ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, তুরস্ক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত প্রভৃতি দেশে জঙ্গী হামলা হয়েছে। এই সব দেশের ওপর কোন বিদেশী চাপ নেই ;###;বৈষম্য কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে!

কেন বিদেশী চাপ

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১০ আগস্ট ২০১৬

কেন বিদেশী চাপ

তৌহিদুর রহমান ॥ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একের পর এক জঙ্গী হামলার প্রেক্ষিতে সেখানে বিদেশী চাপ না থাকলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই কেবল ব্যতিক্রম ঘটছে। নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোন কোন দেশ দ্বিমুখী নীতিও গ্রহণ করেছে। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, তুরস্ক, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে জঙ্গী হামলায় সেসব দেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কোন প্রশ্ন না তুললেও কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রশ্ন তুলছে এসব দেশ। এছাড়াও জঙ্গী হামলার শিকার বিভিন্ন দেশে ব্রিটিশ কাউন্সিল সাময়িক বন্ধ করা না হলেও শুধু ব্যতিক্রম ঘটছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। এদিকে বিদেশীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রচলিত আইন ও বিধিমালা সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, তুরস্ক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত প্রভৃতি দেশে জঙ্গী হামলা ঘটেছে। বিশেষ করে ফ্রান্সে দফায় দফায় জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটছে। এছাড়া জার্মানিতে নিñিদ্র নিরাপত্তার মধ্যেও বিচ্ছিন্নভাবে জঙ্গী হামলা হয়েছে। এসব দেশে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকরা নিরাপত্তা নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলছেন না। এমনকি সোমবার পাকিস্তানের কোয়েটায় হামলার পরেও তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কোন প্রশ্নই তোলা হয়নি। তবে বাংলাদেশে জঙ্গী হামলা ঘিরে নিরাপত্তা ইস্যুতে বিভিন্নভাবে চাপে রয়েছে সরকার। নিরাপত্তা ইস্যু ঘিরে বাংলাদেশের ব্রিটিশ কাউন্সিল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে ব্রিটিশ কাউন্সিল অফিস বন্ধ হয়নি। বিশেষ করে আফগানিস্তানের কাবুলে কয়েকদিন আগে হামলায় নিহত হয়েছে প্রায় ৮০ নাগরিক। তবে কাবুলের ব্রিটিশ কাউন্সিল অফিসের সকল কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া সোমবার পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের কোয়েটা হামলায় প্রায় ৭৯ নাগরিক মারা গেলেও সেখানের ব্রিটিশ কাউন্সিল অফিস বন্ধ হয়নি। পাকিস্তানের করাচী, লাহোর ও ইসলামাবাদে ব্রিটিশ কাউন্সিলের অফিস রয়েছে। সে কারণে বাংলাদেশের ব্রিটিশ কাউন্সিল অফিস বন্ধের যৌক্তিকতা নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। ব্রিটিশ কাউন্সিল খুলে দেয়ার বিষয়ে ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনের সঙ্গে সরকারের একাধিক মন্ত্রীর বৈঠক হয়েছে। গত রবিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনার এ্যালিসন ব্লেকের পৃথক বৈঠক হয়। সেখানে ব্রিটিশ কাউন্সিল খুলে দেয়ার বিষয়েও আলোচনা হয়। বৈঠকে খুব শীঘ্রই ব্রিটিশ কাউন্সিল খুলে দেয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন এ্যালিসন ব্লেক। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশে জঙ্গী হামলার ঝুঁকি রয়েছে। কোন কোন দেশের দূতাবাসও উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। তবে এসব হুমকি সত্ত্বেও সেখানে বিভিন্ন দূতাবাস কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান। তবে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ মিশনের কেউ ফিরে আসেননি। সে সময় ইসলামাবাদের কূটনৈতিক মিশনে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল বাংলাদেশ। সে প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের বাংলাদেশ মিশনে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থানরত কূটনীতিক ও বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। সে কারণে বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল বিদেশী নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্বও বাংলাদেশের। রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার পরে বিদেশীদের নিরাপত্তায় সচেষ্ট বাংলাদেশ। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বিদেশীদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে কূটনৈতিক জোনে নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে সরকার। এছাড়া গোয়েন্দা তৎপরতাও অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। বিদেশী কূটনীতিকরা তাদের নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের কাছে ইতোমধ্যেই কয়েকটি সুপারিশ করেছেন। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে কূটনৈতিক জোনে নিরাপত্তা নিশ্চিত, বিদেশী ক্লাবে নিরাপত্তা প্রদান, বিদেশী প্রতিষ্ঠানের অফিসে নিরাপত্তা বৃদ্ধি, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অফিসে নিরাপত্তা নিশ্চিত, বিমানবন্দরে চেক আউট ও চেক ইনের সময় বিদেশীদের নিরাপত্তা প্রদান ও ঢাকার বাইরে থাকা সকল বিদেশীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এসব সুপারিশ ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন করেছে সরকার। তবে বিদেশীদের সকল প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রধারী নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ ও বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহারেরও অনুমতির বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বিদেশীদের নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশ সরকার প্রচলিত আইন ও বিধিমালা পর্যালোচনা করছে। বিশেষ করে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রধারী নিরাপত্তা প্রহরী ও বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ বিষয়ে আইন ও বিধিমালা সংশোধন করা যায় কি-না সেটাও খতিয়ে দেখছে সরকার। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, বিদেশী কূটনীতিকদের নিরাপত্তার প্রয়োজনে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও বিধিমালার সংশোধনী আনার বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। রাজধানী গুলশানে জঙ্গী হামলার পরে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি ঢাকা মিশনের কর্মকর্তারা ছুটি নিয়ে বাইরে গেছেন। তারা আর ঢাকায় ফিরবেন কি-না সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তাও দেখা দিয়েছে। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যদের স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ ত্যাগ করারও অনুমতি দেয়া হয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদ্যু গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাদের বেশ কিছু সহকর্মী ইতোমধ্যেই তাদের পরিবারের সদস্যদের নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। বাকিরা এখনও অপেক্ষা করছে কী সিদ্ধান্ত আসে, সেটা দেখার জন্য। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতর থেকে একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ঢাকায় এসেছেন। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই তিনি নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়ন কার্যক্রম শেষ করবেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরাপত্তা মূল্যায়ন কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে তাদের মিশনগুলো পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গী হামলা হলেও সেসব দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশী কোন চাপ তৈরি হয়নি। তবে ব্যতিক্রম ঘটছে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। এখানে বিদেশী কূটনীতিকরা যেভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, সেটা অন্য দেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। বিদেশী কূটনীতিকরা এখানে দ্বিমুখী আচরণ করছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের পাঞ্জাবের পাঠানকোটেও কিছুদিন আগে জঙ্গী হামলা হয়েছে। সেখানে নিহত হন ৮জন। তবে এই জঙ্গী হামলার পরে দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেনি সেখানের বিদেশী কূটনীতিকরা। এছাড়া ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে তাজ হোটেল হামলার পরেও সেখানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কূটনীতিকরা প্রশ্ন তোলেননি। একইভাবে ফ্রান্সে তিন দফা জঙ্গী হামলার পরেও সেখানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনি। এখন ব্যতিক্রম ঘটছে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতে রীতিমতো সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছেন। এছাড়া রাজধানীর গুলশানে হামলার পরেই তড়িঘড়ি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইয়ের ঢাকা সফর নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট জানিয়েছেন, নিরাপত্তা ইস্যু কেন্দ্র করে বাংলাদেশ দখলের কোন ইচ্ছা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেই। তারা শুধু বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে চাইছেন। ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাসে নিরাপত্তায় নিয়োজিত বেসকারী প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা কর্মীদের অস্ত্র বহন ও বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহারের অনুমতির বিষয়ে পর্যালোচনা চলছে। এর আগে কখনও বাংলাদেশে অবস্থিত কোন মিশনকে এ বিষয়ে অনুমোদন দেয়া হয়নি। কেননা, নিজ দেশের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা জোরদারের একটি বেসরকারী নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যদের অস্ত্র বহনের অনুরোধ জানিয়ে সরকারকে চিঠি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে মার্কিন দূতাবাসের ওই অনুরোধে সাড়া দেয়নি সরকার। এখন গুলশানে হামলার পর আবারও বেসরকারী নিরাপত্তা প্রহরীদের অস্ত্র বহন ও বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহারের অনুমতির বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। বিশেষ করে জাপান তার দেশের কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের কাছে বুলেটপ্রুফ গাড়ির অনুমোদন চেয়েছে। রাজধানীর গুলশানে জঙ্গী হামলার প্রেক্ষিতে দেশের কোন ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়নি বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তার অভিমত, জঙ্গী হামলা এখন বৈশ্বিক সমস্যা। সে কারণে একক কোন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, গত পহেলা জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলা চালায় একদল অস্ত্রধারী জঙ্গী। দেশী-বিদেশী অন্তত ৩৩ জন সেখানে জিম্মি হন। হামলাকারীদের ঠেকাতে গিয়ে বোমায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পরে কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ওই রেস্তরাঁর নিয়ন্ত্রণ নেয় সশস্ত্রবাহিনী। ১৩ জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও ২০ জনের লাশ পাওয়া যায় জবাই করা অবস্থায়। সে ঘটনার পর থেকেই বিদেশীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বিদেশীদের নিরাপত্তায় জাতীয় টাস্কফোর্সও গঠিত হয়েছে। ইতোমধ্যেই টাস্কফোর্সের একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই বৈঠকের সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যক্রম চলছে।
×