ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সামনে এলো অজানা তথ্য

ব্রিটিশ তারবার্তায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

মোরসালিন মিজান 

প্রকাশিত: ২৩:৩৩, ৯ জানুয়ারি ২০২৩

ব্রিটিশ তারবার্তায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

ব্রিটিশ সরকারের অবমুক্ত করা তারবার্তায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেশে ফিরেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তি লাভ করেন তিনি। ৯ জানুয়ারি দেশের উদ্দেশে রওনা হন। ১০ জানুয়ারি, অর্থাৎ, আজকের দিনে ঢাকার মাটিতে পা রাখেন তিনি। ঐতিহাসিক পরিভ্রমণের নানা তথ্য বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সামনে এসেছে।

তবে বর্তমান সময়ের গবেষণা বিষয়টির ওপর নতুন করে আলো ফেলেছে। এ গবেষণার মূল সূত্র ১৯৭২ সালের ব্রিটিশ দলিল। দুর্লভ দলিল অনেক আগেই অবমুক্ত করা হয়েছিল। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশের সংগ্রহে আসে। ব্যক্তি উদ্যোগে সংগ্রহ করা তারবার্তা, চিঠি কূটনৈতিক যোগাযোগের জায়গা থেকে ইতিহাসটিকে তুলে ধরে। 
দুর্লভ তারবার্তা ও চিঠির সংগ্রাহক কবি তারিক সুজাত। ১০ জানুয়ারি রয়েল এয়ারফোর্সের যে কমেট বিমানে চড়ে মুজিব দেশে এসেছিলেন, সেটি প্রথমে খুঁজে বের করেন তিনি। পরে এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য পেতে সংগ্রহ করেন ব্রিটিশ দলিলগুলো। 
প্রাপ্ত নথিপত্রের অধিকাংশই তারবার্তা। তারবার্তা থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার প্রতিটি মুহূর্ত সে সময় পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। চলছিল ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আলোচনায় অন্য অনেক প্রসঙ্গ বারবার আলোচিত হলেও, ব্যস্ত কূটনীতির চমকপ্রদ ইতিহাস অজানা বা অস্পষ্ট রয়ে গিয়েছিল দীর্ঘকাল। এ পর্যায়ে এসে অনেক খুঁটিনাটি এবং নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

১৯৭২ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা ব্রিটিশ কূটনীতিকদের মধ্যে এসব তারবার্তা আদান প্রদান হয়। লন্ডন ঢাকা দিল্লি ইসলামাবাদ জাতিসংঘে ব্রিটেনের স্থায়ী প্রতিনিধি, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটনের দূতাবাসগুলো এবং সেসব  দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক মহল মুজিবের তথ্য সংগ্রহে নানা কারণে আগ্রহী হয়ে ওঠে। নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে তারা। 
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি সকাল ৯টা ১৫ মিনিট। ইসলামাবাদ থেকে লন্ডনে  জরুরি তারবার্তা পাঠান ব্রিটিশ হাইকমিশনার জন পাম্প্রে। ফরেন ও কমনওয়েলথ অফিসকে তিনি জানান, ৮ জানুয়ারি একটি স্পেশাল ফ্লাইটে মুজিব হিথ্রোতে অবতারণ করছেন।
এর প্রেক্ষিতে ব্রিটেনের সেক্রেটারি অফ স্টেট (ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অ্যাফেয়ার্স) ডগলাস হোম অল্পক্ষণের মধ্যে ফিরতি টেলিগ্রামে ইসলামাবাদ এবং ঢাকা, ইউকে মিস নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, দিল্লিকে এই তথ্য নিশ্চিত করেন। জানান,  মুজিবের লন্ডনে পৌঁছার খবরটি নিশ্চিত। তার সঙ্গে  কামাল হোসেন অ্যান্ড হোসেনের পরিবার রয়েছে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটি তার বার্তায় ডগলাস হোম ঢাকাস্থ ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার রে বিট্রেনকে  জানান, শেখ মুজিব সকালে হিথ্রোতে অবতরণ করেছেন। তিনি নিরাপদ এবং সুস্থ আছেন, এ খবর তার স্ত্রী এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীকে পৌঁছে দিতে বলেছেন। 
ঢাকার ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশন থেকে রে বিট্রেনকে ইসলামাবাদে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে নিশ্চিত হতে চান প্রাপ্ত সংবাদটি সঠিক কিনা। তারবার্তায় জোর দিয়ে এই তথ্য জানানো হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে দ্রুততম সময়ের ভেতর তথ্য জানতে চেয়েছেন। একইসংগে ব্রিটেন লন্ডনে ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসে এবং ইসলামাবাদে তারবার্তা প্রেরণ করেন। 
ডগলাস হোমের পাঠানো তারবার্তার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের কথাও  উল্লেখ করা হয় বার্তায়। এতে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যত দ্রুত সম্ভব শেখ মুজিবের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। এবং জানতে চেয়েছেন, তিনি কোথায় অবস্থান করছেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটি ফোন নম্বরও দেয়া হয় এতে। নম্বরটি ছিল ২৪৩৭৫২।
মুজিবের দেশে ফেরার আলোচনায় আলাদা গুরুত্ব পায় ঢাকার বিমানবন্দর। ডগলাস হোম একটি তারবার্তা পাঠান ঢাকার ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনে। এতে তিনি ঢাকা বিমানবন্দর ব্যবহারের কতটা উপযোগী তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেন। জানতে চান, ঢাকা বিমানবন্দর কমেট বিমান বা হাল্কা এয়ারক্রাফট নামার উপযোগী অবস্থায় আছে কিনা। রাতে এখানে বিমান নামতে পারবে? দিনে নামলে কোন সময়টা বেশি উপযুক্ত হবে?
উত্তরে ঢাকা থেকে ফিরতি তারবার্তায় জানানো হয়, বিমানবন্দরের ম্যানেজার জানিয়েছেন, ৫২০০ ফিট রানওয়ে ভালো আছে।

কমেট বিমান অবতরণের জন্য এ আয়তন যথেষ্ট কিনা সে বিষয়ে তার জানা নেই। তবে এই রানওয়েটি ডি সি- সিক্স বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে। এয়ারপোর্ট ল্যান্ডিং লাইট ঠিকমতো কাজ করছে না। ফলে ম্যানেজার রাতে অবতরণ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে সময় পেলে বিকল্প হিসেবে কিছু বাতির ব্যবস্থা করতে পারবেন তিনি। এ তারবার্তায় তথ্য দিয়ে বলা হয়, বিকেল ৫টা নাগাদ সন্ধ্যা হতে শুরু করে। শেষ আলো পাওয়া যায় ৫টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত। ভোর ৬টায় সূর্যোদয় হয়। 
পরবর্তী টেলিগ্রামে দেয়া হয় আরও কিছু তথ্য। লন্ডনের এফসিও এবং এমওডিতে পাঠানো বার্তায় ইতোপূর্বে দেয়া তথ্যের পাশাপাশি জানানো হয়, এইচএফ এবং ভিএইচএফ রেডিও, রানওয়ে লাইট, অ্যাপ্রোচ লাইট এবং নন ডিরেকশনাল বিকনসহ অন্যান্য সুবিধা বিদ্যমান আছে। বিমানবন্দরটি ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। জেট এয়ারক্রাফটের জন্য ফুয়েলের ব্যবস্থাও আছে। 
তারবার্তায় বলা হয়, বিমানবন্দরের ম্যানেজার আরও জানিয়েছেন, লাইভ ল্যান্ডিং সম্ভব নয়। হাজার ফিট দীর্ঘ রানওয়ের একটি বড় অংশ যুদ্ধকালীন সময়ে খুব খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি রাত্রিকালীন অবতরণকে নিরুৎসাহিত করছেন। 
বঙ্গবন্ধুর সংবাদ সম্মেলনের পর আরেকটি তারবার্তা পাঠান ডগলাস হোম। মুজিবের বক্তব্য থেকে বিভিন্ন বার্তা তাতে তুলে ধরা হয়। এতে কমেন্ট বিমানে করে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিষিয়টি আরও নিশ্চিত করা হয়। বিমানটি কখন কোথায় যাত্রা বিরতি করবে তার আনুমানিক সময়ও জানিয়ে দেয়া হয় এই তারবার্তায়। এতে দিল্লিতে দেড় ঘণ্টা যাত্রা বিরতির কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, রিফুয়েলিংয়ের জন্য এই বিরতি।

সে সময় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মুজিবের সাক্ষাতের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বলেও জানানো হয়। ব্রিটিশ তারবার্তা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, বাঙালি নেতার নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভাবছিলেন তারা। নিরাপত্তার কারণে ফ্লাইটের সময় গোপন রাখা হয়। আকাশ সীমা ব্যবহারের জন্য আনকাড়া ও তেহেরান কর্তৃপক্ষের কাছে ফ্লাইটটির বিষয়ে কূটনৈতিক ছাড়পত্র নেয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়। এই টেলিগ্রামে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

এতে বলা হয়, মুজিবের লন্ডনে আসাটা মূলত পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে সম্পন্ন হয়েছিল। এবং এ বিষয়ে পূর্ব বাহানে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা করা হয়নি। এখন আমরা তাকে সহায়তার জন্য যা কিছু করছি তার সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। স্বীকৃতির জন্য তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যেসব শর্ত বিদ্যমান থাকা প্রয়োজন এখনো তা সম্পূর্ণ হয়নি।
এদিকে ঢাকা থেকে প্রতি মুহূর্তে দেয়া হচ্ছিল বিমানবন্দরের আপডেট তথ্য। ৮ তারিখ আরেক তারবার্তায় বিট্রেন জানান, রানওয়েটি ১৫০ ফিট প্রশস্ত এবং পূর্বে বোয়িং ৭০৭ নিয়মিতভাবে এর রাজনীতি ব্যবহার করত টেক্সিওয়ে সেন্ট্রাল টেক্সিওয়ে খুব ভালো অবস্থায় আছে। টার্মিনাল ভবন পর্যন্ত বিষয়ে জানান ৪০০ ফুট কংক্রিটের আন্ডার শুট রয়েছে। কিন্তু কোনো ওভার শুট নেই। কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা নেই।

ঢাকা শহরের দক্ষিণ অভিমুখে রানওয়ের প্রবেশ মুখ বিমান অবতরণের সকল প্রকার সুবিধা বিদ্যমান। শুধু একটি বিষয়ে জানার আছে, কমেন্ট বিমান থেকে অবতরণের জন্য কি ধরনের সিঁড়ি প্রয়োজন? একই সঙ্গে এও জানানো হয় এয়ারক্রাফটে দায়িত্ব পালনরত সকলের জন্য থাকার ব্যবস্থা ও এয়ারক্রাফটের নিরাপত্তার ব্যবস্থা এখানে বিদ্যমান। 
এদিকে ইতোমধ্যে এফসিও থেকে ঢাকা ও দিল্লিতে পূর্বে প্রেরিত টেলিগ্রামের প্রেক্ষিতে ইরান আনকারা সাইপ্রাস এবং ওমান থেকে আকাশ সীমা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেইÑ এই মর্মে উত্তর আসা শুরু হয়ে যায়। 
৯ জানুয়ারি ঢাকা থেকে তারবার্তায় জানানো হয় আর এ এফ কমেট বিমানের জন্য সন্তোষজনক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এয়ারক্রাফট ক্রুদের ১৫ ঘণ্টা বিশ্রাম বা যদি প্রয়োজন অনুভূত হয় তা চেয়ে বেশি সময়ের জন্য থাকার সুবন্দোবস্ত আছে। শুধু একটি বিষয় এয়ারক্রাফটের নিরাপত্তার জন্য খানিকটা উদ্বেগের কারণ হতে পারে, সেটি হলো, বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য আগত বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থীদের ভিড়ের চাপ। 
এই তার বার্তায় আরও উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে ৫০০০ ফুটের ওপর রান হয়ে খুব ভালো আছে। এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ জানতে চেয়েছে যদি যাত্রীদের জন্য সিঁড়ির প্রয়োজন হয় তবে তার উচ্চতা কতটুকু প্রয়োজন হবে? 
এ প্রসঙ্গে নথি নিয়ে গবেষণা করা তারিক সুজাত আরও যোগ করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পাওয়ার পর অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এয়ারপোর্ট ও সিভিলিভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বিমানবন্দরের বাকি সব সুবিধা বর্ধিত করেছিল। তিনি জানান, তেজগাঁয়ের রানওয়ের মূল জায়গা ছিল ৯ হাজার ফিট। যুদ্ধে নষ্ট হয়েছিল ৪ হাজার ফিট। কমেট বিমান অবতরণের জন্য প্রয়োজন ছিল ৫ হাজার ২০০ ফিট। কিন্তু প্রস্তুত করা হয়েছিল ৫ হাজার ৬০০ ফিট। 
সব নিশ্চিত হলে ব্রিটেন থেকে তারবার্তায় নিশ্চিত করে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনের স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৪৮ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তারবার্তাটি একইসঙ্গে ৩৯ স্থানে পাঠানো হয়। 
এভাবে পৃথিবীর নানা দেশ কূটনৈতিক জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মুহূর্ত পর্যবেক্ষণ করছিল। 

×