রাজস্ব ঘাটতি
গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ঘাটতির আকারটা কম নয়। প্রতিবছর এরকম মোটা অঙ্কের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। জাতীয় বাজেটে প্রতিবছর যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয় তা আদায় হয় না। কর আদায়ে বাংলাদেশের সাফল্য ভাল নয়।
প্রতিবছর শুল্ক-কর আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু অর্থনীতির আকার আরও বেশি গতিতে বেড়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। দেশের মাত্র ১ শতাংশ মানুষ বার্ষিক রিটার্ন জমা দিয়ে আয়কর দেন। জিডিপির তুলনায় কর আহরণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তলানির একটি। আট দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
বাংলাদেশের জিডিপির আকার যত এর মাত্র পৌনে ৯ শতাংশের কম আসে কর থেকে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে জিডিপির মোট ২১ শতাংশের মতো কর থেকে আসে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। আর কর দেন ১৭ থেকে সাড়ে ১৭ লাখ মানুষ। অপরদিকে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৯ লাখ। গাড়ির সংখ্যা ৫৩ লাখের বেশি, যার মধ্যে প্রাইভেটকার হলো প্রায় ৪ লাখ। আর বাড়ির সংখ্যা তো বাড়ছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে কম নাগরিক আয়কর দেন। কর দেয়ার জটিল প্রক্রিয়া এবং হয়রানির ভয়ে দেশের নাগরিকরা করযোগ্য আয় থাকলেও কর দিতে আগ্রহবোধ করেন না।
বড় অংশই আয়কর ফাঁকি দেন। আবার অনেকে আয়করের বিনিময়ে সরকারী সেবা কম পাওয়ার কথাও বলেন। দেশে আয়করদাতার সংখ্যা কম বলেই শুল্ক ও ভ্যাট আদায়ে বেশি চাপ দেয়া হয়। যেমন-সাবানের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপরও নানা পর্যায়ে ভ্যাট আরোপ আছে। অথচ ধনী-গরিব সবাই সাবান ব্যবহার করেন। ফলে ভ্যাটের মতো পরোক্ষ করের মাধ্যমেও গরিব মানুষের কাছ থেকে কর আদায় করা হয়। বাংলাদেশের জিডিপির আকার যত এর মাত্র পৌনে ৯ শতাংশের কম আসে কর থেকে।
অথচ পার্শ্ববর্তী নেপালে জিডিপির মোট ২১ শতাংশের মতো কর থেকে আসে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই হিসাব পাওয়া গেছে। যদিও সরকারী হিসাব বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছর নাগাদ কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম কর-জিডিপি অনুপাত আফগানিস্তানে। ওই দেশে জিডিপির অনুপাতে সাড়ে ৭ শতাংশের মতো কর আসে। এর পরেই আছে বাংলাদেশ। এ দেশে কর ব্যবস্থায় গত কয়েক দশকে কোন সংস্কার হয়নি। তাই যে হারে অর্থনীতির আকার বাড়ছে সেই হারে রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না।
এবার দেখা যাক বাংলাদেশে কত লোক কর দেন। এটি প্রত্যক্ষ কর, রাজস্ব আহরণের ভিত্তি। একজন করদাতা আয় করেন, বছর শেষে আয়ের অংশ সরকারী কোষাগারে জমা দেন। অর্থনীতি শক্তিশালী হলে মানুষের আয়-রোজগার বাড়বে, বেশি লোক করের আওতায় আসবেন। আবার শহর-গ্রাম নির্বিশেষে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সুষমভাবে বাড়তে থাকলে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে করদাতার সংখ্যা বাড়বে। কর-জিডিপি অনুপাতও বাড়বে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি পেরিয়ে গেছে। প্রায় ৪৫ লাখ নাগরিকের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) আছে। কিন্তু বছর শেষে আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা দেন মাত্র ২০-২২ লাখ। তাদের মধ্যে ৭-৮ লাখ সরকারী কর্মকর্তা। প্রতি মাসে বেতন-ভাতা প্রদানের সময় ‘পে রোল ট্যাক্স’ হিসেবে কেটে রাখা হয় কর। অন্যদিকে যারা বছর শেষে রিটার্ন জমা দেন তাদের কমবেশি ১০ শতাংশ শূন্য রিটার্ন জমা দেন। এর মানে তারা কোন কর দেন না।
কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে তাদের কোন ভূমিকা থাকে না। মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ কর দেন। জনসংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে বেশি কর দেন ভুটানের নাগরিকরা। ভুটানের জনসংখ্যা ৭ লাখ ৫৪ হাজার। সর্বশেষ গত অর্থবছরে প্রায় ৮৮ হাজার করদাতা রিটার্ন দিয়েছেন। জনসংখ্যার ১১ শতাংশের বেশি প্রত্যক্ষ করের আওতায় আছেন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা নেপালের জনসংখ্যা ২ কোটি ৮০ লাখ। ওই দেশে ৩০ লাখ করদাতা কর দেন।
মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশ নাগরিক করের আওতায় আছেন। শ্রীলঙ্কার অবস্থাও তুলনামূলক ভাল। ২ কোটি ১৬ লাখ জনসংখ্যার এই দ্বীপদেশটিতে ৭ শতাংশ মানুষ কর দেন। ওই দেশের করদাতার সংখ্যা ১৫ লাখের বেশি। ভারতে ১ কোটি ৪৬ লাখ মানুষ কর দেন। ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত তাদের দেড় শতাংশ মানুষের কাছে আয়কর পায়। পাকিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। তাদের মধ্যে ২৫ লাখের বেশি করদাতা আছেন। ভারতে ১ কোটি ৪৬ লাখ মানুষ কর দেন।
পাকিস্তানের অবস্থা প্রায় বাংলাদেশের মতো। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কর কর্তৃপক্ষ ও রাজস্ব সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটগুলো ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুটি দেশ মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানে ব্যক্তিশ্রেণির করকাঠামো সুদৃঢ় নয়। মালদ্বীপে পর্যটননির্ভর অর্থনীতি। আফগানিস্তান যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। ওই দুটি দেশে কত লোক কর দেন তা জানা যায়নি।
কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে কয়েক বছর ধরে কর প্রশাসনে সংস্কার চলছে। কর দেয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে অনলাইনে রিটার্ন জমা এবং অর্থ পরিশোধের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। নতুন করদাতাদের টিআইএন নিতে এখন আর কর কার্যালয়ে যেতে হয় না। বাজেটে এনবিআরের লক্ষ্য অর্জনে আয়করের অংশ দিন দিন বাড়ছে। এ দেশের অনেক নাগরিকের করযোগ্য আয় থাকলেও তারা কর দিতে চান না।
এখন ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা। মোটা দাগে, মাসে ২৫ হাজার টাকা আয় করলেই করের আওতায় আসার কথা। তবে চাকরিজীবীদের বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসাসহ কিছু খাতের খরচে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের ওপর কর ছাড় আছে। সেই হিসাবে বছরে তিন লাখ টাকার বেশি করযোগ্য আয় করেন এমন মানুষের সংখ্যা ২০ লাখের কম। এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামেই দেশের ৬০-৬৫ শতাংশ করদাতার বাস।
কিন্তু সিলেট, খুলনা, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, বগুড়াসহ বহু জেলায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্র হয়েছে। এসব এলাকায় সেই তুলনায় তেমন নতুন করদাতা পাওয়া যাচ্ছে না। হয়রানির ভয়ে কর দিতে আগ্রহী হন না সামর্থ্যবানরা। তারা মনে করেন একবার করের জালে ঢুকে গেলে প্রতিবছরই কর দিতে হবে কিংবা আগের বছরের চেয়ে আয় কমে গেলে কর কর্মকর্তাদের প্রশ্নের জালে জর্জরিত হতে হবে। এর সত্যতাও আছে।
আগের বছরের চেয়ে আয় বা করের পরিমাণ কমে গেলে প্রতিবছর বহু করদাতাকে সংশ্লিষ্ট সার্কেল অফিস থেকে নোটিস পাঠানো হয়। ব্যাখ্যা দিতে হয় কেন আয় কমল। আবার কর দিতে গেলে নানা ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয়। এসব ঝক্কিঝামেলাই কর দেয়ার আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে। ‘মানুষ কেন কর দিতে যাবেন? প্রথমবার রিটার্ন দিতে গেলে কর কর্মকর্তারা ইতিহাস জানতে চান- ‘কটি সঞ্চয়পত্র কিনেছেন, ব্যাংকে কত টাকা আছে, কিভাবে সম্পদ অর্জন করলেন’ ইত্যাদি। এত সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে কেউ কর দিতে উৎসাহী হন না। বাঘে ছুঁলে ১৮ ঘা, এনবিআর ছুঁলে ৩৬ ঘা।
দেখা যাক গত ১০ বছরে করদাতার সংখ্যা কত বাড়ল। ২০১০-১১ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১৪ লাখ করদাতা কর দিয়েছেন। ১০ বছর পর তা মাত্র ২২ লাখে উন্নীত হয়েছে। ১০ বছরে নতুন করদাতা বেড়েছে মাত্র ৮ লাখ। কিন্তু গত ১০ বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে স্থির মূল্যে জিডিপির আকার ছিল সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা। এর মানে এই সময়ে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের মূল্য সংযোজন দ্বিগুণ হয়েছে। মাথাপিছু গড় আয়ও বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। কিন্তু তাল মিলিয়ে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে পারেনি এনবিআর। এনবিআর প্রতিবছর নতুন করদাতার খোঁজে নানা ধরনের কর্মসূচী নিয়ে থাকে। এই কর্মসূচীতে শুধু টিআইএন দেয়া হয়। এতে টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু টিআইএন নিয়ে পরের বছর থেকে কতজন রিটার্ন দিয়ে কর দিলেন তা খুঁজে দেখে না এনবিআর।
কয়েক বছর আগের বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সব নির্বাহী পর্যায়ে টিআইএন নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। শর্ত দেয়া হলো, এমন নির্বাহী পর্যায়ের কর্মীর টিআইএন না থাকলে তার বেতন-ভাতা বাবদ খরচ ওই প্রতিষ্ঠানের খরচে দেখাতে পারবে না। ফলে হু হু করে টিআইএনধারীর সংখ্যা বেড়ে যায়। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল রিটার্ন জমা খুব বেশি বাড়েনি। যাক সে কথা। আমরা এখনও কর-জিডিপির হার ৯ শতাংশ পার করতে পারিনি।
মূল কথা হলো অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে পিছিয়ে আছি আমরা। যার ফলে বৈদেশিক দেনার পরিমাণ বাড়ছে। প্রতিবছর বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য মোটা অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে অভ্যন্তীরণ ও বৈদেশিক নানা উৎস থেকে। রাজস্ব আয় বাড়াতে না পারলে সরকারের আর্থিক ঝুঁকি থেকেই যাবে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক-বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিঃ