ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা-চট্টগ্রাম দুই সিটিতে চলছে ৩১ হাজার অটো ;###;মালিক-চালক কেউ আইনের তোয়াক্কা করছেন না ;###;আড়াই হাজার মালিকের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ, অভিযান মাত্র একটি গ্যারেজে ;###;নির্বিকার বিআরটিএ

যাত্রীদের জিম্মি করে ভাড়া আদায়, দেখার কেউ নেই ॥ অটোরিক্সায় নৈরাজ্য থামছে না

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৭ আগস্ট ২০১৬

যাত্রীদের জিম্মি করে ভাড়া আদায়, দেখার কেউ নেই ॥ অটোরিক্সায় নৈরাজ্য থামছে না

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সরকারী নির্দেশের তোয়াক্কা করছে না ঢাকা-চট্টগ্রামের অটোরিক্সা মালিক-শ্রমিকদের কেউই। মিটারে নয়, মনগড়া ভাড়ায় চলছে দুই সিটির প্রায় ৩১ হাজার সিএনজিচালিত গাড়ি। যাত্রীদের জিম্মি করে ভাড়া নেয়া হচ্ছে কয়েকগুণ। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। অন্যদিকে গাড়ির জমা নেয়ার ক্ষেত্রে বেপরোয়া মালিকরাও। দিনে ৯০০ টাকা জমার স্থলে আদায় করা হচ্ছে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা। দুই বেলায় দেয়া হচ্ছে গাড়ি ভাড়া। অটোরিক্সা সেক্টরের চলমান নৈরাজ্য থামাতে একটি পরিবহন সংগঠনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জমা ও ভাড়া আদায়কারী প্রায় আড়াই হাজার গাড়ির তালিকা সংশ্লিষ্টদের দেয়া হলেও অভিযান চালানো হয়েছে মাত্র একটি গ্যারেজে! এতে দ-িত হন একজন। এদিকে অটোরিক্সার নৈরাজ্য রোধে বিআরটিএর পক্ষ থেকে গঠিত মনিটরিং কমিটিও বর্তমানে অকার্যকর। বিআরটিএ ও পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, অটোরিক্সা ব্যবহার করে কেউ যেন সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে না পারে এজন্য এই সেক্টরের প্রতিনিধিদের নিয়ে আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের কার্যালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা ও চট্টগ্রামে অটোরিক্সা চালকদের আইডি কার্ড বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত হয়। এতে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা সম্মতি দেন। যদিও সিএনজি সার্ভিস নীতিমালায় চালকদের পরিচয়পত্র ঝোলানো, পোশাকের বিষয়টি উল্লেখ করা আছে। কিন্তু তা কেউ মানেন না। এরই ধারাবাহিকতায় ৮ আগস্ট বিআরটিএ এলেনবাড়ি কার্যালয়ে অটোরিক্সা মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক ও বিআরটিএ পরিচালক প্রশাসন মশিয়ার রহমানের সভাপতিত্বে আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে চালকদের পরিচয়পত্র গলায় ঝুলিয়ে গাড়ি চালানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া গ্যারেজ মালিকের পক্ষ থেকে চালকের ছবি, নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বরসহ আরেকটি পরিচয়পত্র ঝুলানো থাকবে অটোরিক্সার ভেতরে অর্থাৎ যাত্রীদের সামনে। জানতে চাইলে বিআরটিএ মনিটরিং কমিটির এক সদস্য জনকণ্ঠকে জানান, দেশে চলমান সন্ত্রাস, জঙ্গী তৎপরতার প্রেক্ষিতে ও সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি সবাইকে ইতোমধ্যে এই সিদ্ধান্তের কথা জানাতে। এজন্য পরিবহন মালিক শ্রমিক থেকে শুরু করে সকলের সহযোগিতার কথা বলেন তিনি। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অটোরিক্সা সেক্টরে সরকারী নিয়ন্ত্রণ না থাকায় চালক, মালিক পক্ষ উভয়েই বেপরোয়া। মাঝখানে বলির পাঠা হচ্ছেন সাধারণ যাত্রীরা। অটোরিক্সা চালকরা বলছেন, সরকারের নির্ধারিত জমার নিয়ম মানছে না মালিক পক্ষ। দিনে ৯০০ টাকার স্থলে একবেলা জমা দিতে হচ্ছে এক হাজার টাকারও বেশি। বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। তাই বাড়তি ভাড়া আদায়ের কথা স্বীকার করেছেন চালকদের অনেকে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সচিব শওকত আলী বলছেন, পরিবহন সেক্টরে অরাজকতা বন্ধে মোবাইল কোর্ট চলছে। এসব সমস্যা সমাধানে যাত্রীদের সহযোগিতা কামনা করেছেন তিনি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীতে পরিবহনের নৈরাজ্য থামাতে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) নিয়মিত ছয়টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করত। এখন আছে চারটি। সপ্তাহে একটি অথবা দুটি মোবাইলকোর্ট রাস্তায় নামে। অর্থাৎ বাস্তবতা এরকম যে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম দৃশ্যমান একথা বলা বা বোঝার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া ট্রাফিক পুলিশও অটোরিক্সা চালকদের নৈরাজ্য থামাতে এখন আর আগের মতো তৎপর নয়। পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে গত বছরের এক নবেম্বর থেকে সিএনজিচালিত অটোরক্সিার ভাড়া ও জমা পুনর্নির্ধারণ করে সরকার। মালিকদের জমা বাড়িয়ে ৬০০ টাকার স্থলে করা হয়েছে ৯০০ টাকা। নতুন ভাড়া অনুযায়ী প্রথম দুই কিলোমিটারে ভাড়া ২৫ টাকার স্থলে ৪০ টাকা করা হয়েছে। সর্বনিম্ন ভাড়াও তাই। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া সাত টাকা ৬৪ পয়সার স্থলে ১২ টাকা করা হয়। যানজট বা অন্য কোন কারণে রাস্তায় বিরতিকালে প্রতি মিনিটের ভাড়া এক টাকা ৪০ পয়সার স্থলে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে গণপরিবহনে ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। এরপরও অটোরিক্সা মালিকের বিরুদ্ধে বাড়তি জমা ও দুই শিফটে গাড়িভাড়া দেয়ার অভিযোগ ওঠে। তেমনি চালকদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগের শেষ নেই। চুক্তিতে চলা, স্বল্প দূরত্বে না যাওয়া, বাড়তি টিপস নেয়া ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। এসব নৈরাজ্য বন্ধে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গঠিত ১১ সদস্যের টাস্কফোর্স শুরু থেকেই কার্যত নীরব ভূমিকা পালন করে আসছে। অপরাধ চলছে, অথচ দেখার যেন কেউ নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চালক ও মালিকদের নৈরাজ্য রোধে মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক মশিয়ার রহমান কোন বৈঠক করেন না। এমনকি গ্যারেজ মালিক ও চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি আগ্রহী নন। তাই পুরো কমিটির কার্যক্রম নেই বললেই চলে। অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা হানিফ খোকন জনকণ্ঠ’কে বলেন, মিশুকের পরিবর্তে রিপ্লেসমেন্ট মিলিয়ে এখন রাজধানীতে অটোরিক্সার সংখ্যা ১৪ হাজার। চট্টগ্রামে ১৩ হাজার। দুই সিটিতে চলছে নানা অরাজকতা। বাড়তি জমা ও ভাড়া আদায়ের অভিযোগ সমানতালে। তিনি বলেন, আমাদের ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বাড়তি জমা আদায়কারী গ্যারেজ মালিক ও নিয়মবহির্ভূতভাবে দুই শিফটে ভাড়া দেয়া মালিকদের তালিকা সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ থেকে শুরু করে মহানগর পুলিশের কর্তাব্যক্তিদের হাতে দেয়া হয়েছে। কয়েক দফা তালিকা দেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে দুই হাজার ৩৮৪টি গাড়ির নম্বর, মালিকের মোবাইল নম্বরসহ গ্যারেজের ঠিকানা তালিকায় উল্লেখ ছিল। মজার বিষয় হলো, মাত্র একটি গ্যারেজে অভিযান চালানো হয়েছিল। অভিযানে একজন গ্যারেজ মালিককে এক মাসের জেল দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া কোথাও মোবাইল কোর্ট হয়নি। তিনি জানান, মাত্র চারজন ম্যাজিস্ট্রেট বা মোবাইল কোর্ট দিয়ে রাজধানীর লাখ লাখ পরিবহনের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। এতে কোন সেক্টরেই শৃঙ্খলা আসছে না বলেও মনে করেন তিনি। শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা চালকদের নৈরাজ্যের কথা স্বীকার করে বলেন, ২০১৫ সালের পহেলা নবেম্বরের পর থেকে বিভিন্ন অপরাধে ৮০০ বেশি চালক কারাভোগ করেছেন। এরপরও শৃঙ্খলা ফিরে না আসা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। চলতি বছর একদিনে রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে বিভিন্ন অপরাধে ৬৩ জন চালককে সাজা দেয়া হয়। তবে তারা বলছেন, আগে মালিক শ্রমিকদের নানা অপরাধে এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত সাজা দেয়া হতো। এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনদিন দেয়া হয়। শাস্তির মেয়াদ কম হওয়ায় অনেকে সরকারী নিয়মনীতি তোয়াক্কা করছেন না। সরেজমিন চিত্র ॥ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অটোরিক্সা চালকদের চরম নৈরাজ্য লক্ষ্য করা গেছে। গাবতলী, মহাখালী, শাহবাগ, কমলাপুর, রামপুরা, মালিবাগ, বাড্ডা, খিলক্ষেত, বাসাবো, মগবাজার নগরীর অন্তত ২০টি পয়েন্টে ঘুরে একটি অটোরিক্সাও মিটারে চলতে দেখা যায়নি। অভিযুক্ত পরিবহনগুলোর মধ্যে রয়েছে, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-২৩০৫, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৩২২৯, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-০৫৯৩, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৩৭১৯, ঢাকা মেট্রো-থ-১২-৬৭৫৬, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৩০১৪, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-০৩৩৩২, ঢাকা মেট্রো-থ-১২-৬২৩৫, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৩২৬৯, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-০৫৯৩, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৩৭১৯, ঢাকা মেট্রো-থ-১২-৬৭৫৬, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৩০১৪, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩০৩৩২, ঢাকা মেট্রো-থ-১২৬২৩৫, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩৩২৬৯, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৫১২৯, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩৫২৫৭, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-০৭৩৩, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-১৫২৩, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-৩৭৩৩, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-২৬২৩, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-১২৭৯, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-১২৪১, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-৩৭৩৫, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-৩৮৩৬, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-৩৭৩৫, ঢাকা মেট্রো-থ-১২-৮৫৪৩, ঢাকা মেট্রো-থ- ১৪-০৮৩৭, ঢাকা। প্রায় ছয় হাজার গাড়ি চলছে দুই শিফটে ॥ ঢাকা অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের হিসাব মতে, সরকারী নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে প্রায় ছয় হাজার অটোরিক্সা চলছে দুই শিফটে। এর মধ্যে দুই হাজার ৩৮৪ গাড়ির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়সহ বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কাছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুমোদিত অটোরিক্সা রয়েছে ১২ হাজার ৭১৫টি। মিশুকের পরিবর্তে আরও ৪১৫টি নতুন অটোরিক্সা নামানো হয়েছে। প্রাইভেট অটোরিক্সার নামে রাজধানীতে ভাড়ায় চলছে প্রায় ছয় হাজার গাড়ি। এছাড়াও গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকা জেলা মিলিয়ে আরও চার হাজার অটোরিক্সা অবৈধভাবে রাজধানীতে চলাচল করছে।
×