ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কোরবানি ঈদে অর্থনীতি

জলি রহমান

প্রকাশিত: ১৯:১৩, ৩১ মে ২০২৫

কোরবানি ঈদে অর্থনীতি

বছর ঘুরে আবার এলো পবিত্র ঈদুল আজহা, যা কোরবানির ঈদ নামেও পরিচিত। প্রতি বছর ত্যাগের এ উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতি হয় সমৃদ্ধ।  এ সময় পশু কেনাবেচা, পরিবহন, চামড়া শিল্প, খাদ্য ও পোশাক খাতসহ নানা সেক্টরে ব্যাপক আর্থিক কর্মকাণ্ড সৃষ্টি হয়, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে দেশীয় অর্থনীতিতে। গ্রামীন এলাকা থেকে শহরাঞ্চল সর্বত্র এই উৎসবের প্রভাব পড়ে সমানভাবে। 
গবাদি পশুর ক্রয়-বিক্রয়
রোজার ঈদে পোশাক ক্রয়-বিক্রয় এবং যাকাত-ফিতরার মাধ্যমে অর্থ এক হাত থেকে অন্য হাতে যায়। কোরবানিতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় পশু বেচাকেনা। ফলে অর্থপ্রবাহ অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বাড়ে। ঈদুল আজহায় প্রতি বছরের মতো এ বছরও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে কোরবানিযোগ্য সর্বমোট ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি গবাদিপশুর প্রাপ্যতা আশা করা যাচ্ছে। এবার হৃষ্টপুষ্টকৃত গবাদিপশুর মধ্যে ৫৬ লাখ দুই হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষ, ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০টি ছাগল-ভেড়া এবং ৫ হাজার ৫১২টি অন্যান্য প্রজাতি রয়েছে। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও প্রায় ২০ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৫টি গবাদিপশুর উদ্বৃত্ত থাকবে বলে আশা করছে মন্ত্রণালয়। গত বছর দেশে কোরবানিযোগ্য পশু ছিল ১ কোটি ২৯ লাখ, এর মধ্যে কোরবানি হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ। ২০২৪ সালে শুধু কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয় উপলক্ষে লেনদেন হয় ৬৯ হাজার ১৪১ কোটি ১২ লাখ টাকা। যার সিংহভাগই যুক্ত হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এছাড়া গত বছর অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ৪ হাজার ৭৪০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা মূল্যের ৫ দশমিক ৫ লাখ গবাদিপশু বিক্রি হয়েছে।  
বাজার ব্যবস্থাপনা 
পবিত্র ঈদুল আজহায় সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে পশুর হাট। প্রতিটি জেলা-উপজেলায় মাঠ, ঘাট, পথে পশুর হাট বসানো হয়। দুই সিটি করপোরেশনের তথ্যানুযায়ী, এ বছর গাবতলীর স্থায়ী হাটসহ ঢাকায় মোট ২০টি পশুর হাট বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। আগের বছরগুলোতে এ সময়ের মধ্যেই ইজারা প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়ে যায়। কিন্তু এবার নানা কারণে তা বিলম্বিত হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২৫ সালে পশুর প্রজনন এবং খামারিরা আগেভাগেই প্রস্তুতি নেওয়ার কারণে স্থানীয়ভাবে সরবরাহ চাহিদার প্রায় ৯৫ শতাংশ পূরণ সম্ভব হচ্ছে। বিদেশ থেকে পশু আমদানির প্রয়োজন তেমনভাবে দেখা যায়নি, যা দেশের অভ্যন্তরীণ কৃষি ও খামার শিল্পের জন্য একটি বড় ইতিবাচক দিক। 
অনলাইন বেচাকেনা
২০২৫ সালে দেশে ডিজিটাল হাটের ব্যাপকতা আরও বেড়েছে। করোনাকালে যে অনলাইন পশুর হাট চালু হয়েছিল, তা এখন এক ধরনের স্থায়ী ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে। অনেক খামারি ও উদ্যোক্তা ফেসবুক পেজ, মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সরাসরি লাইভে ওয়েট দেখিয়ে ক্রেতার কাছে পশু বিক্রি করছেন। এতে মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকা কমছে, আর খামারিরা পাচ্ছেন ন্যায্য মূল্য।
তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ‘সেইফ কোরবানি’, ‘ডিজিটাল হাট ২০২৫’ সহ কিছু প্ল্যাটফর্ম ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে নিরাপদ লেনদেন নিশ্চিত করছে। এর ফলে নগরবাসীর মধ্যে অনলাইনে পশু কেনার প্রতি বেড়েছে আস্থা। এছাড়াও বিভিন্ন খামারিরা নিজস্ব অনলাইন পেইজ থেকে পশু বিক্রয় করছেন।         
চামড়া শিল্পের চ্যালেঞ্জ
প্রতি বছর কোরবানির সময় দেশে যে পরিমাণ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ হয়, তা সারা বছরের মোট চামড়া উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ। ২০২৫ সালেও দেশে প্রায় ১ কোটি পশু কোরবানির ফলে বিপুল পরিমাণ চামড়া সংগ্রহের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ শিল্প রয়েছে নানা সংকটে। নিম্নমূল্য, সংরক্ষণের সমস্যা, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে দক্ষতার ঘাটতি ও রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা চামড়া শিল্পকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় কোরবানির সময় চামড়ার দাম অনেক কমে যায়। বর্তমান সরকার কাঁচা চামড়ার সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করেছে, যাতে মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না করতে পারে। বাণিজ্য উপদেষ্টা  শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ১৫০ টাকা। এছাড়া খাসির চামড়ার ক্রয়মূল্য প্রতি বর্গফুট ২২ থেকে ২৭ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম ২০ থেকে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রায়ই চামড়ার অপচয় ঘটে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে এ খাত থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব। 
ঈদুল আজহার ভিন্নরূপ
ঈদুল আজহার আনন্দ পরিবার ভেদে হয় ভিন্ন। যখন শহরের ধনী পরিবারগুলো ভাবছে এবার পশু কিনতে বাজেট কত হবে। তখন গ্রামের অনেক দরিদ্র পরিবার হিসাব করছে কত টাকায় বিক্রি করলে লাভ হবে। অনেক সময় তারা লাভবান হয় আবার অনেক সময় চরম হতাশায় পরিণত হয় সবকিছু। তবে এই সংখ্যাটা হাতেগোনা। বহু হতদরিদ্র পরিবার সারা বছর খুব যত্নে পশু পালন করে এ সময়টার জন্য। সন্তানের মতো লালন-পালন করা পশুটি বিক্রি করে যে লাভ হয় তা দিয়ে সংসারের বড় কোনো প্রয়োজন মিটিয়ে নেয়। এজন্য এই ঈদ একেকজনের কাছে একেক রকম। আবার শহর থেকে অনেক মানুষ গ্রামে যায় ঈদ করতে। তারা পশু কোরবানি করে সকল দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেয়। এভাবেই ঈদের আনন্দ ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার মাঝে হয় ভাগাভাগি।
ঈদুল আজহা সামনে রেখে শহর ও গ্রামে কয়েক লাখ মানুষ অস্থায়ী কাজ পান। হাট বসানো, পশু পরিবহন, জবাই, মাংস কাটা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদিতে প্রচুর অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ হয়। অনেক দিনমজুর এবং নিম্নআয়ের মানুষ এই সময় অতিরিক্ত আয় করতে পারছেন, যা তাদের জীবনে খানিকটা স্বস্তি এনে দেয়। কোরবানিকেন্দ্রিক অর্থনীতি শুধু ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের বিষয় নয় বরং বৃহৎ অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। এতে কৃষক, খামারি, ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও প্রযুক্তি উদ্যোক্তা সবাই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত থাকেন। এটি একদিকে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। অন্যদিকে দেশীয় উৎপাদন ও রপ্তানিকে প্রভাবিত করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যদি এ খাতগুলোতে আরও স্বচ্ছতা, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সরকারি সমন্বয় বাড়ানো যায়, তবে কোরবানির অর্থনীতি হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি শক্তিশালী চালিকাশক্তি।

প্যানেল

×