ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মীর কাশেমের মামলার শুনানিতে তদন্ত সংস্থার কাজে অসন্তোষ সিনহার

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

মীর কাশেমের মামলার শুনানিতে তদন্ত সংস্থার কাজে অসন্তোষ সিনহার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাশেম আলীর মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আপীলের শুনানিকালে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। এর আগেও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায়ে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনের কড়া সমালোচনা করা হয়েছিল। এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাশেম আলীর আপীল মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন অব্যাহত রয়েছে। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। মঙ্গলবার আপীল মামলার ৬ষ্ঠ দিনের শুনানিতে মীর কাশেমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেছেন এ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম। প্রথম দিনে সকাল সাড়ে দশটা থেকে দুপুর সোয়া একটা পর্যন্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তিনি। আজ বুধবার যুক্তিতর্ক শেষ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে আপীল বিভাগের এক নম্বর বেঞ্চে এ শুনানি চলছে। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান। মঙ্গলবার মীর কাশেমের অভিযোগের ওপর এ্যাটর্নি জেনারেল শুনানির শুরুতে বলেন, একটি হত্যার অভিযোগে একজন সাক্ষী হাজির করা হয়েছে। এ সময় প্রধান বিচারপতি অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, একটি হত্যার অভিযোগ প্রমাণে কী করে একজন সাক্ষী এবং তার শোনা সাক্ষ্য হাজির করা হলো। এ্যাটর্নি জেনারেল এর উত্তরে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাস করা হয়নি জানালে, তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রধান বিচারপতি। মামলার বিবরণী উল্লেখ করে তিনি বলেন, তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। মামলা পরিচালনার চেয়ে তাদের একটি মামলা শেষ করে দ্রুত গণমাধ্যমের সামনে আসার বিষয়ে আগ্রহ বেশি থাকে। শুনানিতে এ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘রাষ্ট্র লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্রসিকিউশন টিম নিয়োগ করেছে। কিন্তু তাঁরা মামলা পরিচালনায় দক্ষতা দেখাতে পারেননি। বরং সাক্ষী হাজির করার পর তাঁরা শুধু টেলিভিশনের সামনে চলে আসেন। এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, প্রসিকিউশন টিম এ চার্জের (অভিযোগ) বিষয়ে হয়ত ভালভাবে কাজ করতে পারেনি। এছাড়া মীর কাশেম আলী তো লন্ডন থেকেও লবিস্ট নিয়োগ করেছেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘তাহলে রাষ্ট্র লাখ লাখ টাকা খরচ করে এসব প্রসিকিউশন রেখেছে কেন? এদের সরিয়ে দেন।’ জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, সেটা দেখা হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মীর কাশেম আলীর অভিযোগের (৯ নম্বর) বিষয়ে আপনাদের দেয়া পেপার কাটিংয়ে দেখা যায় এ চার্জের ঘটনার সময় মীর কাশেম আলী ঢাকায় ছিলেন। তিনি ঢাকায় বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়েছেন।’ এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ১৯৭১ সালের ২৪ নবেম্বর মীর কাশেম আলী চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে নির্যাতন করেছেন। ২৩ নবেম্বর ঢাকা থেকে গিয়ে তিনি নির্যাতনে অংশ নেন। এছাড়া বিবৃতি দিয়ে ও সংবাদ প্রকাশ করা যায়। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ওই সময় তো (১৯৭১ সালে) মিডিয়ার অবস্থা এত উন্নত ছিল না। এখন যেভাবে মুহূর্তে সংবাদ প্রকাশ করা যায়, সে সময় চাইলেও সংবাদ সম্মেলন করা যেত না। মীর কাশেম আলী ওই সময় ঢাকায় ছিলেন, বক্তব্য দিলেন ওসব তো আপনাদের দেয়া পেপারে রয়েছে।’ জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিবৃতি পাঠিয়েও সংবাদ প্রকাশ করা যায়। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল ছিল না, কিন্তু মীর কাশেম আলী চট্টগ্রামে চলে যান। এরপর এ্যাটর্নি জেনারেল প্রসিকিউশনের নথি পড়া শুরু করেন। নথিতে তিনি বলেন, বদর দিবস উপলক্ষে ১৯৭১ সালের ৭ নবেম্বর ঢাকার বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে বক্তব্য দেন মীর কাশেম আলী। পরের দিন ৮ নবেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তানসহ তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকায় সে খবর প্রকাশিত হয়। খবরে মীর কাশেম আলীর নাম ও বক্তব্য ছাপা হয়। ২০১৪ সালের ৩০ নবেম্বর ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- থেকে বেকসুর খালাস চেয়ে আপীল করেন মীর কাশেমের আইনজীবীরা। আপীলে তার খালাসের পক্ষে ১৮১টি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৪ সালের ২ নবেম্ব^র বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মীর কাশেমকে মৃত্যুদ-ের রায় প্রদান করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধা জসিম ও জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে হত্যার দায়ে আদালত তাকে মৃত্যুদ-ের আদেশ দেন। এর মধ্যে ১২ নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে রায় প্রদান করা হয়। এছাড়া ২ নম্বর অভিযোগে ২০ বছর, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে মীর কাশেম আলীকে সাত বছর করে এবং ১৪ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদ-ের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। অপরদিকে ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ থেকে মীর কাশেমকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এ্যাটর্নি জেনারেলের ব্রিফিং ॥ এদিকে মীর কাশেমের মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হবার পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। প্রধান বিচারপতির ক্ষোভের বিষয়ে জানতে চাইলে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মীর কাশেম আলীর মামলা এবং অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রেও ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও তদন্ত সংস্থার কাজের ওপর আদালত খুবই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং এ মর্মে একটি উক্তি করেছেন যে, যথেষ্ট খরচ হচ্ছে এদের পিছনে। কিন্তু সঠিকভাবে তারা মামলা তদন্ত পরিচালনা করছেন না বলে তাদের কাছে মনে হয়েছে। ইতোমধ্যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায়ও কিন্তু আদালত কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। এই মামলাটিতেও শুনানির সময় আমাকে যথেষ্ট প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে যে, এ মামলার তদন্ত কাজ আরও সুষ্ঠুভাবে করা যেত। আরও ভালভাবে মামলাটি পরিচালনা করা যেত বলে আদালত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এ দুর্বলতার কারণে রায়ে কোন প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমার মনে হয় না। কারণ অনেক চার্জ আছে। আদালত দেখবে রাষ্ট্রপক্ষ এবং প্রসিকিউশন পক্ষ সার্থকভাবে মামলটি পরিচলানা করতে সক্ষম হয়েছে। কতগুলো চার্জ আছে দেখবেন সঠিকভাবে হয়নি, সেটা আদালত তার সিদ্ধান্ত দিবেন। আমি মনে করি না সব চার্জের ব্যাপারেই কোন সারবর্তা নেই এ কথা বলা যাবে না। প্রসিকিউশনের অদক্ষতায় তাদের সরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে মতামত দিয়েছেন এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আদালত তো সব সময়ই চান যারা মামলা পরিচালনা করবেন তারা দক্ষ হোক এবং ভালভাবে মামলা পরিচালনা করুক। আদালত তো আইনজীবীদের সহায়তা চায় মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে। আর এটিই স্বাভাবিক। আদালত শুনানির সময় অনেক রকম বক্তব্য মন্তব্য করেন। এ সমস্ত মন্তব্য আপনাদের কাগজে লিখে দেয়া সঠিক হবে না এবং এগুলো লেখাও সঠিক হবে না। কারণ আমাদের বক্তব্য বিটুইন জাজেস ইনদি ল ইয়ার। আমরা যে বক্তব্যগুলো বলব মনে করবেন সেগুলোই আদালতের বক্তব্য। আদালত ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, আপনি আপীল বিভাগে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি জবাবে বলেন, না আমার শুনানির ব্যাপারে আদালত কোন রকম অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। আপনার মূল যুক্তি কি ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার মূল বক্তব্য ছিল, ডালিম হোটেল ছিল টর্চার ক্যাম্প এবং সেখানে যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারাই আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেছে। এবং তাদের যে সমস্ত সাজেশন দেয়া হয়েছে সেখানে আসামিপক্ষ অনেক জিনিস স্বীকার করে নিয়েছে। আর তিনজন লোক যে মারা গেছে জসীম, কুন্ত সেন, রঞ্জিত দাস এই মৃত্যুগুলোকে তারা অস্বীকার করেনি। কাজেই এ মামলাতে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো যে, এই হত্যাকা-ের সঙ্গে মীর কাশেম আলী জড়িত ছিলেন কি না। চূড়ান্ত সাবমিশনের সময়েই আমরা দেখাব মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বে, তার নির্দেশে, উপস্থিতিতে এই হত্যাকা-গুলো হয়েছে।
×