ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আর্থিক ঝুঁকি হ্রাসে বাড়াতে হবে রাজস্ব

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২১:০৭, ২৮ জুলাই ২০২২

আর্থিক ঝুঁকি হ্রাসে বাড়াতে হবে রাজস্ব

রাজস্ব ঘাটতি

গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশিঘাটতির আকারটা কম নয়প্রতিবছর এরকম মোটা অঙ্কের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছেজাতীয় বাজেটে প্রতিবছর যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয় তা আদায় হয় নাকর আদায়ে বাংলাদেশের সাফল্য ভাল নয়

প্রতিবছর শুল্ক-কর আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু অর্থনীতির আকার আরও বেশি গতিতে বেড়েছেমোট দেশজ উপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)দেশের মাত্র ১ শতাংশ মানুষ বার্ষিক রিটার্ন জমা দিয়ে আয়কর দেনজিডিপির তুলনায় কর আহরণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তলানির একটিআট দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম

বাংলাদেশের জিডিপির আকার যত এর মাত্র পৌনে ৯ শতাংশের কম আসে কর থেকেঅথচ পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে জিডিপির মোট ২১ শতাংশের মতো কর থেকে আসে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ

বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটিআর কর দেন ১৭ থেকে সাড়ে ১৭ লাখ মানুষঅপরদিকে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৯ লাখগাড়ির সংখ্যা ৫৩ লাখের বেশি, যার মধ্যে প্রাইভেটকার হলো প্রায় ৪ লাখআর বাড়ির সংখ্যা তো বাড়ছেবাংলাদেশে সবচেয়ে কম নাগরিক আয়কর দেনকর দেয়ার জটিল প্রক্রিয়া এবং হয়রানির ভয়ে দেশের নাগরিকরা করযোগ্য আয় থাকলেও কর দিতে আগ্রহবোধ করেন না

বড় অংশই আয়কর ফাঁকি দেনআবার অনেকে আয়করের বিনিময়ে সরকারী সেবা কম পাওয়ার কথাও বলেনদেশে আয়করদাতার সংখ্যা কম বলেই শুল্ক ও ভ্যাট আদায়ে বেশি চাপ দেয়া হয়যেমন-সাবানের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপরও নানা পর্যায়ে ভ্যাট আরোপ আছেঅথচ ধনী-গরিব সবাই সাবান ব্যবহার করেনফলে ভ্যাটের মতো পরোক্ষ করের মাধ্যমেও গরিব মানুষের কাছ থেকে কর আদায় করা হয়বাংলাদেশের জিডিপির আকার যত এর মাত্র পৌনে ৯ শতাংশের কম আসে কর থেকে

অথচ পার্শ্ববর্তী নেপালে জিডিপির মোট ২১ শতাংশের মতো কর থেকে আসে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই হিসাব পাওয়া গেছেযদিও সরকারী হিসাব বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছর নাগাদ কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছেদক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম কর-জিডিপি অনুপাত আফগানিস্তানেওই দেশে জিডিপির অনুপাতে সাড়ে ৭ শতাংশের মতো কর আসেএর পরেই আছে বাংলাদেশএ দেশে কর ব্যবস্থায় গত কয়েক দশকে কোন সংস্কার হয়নিতাই যে হারে অর্থনীতির আকার বাড়ছে সেই হারে রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না

এবার দেখা যাক বাংলাদেশে কত লোক কর দেনএটি প্রত্যক্ষ কর, রাজস্ব আহরণের ভিত্তিএকজন করদাতা আয় করেন, বছর শেষে আয়ের অংশ সরকারী কোষাগারে জমা দেনঅর্থনীতি শক্তিশালী হলে মানুষের আয়-রোজগার বাড়বে, বেশি লোক করের আওতায় আসবেনআবার শহর-গ্রাম নির্বিশেষে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সুষমভাবে বাড়তে থাকলে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে করদাতার সংখ্যা বাড়বেকর-জিডিপি অনুপাতও বাড়বে

বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি পেরিয়ে গেছেপ্রায় ৪৫ লাখ নাগরিকের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) আছেকিন্তু বছর শেষে আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা দেন মাত্র ২০-২২ লাখতাদের মধ্যে ৭-৮ লাখ সরকারী কর্মকর্তাপ্রতি মাসে বেতন-ভাতা প্রদানের সময় পে রোল ট্যাক্সহিসেবে কেটে রাখা হয় করঅন্যদিকে যারা বছর শেষে রিটার্ন জমা দেন তাদের কমবেশি ১০ শতাংশ শূন্য রিটার্ন জমা দেনএর মানে তারা কোন কর দেন না

কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে তাদের কোন ভূমিকা থাকে নামোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ কর দেনজনসংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে বেশি কর দেন ভুটানের নাগরিকরাভুটানের জনসংখ্যা ৭ লাখ ৫৪ হাজারসর্বশেষ গত অর্থবছরে প্রায় ৮৮ হাজার করদাতা রিটার্ন দিয়েছেনজনসংখ্যার ১১ শতাংশের বেশি প্রত্যক্ষ করের আওতায় আছেনদ্বিতীয় স্থানে থাকা নেপালের জনসংখ্যা ২ কোটি ৮০ লাখওই দেশে ৩০ লাখ করদাতা কর দেন

মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশ নাগরিক করের আওতায় আছেনশ্রীলঙ্কার অবস্থাও তুলনামূলক ভাল২ কোটি ১৬ লাখ জনসংখ্যার এই দ্বীপদেশটিতে ৭ শতাংশ মানুষ কর দেনওই দেশের করদাতার সংখ্যা ১৫ লাখের বেশিভারতে ১ কোটি ৪৬ লাখ মানুষ কর দেন১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত তাদের দেড় শতাংশ মানুষের কাছে আয়কর পায়পাকিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটিতাদের মধ্যে ২৫ লাখের বেশি করদাতা আছেনভারতে ১ কোটি ৪৬ লাখ মানুষ কর দেন

পাকিস্তানের অবস্থা প্রায় বাংলাদেশের মতোদক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কর কর্তৃপক্ষ ও রাজস্ব সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটগুলো ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছেদক্ষিণ এশিয়ার অপর দুটি দেশ মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানে ব্যক্তিশ্রেণির করকাঠামো সুদৃঢ় নয়মালদ্বীপে পর্যটননির্ভর অর্থনীতিআফগানিস্তান যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেওই দুটি দেশে কত লোক কর দেন তা জানা যায়নি

 কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে কয়েক বছর ধরে কর প্রশাসনে সংস্কার চলছেকর দেয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে অনলাইনে রিটার্ন জমা এবং অর্থ পরিশোধের সুযোগ তৈরি করা হয়েছেনতুন করদাতাদের টিআইএন নিতে এখন আর কর কার্যালয়ে যেতে হয় নাবাজেটে এনবিআরের লক্ষ্য অর্জনে আয়করের অংশ দিন দিন বাড়ছেএ দেশের অনেক নাগরিকের করযোগ্য আয় থাকলেও তারা কর দিতে চান না

এখন ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকামোটা দাগে, মাসে ২৫ হাজার টাকা আয় করলেই করের আওতায় আসার কথাতবে চাকরিজীবীদের বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত, চিকিসাসহ কিছু খাতের খরচে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের ওপর কর ছাড় আছেসেই হিসাবে বছরে তিন লাখ টাকার বেশি করযোগ্য আয় করেন এমন মানুষের সংখ্যা ২০ লাখের কমএর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছেরাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামেই দেশের ৬০-৬৫ শতাংশ করদাতার বাস

কিন্তু সিলেট, খুলনা, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, বগুড়াসহ বহু জেলায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্র হয়েছেএসব এলাকায় সেই তুলনায় তেমন নতুন করদাতা পাওয়া যাচ্ছে নাহয়রানির ভয়ে কর দিতে আগ্রহী হন না সামর্থ্যবানরাতারা মনে করেন একবার করের জালে ঢুকে গেলে প্রতিবছরই কর দিতে হবে কিংবা আগের বছরের চেয়ে আয় কমে গেলে কর কর্মকর্তাদের প্রশ্নের জালে জর্জরিত হতে হবেএর সত্যতাও আছে

আগের বছরের চেয়ে আয় বা করের পরিমাণ কমে গেলে প্রতিবছর বহু করদাতাকে সংশ্লিষ্ট সার্কেল অফিস থেকে নোটিস পাঠানো হয়ব্যাখ্যা দিতে হয় কেন আয় কমলআবার কর দিতে গেলে নানা ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয়এসব ঝক্কিঝামেলাই কর দেয়ার আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছেমানুষ কেন কর দিতে যাবেন? প্রথমবার রিটার্ন দিতে গেলে কর কর্মকর্তারা ইতিহাস জানতে চান- ‘কটি সঞ্চয়পত্র কিনেছেন, ব্যাংকে কত টাকা আছে, কিভাবে সম্পদ অর্জন করলেনইত্যাদিএত সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে কেউ কর দিতে উসাহী হন নাবাঘে ছুঁলে ১৮ ঘা, এনবিআর ছুঁলে ৩৬ ঘা

দেখা যাক গত ১০ বছরে করদাতার সংখ্যা কত বাড়ল২০১০-১১ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১৪ লাখ করদাতা কর দিয়েছেন১০ বছর পর তা মাত্র ২২ লাখে উন্নীত হয়েছে১০ বছরে নতুন করদাতা বেড়েছে মাত্র ৮ লাখকিন্তু গত ১০ বছরে মোট দেশজ উপাদনের (জিডিপি) আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে২০১০-১১ অর্থবছরে স্থির মূল্যে জিডিপির আকার ছিল সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা

গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকাএর মানে এই সময়ে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের মূল্য সংযোজন দ্বিগুণ হয়েছেমাথাপিছু গড় আয়ও বেড়েছে দ্বিগুণের বেশিকিন্তু তাল মিলিয়ে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে পারেনি এনবিআরএনবিআর প্রতিবছর নতুন করদাতার খোঁজে নানা ধরনের কর্মসূচী নিয়ে থাকেএই কর্মসূচীতে শুধু টিআইএন দেয়া হয়এতে টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়েকিন্তু টিআইএন নিয়ে পরের বছর থেকে কতজন রিটার্ন দিয়ে কর দিলেন তা খুঁজে দেখে না এনবিআর

কয়েক বছর আগের বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সব নির্বাহী পর্যায়ে টিআইএন নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়শর্ত দেয়া হলো, এমন নির্বাহী পর্যায়ের কর্মীর টিআইএন না থাকলে তার বেতন-ভাতা বাবদ খরচ ওই প্রতিষ্ঠানের খরচে দেখাতে পারবে নাফলে হু হু করে টিআইএনধারীর সংখ্যা বেড়ে যায়কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল রিটার্ন জমা খুব বেশি বাড়েনিযাক সে কথাআমরা এখনও কর-জিডিপির হার ৯ শতাংশ পার করতে পারিনি

মূল কথা হলো অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে পিছিয়ে আছি আমরাযার ফলে বৈদেশিক দেনার পরিমাণ বাড়ছেপ্রতিবছর বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য মোটা অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে অভ্যন্তীরণ ও বৈদেশিক নানা উস থেকেরাজস্ব আয় বাড়াতে না পারলে সরকারের আর্থিক ঝুঁকি থেকেই যাবে

 

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক-বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিঃ

×