ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

পরবর্তী নেতৃত্ব বুঝে নিতে ভোট দিচ্ছেন ভারতবাসী

এ যাবৎকালের বড় ভোট উৎসব শুরু

জনকণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ০০:২৬, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ যাবৎকালের বড় ভোট উৎসব শুরু

এ যাবৎকালের বড় ভোট উৎসব শুরু 

ভারতের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। পরবর্তী নেতৃত্ব বুঝে নিতে প্রায় একশ’ কোটি ভারতবাসী তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ শুরু করেছেন। আজ দেশটির ১৭টি রাজ্য এবং চারটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলিয়ে ভোট হচ্ছে ১০২ আসনে। তালিকায় আছে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি কেন্দ্র।

লোকসভার পাশাপাশি অরুণাচল প্রদেশের ৬০ এবং সিকিমের ৩২টি বিধানসভা আসনের সব ক’টিতেই ভোটগ্রহণ হচ্ছে এ দফায়। ভোটগ্রহণ সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলবে। ভোট অনুষ্ঠানের শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতি বৃহস্পতিবার দুপুরের মধ্যেই শেষ হয়।   
ভারতজুড়ে ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর জন্য নির্বাচনী কর্মকর্তারা সুউচ্চ পহাড়ে চড়েন, নদী পাড়ি দেন, সহিংস বিদ্রোহী তৎপরতা প্রবণ এলাকাগুলোর ভেতর দিয়েও গন্তব্যে পৌঁছান। প্রায় ২ মাসব্যাপী ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশনকে স্থাপন করতে হবে ১০ লাখের বেশি ভোটকেন্দ্র। এই কাজে নিয়োজিত রয়েছে এক কোটি ৫০ লাখ কর্মকর্তা ও নিরাপত্তাকর্মী।

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়ের একটি দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে ১৩৯ ভোটারের কাছে পৌঁছতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে ছোট একটি দলকে নেতৃত্ব দেন নির্বাচনী কর্মকর্তা ডব্লিউ মর্নিং বেলগিট। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পাহাড়ে উঠতে হবে, নদী পাড়ি দিতে হবে কিংবা হেলিকপ্টারে চড়তে হবে। কেউ যাতে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত না হন, তা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন তার কাজ করছে। খবর এনডিটিভি, বিবিসি ও আলজাজিরা অনলাইনের। 
মর্নিং বেলগিটের দল পাহাড়ের ১২ কিলোমিটার ওপরে ওঠার পর শ শ ধাপ নিচে নেমে একটি নদী পার হয়ে নোংরিয়াত গ্রামে পৌঁছায়। সেখানে একটি স্কুলে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করে তারা। শুক্রবার প্রথম দফায় অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর এবং মেঘালয়ের দুটি করে আসনে ভোটগ্রহণ হবে। একটি করে আসনে ভোটগ্রহণ হবে ছত্তিসগড়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম, ত্রিপুরা, উত্তরাখ-, আন্দামান ও নিকোবর, জম্মু ও কাশ্মীর, লক্ষদ্বীপ এবং পুদুচেরিতে।

মণিপুরে মোট দুটি লোকসভা আসন। মণিপুর এবং আউটার মণিপুর। তবে নির্বাচন কমিশন আউটার মণিপুরকে ভাগ করে দু’দফায় ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আউটার মণিপুরের চূড়াচাঁদপুর এবং চান্দেল জেলার ১৫টি বিধানসভা আসনে শুক্রবার ভোটগ্রহণ হবে। 
সামাজিক মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন বলেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্বাচনী আয়োজনের চেষ্টা চলছে। কর্মকর্তারা জানান, মাওবাদী সহিংসতাপূর্ণ হিমালয় ও মধ্য ভারতীয় নির্বাচনী এলাকা গাদচিরোলি-চিমুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহুসংখ্যক নির্বাচন কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়েছে। ৮৫০ জন ভোটগ্রহণ কর্মীও সেখানে পাঠানো হচ্ছে। নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে নিরাপত্তায়ও জোর দেওয়া হয়েছে। উত্তরের যে তিন কেন্দ্রে আজ ভোটগ্রহণ হচ্ছে সেগুলোতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন রয়েছে।

সঙ্গে মোতায়েন রয়েছে প্রচুর সংখ্যক রাজ্য পুলিশও। নিরাপত্তায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর ওপরে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনী ময়দানে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরা হচ্ছে- তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি এবং সিপিএম ও কংগ্রেস। ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) হাতে কোচবিহারের ক্ষমতা। তৃণমূল বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ করে উত্তর দখলের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই কেন্দ্রে বিজেপির বিদায়ী সাংসদ নিশীথ প্রামাণিকের প্রতিপক্ষ তৃণমূলের জগদীশ চন্দ্র বর্মা বসুনিয়া। ফরওয়ার্ড ব্লকের নীতীশ চন্দ্র রায়ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

এবারের নির্বাচনী প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর নিশানায় ছিলেন নিশীথ। বেশকিছু অশান্তির চিত্রও উঠে এসেছে এই কেন্দ্রে। আলিপুরদুয়ার তফসিলি উপজাতি (এসটি)র জন্য সংরক্ষিত কেন্দ্র। এই জেলায় চতুর্মুখী লড়াই হবে। লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় উত্তরবঙ্গের অন্য দুটি নির্বাচনী কেন্দ্রÑ জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারের সঙ্গে লড়াইয়ে নামবে।
জলপাইগুড়ি ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে একটি। উত্তরবঙ্গে অবস্থিত, এই আসনটি তফসিলি জাতি (এসসি)-এর জন্য সংরক্ষিত। ভোটের প্রথম দফায়, বিজেপির বিদায়ী সংসদ সদস্য ড. জয়ন্ত কুমার রায়, তৃণমূলের নির্মল চন্দ্র রায় এবং সিপিআইএমের প্রার্থী দেবরাজ বর্মণের ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য জয়ের পর উত্তরবঙ্গ বিজেপির শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।

ছয় সপ্তাহ ধরে চলা এই নির্বাচনে এবার প্রায় একশ’ কোটি ভোটার তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করবেন। ফলে এ নির্বাচন হতে চলেছে বিশ্বের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় নির্বাচন। নির্বাচন নিয়ে ভারতের রাজনীতির মাঠ এখন সরগরম। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারকে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আনতে মরিয়া। তার প্রমাণ বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে তিনি নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে মোদির উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
দেশটির প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসসহ ইন্ডিয়া জোটও বসে নেই। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস এবার পশ্চিমবঙ্গসহ অসমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে প্রচার চালাচ্ছে। দিল্লিতে ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টিসহ দেশটির অন্যান্য রাজ্যের অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলোও প্রচারে ব্যস্ত। কংগ্রেসের সাসেক সভাপতি রাহুল গান্ধী ইন্ডিয়া জোটের অপর গুরুত্বপূর্ণ নেতা অখিলেশ যাদবকে নিয়ে প্রচারে নেমেছেন। মাঠে সরব রয়েছেন কংগ্রেসের জনপ্রিয় মুখ পিয়াঙ্কা গান্ধীও। গেরুয়া শিবির তাদের উন্নয়ন বার্তা নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছে। আর কংগ্রেস শিবির বলছে, তারা ক্ষমতায় গিয়ে ভারতজুড়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। 
৫৪৩ আসনের লোকসভায় বিজেপি এবার ৩৭০ আসনের টার্গেট নিয়ে এগুচ্ছে। গেরুয়া শিবির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের লক্ষ্য ৪০০ আসন। গত লোকসভায় বিজেপি-এনডিএ জোট ৩০৩ আসন পায় যেখানে তাদের লক্ষ্য ছিল ৩০০ আসন। ২০১৯ সালের চেয়ে এবার ১০০ আসন বেশি পেতে চাইছে জোট। উত্তর প্রদেশে রামমন্দির উদ্বোধনের মধ্য দিয়েই বিজেপি কার্যত প্রচার শুরু করে। 
মোট ২ হাজার ৬৬০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনী যুদ্ধে নেমেছে। জনমত জরিপগুলো বলছে, বিজেপি ও এর মিত্ররা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে জয়ী হবে।
লোকসভার সবচেয়ে বড় দলের নেতা বা জোটের নেতা সাধারণত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভা গঠন করেন, যারা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি একাই ৩০৩ আসন পায়।  
এই নির্বাচনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ বৃহত্তম বিরোধী দল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষ থেকে। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স বা ইন্ডিয়া জোটে এরই মধ্যে ২৪ টির বেশি রাজনৈতিক দল যোগ দিয়েছে। এই জোটের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আছেন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। বর্তমানে কারাবন্দি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল আম আদমি পার্টিও (আপ) এ জোটে আছে।

সঙ্গে আছে আরও কিছু শক্তিশালী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল। দুর্নীতির অভিযোগে আম আদমি পার্টির তিন নেতা সম্প্রতি গ্রেপ্তার হন। দলটি বলছে, মোদি ও বিজেপি আম আদমির নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে। তবে বিজেপি এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
মোদি দাবি করতেই পারেন যে, ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কারণে বিশ্বে দেশটির অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে তাদের মিত্রদেশ করে রাখতে। মোদি সম্প্রতি ভারতের ৮০ কোটি গরিবের জন্য একাধিক উদার কল্যাণমূলক কর্মসূচি চালু করেছেন। এর মধ্যে বিনা মূল্যে শস্য সরবরাহ এবং কম আয়ের পরিবারের নারীদের মাসে ১ হাজার ২৫০ রুপি ভাতা দেওয়ার মতো বিষয় রয়েছে।

কংগ্রেস তাদের ইশতেহারে বলেছে, ভারতে এখন বেকারত্বের হার অনেক। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। ইশতেহারে বাড়তি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীদের ভাতা বৃদ্ধি এবং কলেজ উত্তীর্ণদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ভারতকে স্বৈরাচারের পথ থেকে সরিয়ে আনা হবে এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে কংগ্রেস। সংখ্যালঘুদের অভিযোগ, তারা প্রায়ই বৈষম্য ও হামলার শিকার হন। মোদির শাসনামলে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন।

তবে বিজেপি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। আন্তর্জাতিক নাগরিক অধিকার সংস্থা ফ্রিডম হাউজ বলেছে, বিজেপি সরকারের সমালোচনা করা ব্যক্তিদের, বিশেষ করে সাংবাদিকদের হয়রানি করার ঘটনা বাড়ছে। সংস্থাটি ভারতকে ‘আংশিকভাবে স্বাধীন’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করে।

×