ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

সংকটে চামড়া শিল্পনগরী

এম ফখরুল আলম

প্রকাশিত: ০০:৪১, ১০ মার্চ ২০২৪

সংকটে চামড়া শিল্পনগরী

সাভার চামড়া শিল্পনগরীকে একেবারে ধ্বংস

সাভার চামড়া শিল্পনগরীকে একেবারে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে খডএ কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট অর্জন করতেই হবে এর কোনো বিকল্প নেই। তবে এই শিল্পনগরীর বাইরে থাকা ৫টি ট্যানারির সবই পর্যায় ক্রমে কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে চট্টগ্রামের একটি রিফ লেদার এবং যশোরের দুটি, সাফ ট্যানারি ও সুপারেক্স লেদার, ঢাকার দুটি, এপেক্স ফুটওয়ার এবং এবিসি লেদার। এর মধ্যে ঢাকার দুটি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় কাঁচা চামড়া ব্যবহারের অনুমতি নেই। ফিনিশড চামড়া উৎপাদনের জন্য তাদের বিদেশী খডএ 
সার্টিফাইড ট্যানারি থেকে ওয়েট ব্লু চামড়া আমদানি করে নিতে হয়

সাভার চামড়া শিল্পনগরী স্থাপনের পরতে পরতে রয়েছে বিসিকের আনাড়িপনা, দায়িত্বহীনতা, অবহেলা আর সরকারি টাকার অপচয় প্রবণতা। মূল সমস্যা হচ্ছে প্রাচীন প্রযুক্তি ছেড়ে নতুন প্রযুক্তি অর্থাৎ ক্লিনার টেকনোলজি চামড়া প্রসেসিং কাজে ব্যবহার করে মোট দূষনের ৮০ শতাংশ কমিয়ে আনতে না পারা। আর এটা করতে যত বিলম্ব হবে খডএ এর কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট প্রাপ্তিতে ততই বিলম্ব ঘটে।

কারণ ক্লিনার টেকনোলজির উপর ভিত্তি করেই খডএ এর অডিট প্রটোকল তৈরি করা হয়েছে। চামড়া শিল্প উপদেষ্টা নিয়োগ না দেওয়ায় এই কাজটি সাভার শিল্প নগরীতে প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। ইতালি, ভারত ও চীনসহ সারা পৃথিবীর চামড়া প্রসেসিং কাজে অন্তত দশ বছর পূর্ব থেকে এই প্রযুক্তির ব্যবহার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে শুধু বাংলাদেশ ছাড়া। এই প্রযুক্তি ব্যবহারে সরকারি উদ্যোগ এবং বাধ্যবাধকতা থাকা দরকার যা অনেক দেশে দেখা যায়।

ট্যানারিতে এই ক্লিনার টেকনলোজি প্রয়োগের আওতা কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ থেকে শুরু করে লেদার ফিনিশিং পর্যন্ত বিস্তৃত। যেমন ক) ট্যানারি অভ্যন্তরে ছোট কোল্ড রুম স্থাপন করে চামড়া প্রতি খরচ কমানো। খ) প্রাচীন এবং হেভি দূষণমূলক হেয়ার বার্ন লাইমিংয়ের পরিবর্তে এনজাইমেটিক হেয়ার সেইভ প্রযুক্তির প্রবর্তন, যেখানে হেয়ার ফিল্টার মেশিন অত্যাবশ্যক। গ) ডিলাইমিং ও বেটিং কাজে অ্যামোনিয়াম লবণবিহীন এজেন্ট ব্যবহার।

ঘ) বহুল প্রচলিত পানিসহ ক্রোম ট্যানিংয়ের পরিবর্তে পানিবিহীন ক্রোম ট্যানিং প্রযুক্তির লাইসেন্স ক্রয় করতে হবে অথবা সকল ট্যানারিতে ক্রোম রিকোভারি প্লান্ট স্থাপন করতে হবে। ঙ) ব্যবহৃত সিনট্যান, ফ্যাটলিকার এবং ফাংগাছ নাশকসমূহ নির্দিষ্ট নিষিদ্ধ উপাদান মুক্ত হতে হবে। চ) প্রচলিত পাউডার ডাইজ ম্যাক অ্যামাইন মুক্ত হতে হবে। এই ডাইজের পরিবর্তে মাইক্রো গ্রায়ন্ডিং করা ইন্ক ডাইজ ব্যবহার করতে হবে যা শতভাগ চামড়ায় শোষিত হবে এবং নিঃসৃত ডাইং লিকারে কোনো রঙ থাকবে না।

ছ) পানিভিত্তিক লেদার ফিনিশিংসহ স্প্রে বুথের নিচে প্রবাহমান পানির সরবরাহ থাকতে হবে। এছাড়া লেদার ফিনিশিং কাজে স্প্রেইং সুবিধার পাশাপাশি রোলার কোটিং মেশিন ব্যবহার করতে হবে। সমগ্র কাজের জন্য সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে কমপক্ষে ২২০ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগ প্রয়োজন যা বিশ^ব্যাংকের পরিবেশ তহবিল থেকে ট্যানারিসমূহের জন্য লোন হিসেবে পাওয়া যেতে পারে।
সাভার চামড়া শিল্পনগরীকে একেবারে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে খডএ কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট অর্জন করতেই হবে এর কোনো বিকল্প নেই। তবে এই শিল্পনগরীর বাইরে থাকা ৫টি ট্যানারির সবই পর্যায় ক্রমে কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে চট্টগ্রামের একটি রিফ লেদার এবং যশোরের দুটি, সাফ ট্যানারি ও সুপারেক্স লেদার, ঢাকার দুটি, এপেক্স ফুটওয়ার এবং এবিসি লেদার। এর মধ্যে ঢাকার দুটি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় কাঁচা চামড়া ব্যবহারের অনুমতি নেই।

ফিনিশড চামড়া উৎপাদনের জন্য তাদের বিদেশী খডএ সার্টিফাইড ট্যানারি থেকে ওয়েট ব্লু চামড়া আমদানি করে নিতে হয়। অতি সম্প্রতি বে ট্যানারি এর চীনা জয়েন্ট ভেনচার পার্টনার শুধু লেদার ফিনিশিং পর্যায়ের জন্য যৌথ প্রতিষ্ঠা’ সিমোনা’ এর নামে  খডএ গোল্ড সার্টিফিকেট পেয়েছে। এখানে বিদেশ থেকে ক্রাস্ট চামড়া এনে তা ফিনিশিং করে প্রডাক্ট তৈরি করে রফতানি করা হচ্ছে। আসলে এটি হচ্ছে একটি  শুরুর উদ্যোগ যা ট্যানারিটির মোট দূষণের ২ শতাংশের বেশি হবে না।

পরবর্তীতে বে ট্যানারি এবং তাদের চীনা পার্র্টনার ক্রাস্ট এবং ওয়েট ব্লু চামড়া উৎপাদনের বাকি ৯৮ শতাংশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ইটিপি, ডাম্পিং ইয়ার্ড এবং ক্রাম ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছেন। সম্ভবত আগামী জুন মাসের কোরবানির পূর্বেই এই উদ্যোগ খডএ এর বাকি পর্যায়ের সার্টিফিকেট পেয়ে যাবে। এছাড়া এপেক্স ট্যানারিও ২০২৫ সালের মধ্যে স্বতন্ত্র ইটিপি, ক্রোম ব্যবস্থাপনা এবং ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণ শেষ করে ফেলবে। এপেক্স ট্যানারির ইটিপির ট্রিটমেন্ট ক্যাপাসিটি বেশ বড়।

সম্ভবত এপেক্স ফুটওয়্যারের জন্য ওয়েট ব্লু চামড়ার উৎপাদন সাভারেই হবে। আর তা হচ্ছে ১ দশমিক ২০ (গখউ) মিলিয়ন লিটার প্রতিদিন। এখানে সব মিলিয়ে এপেক্স ট্যানারি বিনিয়োগ করছে প্রায় ৩২ কোটি টাকা। অপরদিকে বে ট্যানারির ইটিপি এর ক্যাপাসিটি হচ্ছে ৭৫০ কখউ (কিলো লিটার প্রতিদিন ) এবং এখানে মোট বিনিয়োগ হচ্ছে প্রায় ১৬ কোটি টাকা। সাত বছর পূর্বে এই নির্মাণে অন্তত ২৫ শতাংশ কম খরচ হতে পারত এবং বিসিক আপত্তি করলে তা আদালতে টিকতো না।

বিসিকের ওপর ভরসা করে এপেক্স এবং বে ট্যানারির মতো অন্যান্য সকল ট্যানারি প্রতিষ্ঠানের রপ্তানির ক্ষতি এক বিলিয়ন ডলার বাদেই কমপক্ষে আরও এক হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। অতএব মোট সাতটি ট্যানারি খডএ সার্টিফাইড হয়ে গেলে তা দেশের মোট চামড়া প্রসেসিং ক্ষমতার ৫০ শতাংশ হতে পারে। বর্তমানে যে ৫টি ট্যানারি খডএ সনদ পেয়েছে, তাদের মধ্যে তিনটি এখন সস্তায় কাঁচা চামড়া ক্রয় করতে পারছে এবং রপ্তানিতে অবিশ^াস্য মুনাফা করতে সক্ষম।

বাদ-বাকি তিনটি বড় ট্যানারিসহ শতাধিক মাঝারি ও ছোট ট্যানারির জন্য সরকারকে ভাবতে হবে এবং সহায়তার হাত সম্প্রসারিত করে শত ভাগ চামড়া প্রসেসিং খডএ কমপ্লায়েন্স সনদের আওতায় যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে আসতে হবে। এসব ট্যানারি ব্যাংক থেকে কোনো দীর্ঘমেয়াদি লোন পাচ্ছে না। কারণ বিসিক শিল্পনগরীর কোনো ট্যানারিকেই জমি মিউটেশন করার অনুমতি দেয়নি। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে বিসিক কর্তৃক অসহযোগিতার একটি উদাহরণ। এছাড়া হাজারীবাগের ট্যানারিসমূহের আগের ব্যাংক বকেয়া লোন যথাবিহিত বহাল রয়েছে। সরকারি অবহেলায় রুগ্ন চামড়া শিল্পকে আরও রুগ্ন হতে হলো।
সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে সম্ভাব্য অডিট প্রস্তুতি:
সাভার চামড়া শিল্পনগরীর ট্যানারিসমূহের খডএ এর অডিট যোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রতিটি ট্যানারিতে চামড়া উৎপাদন কাজে ক্লিনার টেকনোলজি প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এজন্য সকল ট্যানারির পরিবেশগত অবকাঠামোগত উন্নয়নে শতাধিক হেয়ার ফিল্টার মেশিন ইতালি কিংবা চীন থেকে আমদানিকরণসহ ৩টি বড় ট্যানারির ইটিপি নির্মাণে যন্ত্রপাতির জন্য মোট ১২০ কোটি টাকার সম পরিমাণ মার্কিন ডলার এবং ১০০ কোটি টাকার স্থানীয় মুদ্রার যোগান দিতে হবে।

যা বিশ^ব্যাংকের পরিবেশ তহবিল (বাংলাদেশ ব্যাংকে দেওয়া আছে) থেকে নেওয়া সম্ভব। এই লোনের সার্ভিস চার্জের হার দশ বছরে পরিশোধ যোগ্য। তবে চামড়া উৎপাদন কাজে ক্লিনার টেকনোলজি প্রয়োগ ও অন্যান্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে নিচে উল্লেখিত বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ বিসিক অফিসের উত্তরে নদী তীরের খোলা প্রান্তরে নির্মাণ প্রয়োজন উপযুক্ত আয়তনের কয়েকটি ডাম্পিং ইয়ার্ড।

এই নির্মাণ ও বিনিয়োগ ছাড়া সাভার চামড়া শিল্পনগরীর ঘুরে দাঁড়ানোর অন্য কোনো উপায় নেই । সাভার চামড়া শিল্পনগরীর একটি উপযুক্ত স্থানে সকল ট্যানারির জন্য বৃহৎ পরিসরে এক বা একাধিক  ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণ করতে হবে। এছাড়াও সকল ট্যানারির অভ্যন্তরে খডএ নির্দেশিত প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করতে হবে। সাভারে বিসিক অফিসের উত্তর দিকে যে বিশাল খালি জায়গা রয়েছে সেখান থেকে দশ একর জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে এই কাজটি করা যেতে পারে।

কলকাতা চামড়া শিল্পনগরীতে (লেদার কমপ্লেক্স নামে পরিচিত) প্রতিদিন ১৬ টন সলিড বর্জ্য ডাম্পিং ক্ষমতার একটি ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণ করতে পাঁচ একর জমি এবং ভারতীয় রুপিতে ৩২ কোটি খরচ হয়েছে। সাভারে যেহেতু কয়েক বছরের সলিড বর্জ্য পাহাড় সম উঁচু করে রাখা আছে, তাই আনুমানিক ৫০ কোটি টাকায় দৈনিক ২০ টন ডাম্পিং ক্ষমতার একটি ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণ করা যাবে, যদি সেনাবাহিনীকে কাজটি দেওয়া হয়। সর্বমোট ৫টি বড় ট্যানারির ঈঊঞচ  কানেকশন অফ করে দিলে বর্তমানে চালু সব ট্যানারিসমূহের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। কোরবানি মৌসুমে শিল্প নগরীর রাস্তা ঘাট ট্যানারির তরল বর্জ্যে আর ডুবে যাবার ভয়ও থাকবে না।

×