ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

অমর একুশের দিনে পূর্ণতা পাবে প্রাণের মেলা

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

অমর একুশের দিনে পূর্ণতা পাবে প্রাণের মেলা

মোরসালিন মিজান ॥ অমর একুশের বইমেলা। একেবারে প্রথম দিন থেকেই মহান এই দিবসের জন্য প্রতীক্ষা করে থাকেন লেখক-পাঠক-প্রকাশকরা। আজ সেই প্রতীক্ষার অবসান হবে। ভাই হারানোর ব্যথা আর মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার গৌরবময় দিনে পূর্ণতা পাবে মেলা। ভোরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে সর্বস্তরের জনগণ। তার পরই জনতার ঢেউ আছরে পড়বে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২০তম দিনে শনিবার এর কিছু নমুনা দৃশ্যমান হয়েছে। এদিন মেলার বাতাসে কান পাতলে শোনা গেছে সেই অমর সঙ্গীতÑ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি...। বইপ্রেমীদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। মেলা শুরু হয়েছিল সকাল ১১টায়। শিশু প্রহর দিয়ে শুরু। সন্ধ্যা ও রাতে সব বয়সী মানুষের ভিড় ছিল। প্রচুর মানুষ বই দেখেছেন। বই কিনেছেন। অমর একুশের দিনে আজ রবিবার বিক্রি আরও বাড়বে বলে আশা করছেন প্রকাশকরা। এ প্রসঙ্গে কথা হয় সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ হোসেনের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মেলাটাই তো একুশের। একুশ তো মেলার প্রাণ, প্রেরণা। এই দিনে মানুষ বেশি আসবেন। বেশি বই কিনবেন। এটা এখন সবার জানা। তবে বই বিক্রি নয় শুধু, আজ মেলায় একুশের চেতনাকে উর্ধে তুলে ধরার আন্তরিক চেষ্টা থাকবে বলে জানান তিনি। নতুন বই শনিবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২০তম দিনে এসেছে অনেক নতুন বই। বাংলা একাডেমির তথ্য কেন্দ্রে জমা পড়েছে ২৩৬টি। এদিন আসা বইগুলোর অন্যতম একটি ‘বাংলাদেশ রাজনীতি, ধর্ম ও মৌলবাদের বিকাশ’। লিখেছেন প্রখ্যাত লেখক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। প্রকাশ করেছে সময় প্রকাশন। বইয়ে আলোচিত বিষয়গুলো আগেও সামনে এনেছেন লেখক। তবে এবার আরও বিস্তৃত পরিসরে। আরও সমৃদ্ধ। আজকের বাস্তবতায় এই গ্রন্থ খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়। বইটি মেলায় আসার দিন এসেছিলেন লেখকও। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, গত বছর নিউইয়র্কে ইসলামের বাস্তব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে কিছু কথা বলেছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তখন তাঁর কথার অনেক ভুল ব্যাখ্যা হয়েছিল। তাঁকে আক্রমণ করে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছিল মৌলবাদীরা। বিপরীতে, প্রগতিশীলদের কেউ তেমন প্রতিবাদ করেননি। আমি দৈনিক জনকণ্ঠে লিখে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলাম। সেই লেখা পাঠ করে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির ও সাংবাদিক স্বদেশ রায় বিষয়ের উপর বই লেখার পরামর্শ দেন। তখন আমি খেয়াল করি, আমার আগের কিছু লেখা আছে। সেগুলো নতুন করে সাজাই। আরও কিছু লেখার চেষ্টা করি। সব মিলিয়ে এই বই। তিনি বলেন, বইতে আমি লিখেছি, বাংলাদেশ হওয়ার পর থেকে কীভাবে রাজনীতি ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। বইটি আজকের জন্যও প্রাসঙ্গিক। এখনও রাজনীতি ধর্ম মৌলবাদÑ তিনটা পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আমরা কোথায় দাঁড়াব? আর আপোস না করলে কতদূর যাবে বাংলাদেশ? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে এ বইতে। বইটি লেখক উৎসর্গ করেছেন বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিককে। মেলায় এসেছিলেন তিনিও। জনকণ্ঠকে এই বিচারপতি বলেন, মুনতাসীর মামুন অনেক বড় মাপের লেখক ও গবেষক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা ও জঙ্গীবাদ মৌলবাদের বিরুদ্ধে কলম হাতে লড়ছেন তিনি। তাঁর অন্যতম সেরা গ্রন্থটি আমাকে উৎসর্গ করেছেন। এটা আমার জন্য গর্বের বিষয়। লেখকের মতো তাঁর নিজের অবস্থানও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে জানিয়ে মানিক বলেন, সুন্দর আগামীর জন্য এই সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ শনিবার গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ : সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক-গবেষক মফিদুল হক। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বদিউর রহমান এবং গোলাম কুদ্দুছ। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। প্রাবন্ধিক বলেন, সমন্বয়ের বার্তা বাঙালী জাতিসত্তার উদার-অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে প্রোথিত রয়েছে, তবে এর উৎপাটনের শক্তিও সমাজে প্রবল এবং অন্ধতার এই শক্তি কখনও কখনও রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়ে তছনছ করে দেয় গোষ্ঠী ও জাতির জীবন। এর চরম প্রকাশ আমরা দেখেছি একাত্তরে যখন পাক-সামরিক শাসকেরা তাদের মিত্র ধর্মান্ধ মৌলবাদের সহযোগিতায় গণহত্যাযজ্ঞে অবতীর্ণ হয়েছিল এ- দেশের মাটিতে। সেই রক্তসাগর পেরিয়ে যে বাংলাদেশের উদ্ভব, জাতিসত্তার চেতনা ও ঐক্য দৃঢ় করেই তার আগমনীর পথরেখা সন্ধান করতে হবে, সেই পথে এগিয়ে যেতে হবে দৃঢ়ভাবে। তিনি বলেন, বিশ্বায়ন একক বাজার অর্থনীতি তৈরি করেছে ঠিকই; কিন্তু একক মানবসমাজ তৈরি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এর বিপরীতে মানবতার যে সংগ্রাম, তা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য নির্মাণের সংগ্রাম। ধ্বংসপ্রক্রিয়ার বিপরীত মানবতার যে-সংগ্রাম তা দাবি করে ঘৃণার মতাদর্শ প্রবলভাবে রুখে দাঁড়ানো। কোন মহৎ মতাদর্শের নামে মনুষ্যত্বের অবমাননা চলতে দেয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও সাংস্কৃতিক সত্তা আমাদের সহায়, তা জোরদার ও প্রসার করার পথানুসন্ধান এবং সেই পথে অভিযাত্রা আজ তাই বিশেষ জরুরী। আলোচকরা বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালীর সাংস্কৃতিক সংগ্রাম পরিপূরক হয়েছে রাজনৈতিক সংগ্রামের। ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় বাঙালী জাতিসত্তা ও মূল্যবোধ বিনির্মাণে সংস্কৃতিকর্মীরা পালন করেছেন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। তাঁরা বলেন, বাঙালী সংস্কৃতির অবিনাশী শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েই আমাদের ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদের মতো শত্রুদের রুখে দাঁড়াতে হবে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রকৃতি জাগরণ চাইলে এক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হতে হবে। শুধু অনুদান দিয়ে যথার্থ সাংস্কৃতিক জাগরণ সম্ভব নয়। সভাপতির বক্তব্যে কামাল লোহানী বলেন, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সমস্যা যেমন আছে, আছে ব্যাপক সম্ভাবনাও। এখন সময় এসেছে সেই সম্ভাবনাকে খুঁজে বের করার। আর এজন্য চাই জাতি হিসেবে আমাদের গভীর আত্মবিশ্বাস। আমি বিশ্বাস করি, জনগণের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জাগরণই পারে সকল অপশক্তিকে তাড়াতে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ফকির সিরাজের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ পাঠ করবেন শিশুশিল্পী ফারহান সাদিক খান সামি। কবি মফিজ উদ্দিনের কাব্যগ্রন্থ ‘খেয়ালের’ মোড়ক উন্মোচন ॥ কবি মফিজ উদ্দিন আহমেদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘খেয়াল’-এর মোড়ক উন্মোচন করলেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। শনিবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একুশে বই মেলায় বইটির মোড়ক উন্মোচন শেষে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আইন ভঙ্গকারী অপরাধীদের জন্য পেশাগত কারণেই পুলিশকে কঠোর হতে হয়। সৃষ্টিশীলতা, মননশীলতা, সংবেদনশীলতা, মানবিক দর্শন ও স্বাধীনতার চেতনা আমরা পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সমভাবে লালন করি। ভাষা আন্দোলনের পটভূমির ধারাবাহিকতায় ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের অকাতরে রক্ত দান তারই স্বাক্ষর বহন করে। বইটির লেখক কবি মফিজ উদ্দিন আহমদ’কে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে আছাদুজ্জামান মিয়া তার লেখালেখিতে সহায়তা করার জন্য কবির সহধর্মিণীকে অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেবে উল্লেখ করেন। গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার এস এম মোস্তাক আহমেদ খান বলেন, কবি মফিজ উদ্দিন আহমেদের কাব্যগ্রন্থ ‘খেয়াল’-এর প্রকাশে বিশেষ অভিনন্দন। লেখালেখির এই ধারা ভবিষ্যতে অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি। বইটির প্রকাশক ও অনিন্দ্য প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী আফজাল হোসেন বলেন, সাইন্স ফিকশন লেখক ও উপ-পুলিশ কমিশনার এস এম মোস্তাক আহমেদ খানের একটি একক প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত কবি মফিজ আহমেদের একক আবৃত্তি আমাকে তার বই প্রকাশে অনুপ্রাণিত করেছে। কবি ও আবৃত্তিকার মাহিদুল ইসলাম বইটির লেখকের কাব্য প্রতিভার বিশেষ প্রশংসা করে তা অব্যাহত রাখার আহবান জানান। মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বইটির লেখক ও লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ, মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার, লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সঞ্জিত কুমার রায়, রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার পাঠক ও দর্শনার্থীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
×