ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর সিংহহৃদয়ের পরিচয় পেয়েছিল জাপান

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৬ আগস্ট ২০১৬

বঙ্গবন্ধুর সিংহহৃদয়ের পরিচয় পেয়েছিল জাপান

বিডিনিউজ ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সিংহহৃদয়ের পরিচয় পেয়েছিল জাপানীরাও। তাকে হত্যার ঘটনা শোকগ্রস্ত করেছিল জাপানী বন্ধুদের। জাপানী লেখক, অধ্যাপক ও দেশটির রেডক্রসের সাবেক পরিচালক ফুকিউরা তাদামাসার স্মৃতিতে এখনও চির অমলিন বঙ্গবন্ধু। তার চোখে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন ‘সিংহ পুরুষ’। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপান রেডক্রসের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করে গেছেন তাদামাসা। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের নারকীয়তা তুলে এনেছেন ‘চি তো দোরো তো বানগুরাদেশু দোকুরিৎসু নো হিগেকি (রক্ত, কাদা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ট্র্যাজেডি) নামের বইয়ে। যুদ্ধের পরের বছর আবারও তৎকালীন শ্রমমন্ত্রী তাকাশি হায়াকাওয়ার সহযোগী হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানাতে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন সাংবাদিক, শিক্ষক ও রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার তানাকা মাসাকি ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহযোদ্ধা রাজকীয় সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি। ওই আমন্ত্রণের পর ১৯৭৩ সালে জাপান সফর করেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শ্রমমন্ত্রী তাকাশি হায়াকায়ার সংসদে দেয়া বক্তব্যের বাংলা তরজমা প্রকাশিত হয় মানচিত্র সাময়িকীর ১৯৯৬ সালের আগস্ট সংখ্যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শ্রমমন্ত্রী তাকাশি হায়াকায়ার সংসদে দেয়া বক্তব্যের বাংলা তরজমা প্রকাশিত হয় মানচিত্র সাময়িকীর ১৯৯৬ সালের অগাস্ট সংখ্যায়। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর জাপানের শ্রমমন্ত্রী তাকাশি দেশটির সংসদে শোক প্রস্তাবের আহ্বান করে বক্তব্য দেন। তার সেই বক্তব্যের বাংলা তরজমা করেন বাংলাদেশের আরেক বন্ধু অধ্যাপক কাজুও আজুমা। তাকাশির সেই বাংলা বক্তব্যটি পরে প্রকাশিত হয় জাপানে বাংলা সাহিত্যসাময়িকী ‘মানচিত্রে’। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তাকাশি ১৯৭৫ সালের ২৬ আগস্ট সংসদে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান (বাঙালীরা যাকে বঙ্গবন্ধু নামে সম্বোধন করে), তিনি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও আমার প্রিয় বন্ধু, যার জন্য আমি সব সময় আন্তরিক শ্রদ্ধা পোষণ করি।’ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে জাপানের জন্য ‘চরম আঘাত’ ও ‘অবর্ণনীয় শোকের ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি। তাকাশি তার বক্তব্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতির হত্যাকাণ্ডকে সেনাবাহিনীর হাতে জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইনুকার নিহত হওয়ার তুলনা করেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি জাপানের মেইজি যুগের অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক হিরোফুমি আইতোর সঙ্গে তুলনা করেন। মুক্তিযুদ্ধে বন্ধুর ভূমিকায় থাকা তাকাশি হায়াকায়াকে বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৭ মার্চ সম্মাননা (মরণোত্তর) দেয়। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ‘জাপানের-পরম’ বন্ধু হিসেবে অভিহিত করা হয়। শেখ রাসেল ও শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ওই সফরেই ‘যমুনা সেতু’ নির্মাণের চুক্তি হয়েছিল। সে সময় স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কোকেই তানাকা নয় হাজার মিলিয়ন ইয়েন বরাদ্দ দেন। বঙ্গবন্ধুর ওই সফরের পর অনেক জাপানীই বাংলাদেশকে চিনতে শুরু করে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুকে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানাতে ঢাকা এসেছিলেন জাপানের সাংবাদিক, রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার তানাকা মাসাকি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুকে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানাতে ঢাকা এসেছিলেন জাপানের সাংবাদিক, রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার তানাকা মাসাকি। জাপান সফরে প্রধানমন্ত্রী তানাকার দেয়া নৈশভোজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাপান সফরে প্রধানমন্ত্রী তানাকার দেয়া নৈশভোজে অংশ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওসাকা শহরের বাসিন্দা ৭৫ বছর বয়সী নাওকি তামায়া জানান, স্থানীয় পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর তারা নিয়মিতই পেতেন। জাপানের প্রভাবশালী দৈনিক ইয়মুরি সিম্বনে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছিল বলেও স্মরণ করেন তিনি। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরে দুঃখ পেয়েছিলেন জানিয়ে নাওকি তামায়া বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ জাপানের কাছাকাছি চলে আসত। তার বিচক্ষণতা বিশ্ব নেতাদের চেয়ে কম ছিল না। জাপানীরা বঙ্গবন্ধুকে তাদের মনে ঠাঁই দিলেও তার নাম নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশীদের উদাসীনতার সমালোচনা করেন তিন দশক ধরে জাপানে বসবাস করা লেখক ও গবেষক প্রবীর বিকাশ সরকার। তিনি বলেন, ‘আজও প্রবীণ জাপানী নাগরিক এবং বঙ্গবন্ধুর ভক্ত যারা জীবিত আছেন, তারা সবাই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেন। তবে প্রবাসীরা বঙ্গবন্ধুকে আধুনিক জাপানীদের কাছে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।’ তার সঙ্গে একমত পোষণ করে আরেক প্রবাসী আবু মোহাম্মদ সায়েম বলেন, দূতাবাস থেকে নির্ধারিত কর্মসূচী ছাড়া বছরের অন্য সময় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয় আলোচনাও হয় না। ‘প্রবাসে অনেক বাঙালী জাপানের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। তাদের সন্তানরা অনেকেই বঙ্গবন্ধুর নাম বলতে পারে না। দূতাবাসের উচিত, তাদের জন্য বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক বই পড়ার সুযোগ করে দেয়া, যাতে তারা প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারে।
×