্চ ৪৬তম জাতীয় গণহত্যা দিবস থেকে শুরু হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণহত্যা দিবস রয়েছে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বেশি গণহত্যা বাংলাদেশে হয়েছে। কিন্তু সরকারীভাবে গণহত্যা দিবস পালন করা হচ্ছে না। গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতির স্বীকৃতি আদায়ে সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক উদ্যোগ বাড়ানোর দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বের সকল দেশের পার্লামেন্টে ও জাতিসংঘে এ ব্যাপারে প্রস্তাব পাশ করতে হবে। এজন্য সরকার, নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষা ও সংস্কৃতিক জিডিপি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, প্রগতি না হলে আমরা বাংলাদেশে থাকতে পারবো না। শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর আমার স্বামীকে আলবদররা ধরে নিয়ে হত্যা করে। এর আগে থেকেই বুঝতে পরছিলাম বিজয় আসন্ন। তাই আনন্দের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু হলো না। ১৬ ডিসেম্বর রাজাকাররা আত্মসমর্পন করল। কিন্তু স্বামীকে পেলাম না। ১৯৭২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত সমাবেশে বলেছিলাম স্বামী হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত প্রিয় শব্দ ‘জয় বাংলা’ আর বলবো না। যেদিন যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হলো সেদিন থেকে প্রাণ খুলে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলতে শুরু করেছি। তিনি শিক্ষাকে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করার দাবি জানিয়ে বলেন, এ লড়াইয়ে আমাদের সবাইকে শামিল হতে হবে। এজন্য সকলের সহযোগিতা চান তিনি। হেফাজতের কারণে শিক্ষা আইন বাতিল হতে পারে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, সরকার হয়ত তাদের দাবির মুখে শিক্ষা আইন বাতিল করবে। এরপর হেফাজতে ইসলাম দাবি জানাবে জাতীয় সঙ্গীত বাতিল করার। হয়ত ১৪ দল জাতীয় সঙ্গিত বাতিলের দাবিও হয়ত মেনে নেবে। পাকিস্তানী বেদনা থেকে আমরা ৪৬ বছরেও মুক্ত হতে পারিনি এমন মন্তব্য করে এই ইতিহাসবীদ বলেন, প্রকৃত ইসলামকে বিকৃত করছে হেফাজত। তারা ইসলাম বিরোধী কাজ করছে। তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধে দ-প্রাপ্তদের আগ্রাধিকার ভিত্তিতে আপিলের শুনানির দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, কেন জানিনা দ-প্রাপ্ততের আপিলের শুনানি সুপ্রিম কোর্টে থেমে আছে। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে মামুন বলেন, পাঠ্যবইতে সাম্প্রদায়িকতা করণ শুরু হয়েছে। এজন্য আমাদের লড়াই শেষ হয়নি। তিনি বলেন, আমাদের সব সাফল্য ম্লান ও বিনষ্ট হবে যদি পাঠ্যবইতে এরকম কেলেঙ্কারী হয়। এখন বইতে ইতিহাসও বিকৃত করা হচ্ছে। হেফাজতের সকল দাবি পূরণে বাড়তি চার কোটি টাকা ব্যয়ে ফের বই ছাপানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব বইয়ের কারণে আমাদের সন্তানরা মৌলবাদী হয়ে যাবে। তিনি বলেন, পরিকল্পিত ভাবে পাঠ্যবইকে সাম্প্রদায়িকতাকরণ করা হয়েছে। এর দায় সরকার সহ মন্ত্রণালয় কোন ভাবেই এড়াতে পারে না। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল, শফিকুর রহমান শহীদ, তানভীর হায়দার চৌধুরী, শমি কায়সার, আনসার আহমেদ উল্যাহ, শওকত বাঙালি, ডাঃ নুজহাত চৌধুরী শম্পা, নাদিয়া চৌধুরী, বিদেশী অতিথিদের মধ্যে ছিলেন, কানাডার উইলিয়াম স্লোন, ভারতের কবি গীতেশ শর্মা, নেপালের যুবনাথ লামসাল, সুইডেনের এরিক হেদলুন্দ প্রমুখ।
×