ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দি সেলসম্যান

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ২ জুন ২০১৬

দি সেলসম্যান

ফ্রান্সে ‘দি পাস্ট’ নাটকটি মঞ্চায়নের পর স্বদেশ ইরানে চলচ্চিত্রের রাজ্যে ফিরে এসে পরিচালক আসগার ফারহাদী এবার কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের পুরস্কার জয় করেছেন তার ‘দি সেলসম্যান’ ছায়াছবির জন্য। এর আগে ২০১১ সালে একাডেমি-এওয়ার্ড তথা অস্কার জয় করেছিলেন তার ড্রামা ‘এ সেপারেশন’-এর জন্য। ‘এ সেপারেশন’-এ যে বিস্ময়কর সামাজিক জটিলতা ছিল তার কিছুই নেই ‘দি সেলসম্যান’-এ। তবে সেখানে নায়কের স্ত্রী আক্রান্ত ও ধর্ষিত হবার পর তরুণ স্বামীর হৃদয়ে প্রতিহিংসার যে ভয়ঙ্কর এবং নিয়ন্ত্রণ-অসাধ্য আগুন জ্বলে ওঠে সেটাকেই উপজীব্য করে ফারহাদী আত্মার অন্ধকার দিক অনুসন্ধানের প্রয়াস পেয়েছেন। দি সেলসম্যান তাই আহত অহঙ্কার ও প্রতিহিংসার কাহিনী। ‘দি সেলসম্যানের’ চালিকাশক্তিটা গুপ্ত বা লুক্কায়িত হয়। এটা এক সুপরিকল্পিত ড্রামা। তবে তার মধ্যেও কিছু কিছু ক্লান্তিকর অধ্যায় আছে। কিন্তু সবকিছুই ভুলে যাওয়া হয় চূড়ান্ত বা শেষ পর্বে সেখানে চরম আঘাতটা হানা হয় এবং দর্শকরা সুতীব্র উত্তেজনা ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে তা দেখতে থাকেন। এই পর্যায়ে বলতে হয় যে ফারহাদীর চলচ্চিত্র ও চিত্র পরিচালনা ইরানের চলচ্চিত্রকে যে ‘বিপ্লবাত্মক রূপদান করেছে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। ইরানের চলচ্চিত্র বাস্তবতাবাদ ও আত্মপ্রতিফলনের পথে বহুল প্রহৃত হয়েছে। ওই পথের পথিকৃৎ হলেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি ও মোহসেন মাখমালবাফের মতো পরিচালকরা। ফারহাদী সেই পথ থেকে ইরানী চলচ্চিত্রকে টেনে তুলেছেন এক নতুন ও উচ্চতর রূপের নাটকিত ও থিয়েটারি পথে। ‘দি সেলসম্যান’ এই ধারাটিকে তার শেষ সীমায় নিয়ে গেছে। এমনকি আহত অহঙ্কার ও প্রতিহিংসার এই কাহিনীতে থিয়েটারের একটি নাটকও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আধুনিক ইরানের সামাজিক বিভাজন নাটক থিয়েটারে এবং পাত্র-পাত্রীদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও ‘দি সেলসম্যান’ তা অত জোরালো নয়। এমনকি পরিচালকের ‘এ সেপারেশন’ এবং তারও আগের চলচ্চিত্র ‘ফায়ারওয়ার্কস ওয়েল্ড’তে প্রভু-ভৃত্যের মধ্যেকার উচ্চ-নীচ সামাজিক ডাইনামিকও প্রকটন নয়। এখানে যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় ঘাটতি তাহলো প্রধান চরিত্র ইমাদ (শাবাব হুসাইনী) ও তার স্ত্রী বানার (তারানেহ আলীদোস্তি) এর মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতা ও নৈতিক শূন্যতা। এই দুজন আবার পেশাদার অভিনেতা এবং তেহরানের সাংস্কৃতিক অভিজাত শ্রেণীর অংশ! ‘দি সেলসম্যান’ ছায়াছবিটি শুরুই হয়েছে আর্থার মিলারের ১৯৪৯ সালের পুলিংজার পুরস্কারজয়ী নাটক ‘ডেথ অব এ সেলসম্যান’ নাটকটির মহড়া দিয়ে। সেই মহড়ায় উইলী লোমানের ভূমিকায় আছেন ইমাদ এবং লিন্ডার ভূমিকায় তার স্ত্রী রানা। ব্যাপারটা বেশ মজার। তবে অতটা মজার নয় যখন দেখা যায় যে এমন এক পুরোদস্তুর আমেরিকান ক্লাসিককে রূপান্তরিত করা হয়েছে ফারসী ভাষায় এবং অভিনীত হয়েছে গোড়া রক্ষণশীল একটি দেশে সেখানে অপ্রত্যাশিত কিছু অসুবিধাও উৎপত্তি হয়। যেমন একটি দৃশ্যে সেক্সি ফ্রান্সিস শরীর সম্পূর্ণ রাখচাক অবস্থায় মঞ্চে উপস্থিত। অথচ সংলাপে বলে যে তার শরীরে মোটেই কোন কাপড় নেই। যাই হোক এবার দি সেলসম্যানের আসল কাহিনীতে আসা যাক। মাত্র কদিন আগে ইমাদ ও রানা এক বড়সর আধুনিক এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছিল। এক নাটকীয় রাতে ভবনটি ধসে পড়তে শুরু করলে তারা এপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে তাদেরই থিয়েটার দলের এক সদস্য বাবাকের (বাবাক করিমী) সঙ্গে একত্রে থাকার মতো আরেকটা জাযগা খুঁজে পায়। বাবাক একটা ব্যাপার চেপে যান যে তার আগের ভাড়াটে ছিল একজন বেশ্যা। বরং সেই অপ্রিয় শব্দটা প্রয়োগ না করে সে জানায় ওই মহিলার অনেকের সঙ্গে পরিচয় ছিল। দেয়ালের নিচের দিকের হিজিবিজি আঁকা দেখে বোঝা যায় যে মহিলার একটা ছোট বাচ্চাও ছিল। কারহাদী এর মাধ্যমে দর্শকদের সুদ্ধভাবে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল যে মহিলাটিকে সরাসরি খারিজ করে দেয়ার উপায় নেই। বাবাক যে এই মহিলাটিকে ব্যবহার করে থাকতেন অন্য একটি সূত্র থেকেও তা বোঝা যায়। মধ্যবিত্ত প্রতিবেশীদের চাপে তিনি তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছিলেন। সেই বাড়িতে মহিলাটি তার ব্যক্তিগত কিছু জিনিস রেখে গিয়েছিল যা রাখার নিদারুণ বিরক্তির কারণ ঘটায়। দর্শকরা তখনও ড্রামার প্রথম অংকে। রানা ইমাদের বাইরে থেকে ঘরে ফিরে এসেছেন। শাওয়ারে স্নান করার সময় সহসা তিনি আক্রান্ত হলেন। এখানেও ভায়োলেন্সের প্রকৃতিকে সযতেœ কাজে লাগানো হয়েছে। তবে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠল যে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আলী গোস্তি এই ঘটনায় শীতল দূরত্ব বজায় রাখেন। রানা হাসপাতাল থেকে মানসিক দিক দিয়ে নিদারুণ বিপর্যস্ত ও আতঙ্কতাড়িত হয়ে ফিরে আসেন। এ সময়ে আলী গোস্তির ভূমিকা দর্শকদের কাছে দারুণ অপছন্দের হয়ে দাঁড়ায়। সহানুভূতি চলে যায় ইমাদের দিকে। কারণ বিপর্যস্ত রানার মানসিক যন্ত্রণা লাঘবে সে তার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে থাকে এবং তার অযৌক্তিক সব দাবি ও আবদার পূরণ করে চলে। তবে অচিরেই সে তার ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছায়। যা কিছু ঘটেছে তা নিয়ে নানা ধরনের জেরার যাতে সম্মুখীন হতে না হয় তাই তারা পুলিশের কাছে যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর শুরু হয় ধর্ষককে খুঁজে বের করতে ইমাদের প্রশান্ত প্রমাণ। এই পর্যায় থেকে কাহিনীটা জমে ওঠে। উত্তেজনা বেড়ে চলে। ইমাদের মনোভাব সুদ্ধভাবে বদলাতে থাকে। স্ত্রীর প্রতি এত দরদী সোহাগী স্বামী এক ভীতিকর ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনাটি আর নিজের চরম অবমাননার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তার মাথায় যেন দোযখের যন্ত্রণা নেমে আসে। স্ত্রীর শারীরিক লাঞ্ছনার চাইতে তার অহম, তার আত্মমর্যাদার অপমানের জন্য সে অধিকতর রোধে কেটে পড়ে। সে এক নিষ্ঠুর পরিকল্পনা আটে যা একই সঙ্গে বিকৃত মানসিকতার পরিচায়ক ও শিহরণমূলক। তার চারপাশের সবাই এর অদৃষ্টপূর্ব ফল প্রত্যক্ষ করে। ১২৫ মিনিটের এই চলচিত্রটির ফরাসী নাম ফরুশাঙ্গ।
×