ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আজ হানাদারমুক্ত দিবস

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬

আজ হানাদারমুক্ত দিবস

ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ আজ আখাউড়া মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদারদের কাছ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার পতাকা ওড়ে আখাউড়ায়। স্বাধীনতা যুদ্ধে আখাউড়া ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম রণাঙ্গন। ভারত সীমান্তবর্তী হওয়ায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে এ এলাকায় পাক হানাদারদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ রণাঙ্গনে শহীদ হয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামালসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা। সম্ভ্রম হারিয়েছে শত শত নারী। কচুয়া নিজস্ব সংবাদদাতা কচুয়া, চাঁদপুর থেকে জানান, আজ কচুয়া মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্বের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায় পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনী। পাকবাহিনী সোর্স মারফত জানতে পারে, কচুয়াকে মুক্ত করতে মুক্তিবাহিনী সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। ওই সময় খান সেনারা চারিদিকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর আঘাতে পর্যুদস্ত হচ্ছিল। বিভিন্ন অঞ্চল ছেড়ে তাদের দল পালাতে শুরু করে। নবেম্বর মাসের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনী কচুয়ার হোসেনপুর বাজারের উত্তর পাশের ব্রিজটি এক্সক্লুসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে পাকসেনাদের দল কচুয়া-কালিয়াপাড়া পাকা রাস্তা সংলগ্ন লুন্তি গ্রাম থেকে মর্টারশেল নিক্ষেপ করে এবং কচুয়া বাজারে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে ভোরবেলা মালামাল নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। যুদ্ধকালীন কচুয়া উপজেলা কমান্ডার আব্দুর রশিদ পাঠান, সম্মিলিত বাহিনীর অধিনায়ক মরহুম ওয়াহিদুর রহমান ও মুজিব বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার (অপারেশন) জাবের মিয়া তাদের দল নিয়ে কচুয়া বাজারে প্রবেশ করে। কচুয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণে এনে প্রাণ খুলে আনন্দ উল্লাস করে। বীরগঞ্জ স্টাফ রিপোর্টার দিনাজপুর থেকে জানান, আজ বীরগঞ্জ শত্রুমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে বীরগঞ্জ এলাকাকে শত্রুমুক্ত করে মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীর যোদ্ধারা। পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও জেলা ৩ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সৈয়দপুর (পাকবিহার) অভিমুখে পালিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। হানাদার বাহিনী বীরগঞ্জ থেকে পিছু হটে বীরগঞ্জ-কাহারোল সীমান্তে দিনাজপুর-পঞ্চগড় মহাসড়কে ভাতগাঁও ব্রিজের পূর্ব প্রান্তে অবস্থান নেয়। এখানে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তুমুল যুদ্ধে ভাতগাঁও ব্রিজের একাংশ ভেঙ্গে যায়। এখানে বেশ কিছু মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যোদ্ধা শহীদ হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে দিনাজপুর ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন হওয়ায় বীরগঞ্জের আওয়াতাধীন ছিল। লে. কর্নেল কাজী নুরুজ্জামানের নেতৃতাধীন সেনাবাহিনীর হাবিলদার মোস্তাফিজুর রহমান বীরগঞ্জ ও খানসামার যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ৫ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় মিত্রবাহিনীর বিমান হামলার মধ্য দিয়ে বীরগঞ্জ শত্রুমুক্ত হতে থাকে। রাতেই পুরো এলাকা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী পুরোপুরি দখল করে নেয়। সকালে বীরগঞ্জের অলিগলিতে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। কুড়িগ্রাম রাজুমোস্তাফিজ কুড়িগ্রাম থেকে জানান, আজ কুড়িগ্রাম হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১’র এই দিনে কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাদের হটিয়ে কুড়িগ্রামকে মুক্ত করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হলেও এ অঞ্চলে সেদিন উদিত হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে সেই বিজয়ের স্মৃতিচারণ করতে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন সেদিনের মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ৬ ও ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল কুড়িগ্রাম অঞ্চল। শুধুমাত্র ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন রৌমারী ছিল মুক্তাঞ্চল। এখানেই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। ৬নং সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে একে একে পতন হতে থাকে পাক সেনাদের শক্ত ঘাঁটি। মুক্ত হয় ভুরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, চিলমারী, উলিপুরসহ বিভিন্ন এলাকা। এরপর পাক সেনারা শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে কুড়িগ্রাম শহরে। হাই বাহিনী কুড়িগ্রাম শহরকে মুক্ত করতে ৫ ডিসেম্বর পাক সেনাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের পাশাপাশি মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় বেসামাল হয়ে পালিয়ে যায় পাক সেনারা। মুক্ত হয় কুড়িগ্রাম। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানাতে হাজারো মুক্তিকামী মানুষ সেদিন মিলিত হয় বিজয় মিছিলে। হবিগঞ্জ নিজস্ব সংবাদদাতা হবিগঞ্জ থেকে জানান, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে হবিগঞ্জ মুক্ত হয় আজ। ফলে হবিগঞ্জের মুক্তিকামী আপামর উদ্বেলিত মানুষের আনন্দে রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে। হবিগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স গবেষণাগার থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী পাঠান জানান, মুক্তিযুদ্ধের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জেনারেল এম এ রব (বীর উত্তম) ও মেজর জেনারেল এজাজ আহমেদ চৌধুরীর নির্দেশে ভারতের খোয়াই বাঘাই ক্যাম্পের ২২ কোম্পানীর ১নং প্লাটুন কমান্ডার আব্দুস শহীদের নেতৃত্বে ৩৩ মুক্তিযোদ্ধা ৩ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের বাহুবলে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে তারা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে হবিগঞ্জে অভ্যন্তরে বসতি পাকিস্তানী বিভিন্ন ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পাকিবাহিনীকে পরাস্ত করে। এভাবে একটানা তিন দিনে অভিযানে বিপর্যস্ত হয়ে পাকিবাহিনী ৬ ডিসেম্বর ভোরে এসব ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ৩৩ মুক্তিযোদ্ধা বিজয়ী নিশান ও বাংলার পতাকা নিয়ে হবিগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানায় শত শত মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ। সেই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা শহর প্রদক্ষিণ করে হবিগঞ্জ সদর থানায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। একই দিন জেলার নবীগঞ্জ, লাখাই, চুনারুঘাটসহ সব কটি উপজেলা হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হলে সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধার বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। যশোর স্টাফ রিপোর্টার যশোর অফিস থেকে জানান, আজ যশোর মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে যশোর জেলা পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়েছিল। এদিন বিকেলে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। প্রথম শত্রুমুক্ত হয় যশোর জেলা। যশোরেই প্রথম উঠেছিল বিজয়ী বাংলাদেশের রক্ত সূর্য খচিত গাঢ় সবুজ পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) বৃহত্তর যশোর জেলার (যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইল) উপ-অধিনায়ক রবিউল আলম জানান, ৭১ সালের ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর যশোর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ সময় মিত্রবাহিনীও সীমান্ত এলাকা থেকে যশোর সেনানিবাসসহ পাক আর্মিদের বিভিন্ন স্থাপনায় বিমান হামলা ও গোলা নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে পর্যুদস্তু পাক বাহিনী ৫ ডিসেম্বর থেকে পলায়ন শুরু করে। যশোর সেনানিবাস ছেড়ে তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে খুলনার গিলাতলা সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়। পলায়নকালে ৫ ও ৬ ডিসেম্বর শহরতলীর রাজারহাটসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাদের প্রচণ্ড লড়াই হয়। ৬ ডিসেম্বর বিকেলের আগে যশোর সেনানিবাস খালি করে পালিয়ে যায় পাক হানাদাররা। বিকেলে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল বারাতের নেতৃত্বে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী সেনানিবাসে প্রবেশ করে দখল নেয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তির আনন্দে উচ্ছ্বসিত মুক্তিযোদ্ধা-জনতার ঢল নামে শহরে। পাড়া-মহল্লায়ও চলে খ- খ- আনন্দ মিছিল। মুক্তির আনন্দে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে ফেটে পড়ে গোটা জেলার মানুষ।
×