ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ ও রাষ্ট্রদ্রোহী হেফাজত

প্রকাশিত: ২১:০৬, ২৭ মে ২০২১

‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ ও রাষ্ট্রদ্রোহী হেফাজত

অনেক অপরাধ করেছে হেফাজতে ইসলাম নামক এন্টি-ইসলামী সংগঠন। বিগত এগারো বছর সন্ত্রাস ও তা-ব চালিয়েছে তারা। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি আহমদ শফীর নেতৃত্বে সরকারের নারী নীতির বিরোধিতার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হেফাজতের। ২০১৩ সালের ৫ মে থেকে শুরু করে অদ্যাবধি সংগঠনটির কার্যকলাপ একদিকে যেমন ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বলে বিবেচিত হতে পারে, তেমনি আমাদের দেশীয় আইনে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ বলেও গণ্য হতে পারে। এ সমস্ত সন্ত্রাস-তাণ্ডবে অংশগ্রহণকারীরা কওমি মাদ্রাসার ছাত্র হোক বা শিক্ষক হোক বা অন্য যে-ই হোক, এককভাবে এবং সমষ্টিগতভাবে এসব অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হতে পারে। পাশাপাশি পবিত্র কোরানের লঙ্ঘনকারী হিসেবে ইসলামী আইনেও বিচারের আওতায় আসার ও শাস্তি পাওয়ার হকদার হয়ে গেছে সংগঠনটি। কারণ ইসলামের নামে অপকর্ম চালানো হেফাজত কখনই ইসলামী কাজ করেনি। ইসলাম কখনই রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা করা সমর্থন করে না। গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধও করেছে হেফাজতে ইসলাম নামক বাংলাদেশের ইসলামবিরোধী সংগঠনটি। ২০১০ সালে লাইমলাইটে আসার মাত্র তিন বছর পর ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে কয়েক লাখ মাদ্রাসা ছাত্র ও শিক্ষকের সমাবেশ করার মধ্য দিয়ে হেফাজতে ইসলামের নবউত্থান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগ চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন তাকে প্রতিরোধ করার মানসে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নসহ ১৩ দফা দাবির ছলনায় শাপলা চত্বরে হাজির হয় হেফাজত। উদ্দেশ্য ছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারা। একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ করা, অন্যদিকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে চলমান মহাজোট সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করা। পাশের বাংলাদেশ ব্যাংক লুট করতে পারলেই সরকারের পতন হয়ে যাবে- সম্ভবত এমন ধারনার বশবর্তী হয়ে এখানে জঙ্গী জমায়েত করে তারা। নেতৃত্ব দেন শাহ আহমদ শফী, বাবুনগরী, মামুনুলসহ অসৎ নেতৃবৃন্দ। তারা মঞ্চে বসে মুহুর্মুহু ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী স্লোগানে জঙ্গী-জজবা তুলে চাঙ্গা করতে থাকে অবুঝ ও নাবালেগ ছাত্রদের মন ও মাথা। আগে থেকেই মগজ ধোলাই করে নিয়ে আসা হয় তাদের। এখানে এসে আরও ব্রেন-স্টর্ম করে জঙ্গী-জিহাদে ঝাঁপ দিতে ও প্রাণোৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয় তাদের। স্বপ্ন দেখানো হয় মরলে শহীদ হয়ে বেহেস্তে গিয়ে হুরপ্রাপ্তি, বাঁচলে গাজী হয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ। কোমলমতি শিশুদের দেখানো এই স্বপ্ন ছিল মিথ্যা। কারণ ৯০% মুসলিমের এই দেশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হেফাজতীদের লড়াই কোন জিহাদ হতে পারে না। আসলে কোরান-হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে শিশুদের মনকে উতলা করে হেফাজত নেতাদের রাষ্ট্রীয় গদি লাভের বড়ই সাধ জেগেছিল সেদিন। দুঃখজনক হলেও হেফাজতের এই অপকর্মে ইন্ধন জোগায় বিএনপি, জামায়াত, এমনকি জাতীয় পার্টি। সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্য বর্তমান কারাবন্দী মামুনুলের রিমান্ডে দেয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, সরকারের রূপরেখাও তৈরি করেছিল তারা সেদিন। আহমদ শফী রাষ্ট্রপতি, জুনায়েদ বাবুনগরী প্রধানমন্ত্রী, মামুনুল মন্ত্রী, এরকম কত শত প্ল্যান-পরিকল্পনা। এর ঠিক পূর্বে জুনায়েদ বাবুনগরী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং আন্দোলনে সহায়তার আশ্বাস পান। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতা ছাড়ার জন্য ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন ২০০৮-এর জাতীয় নির্বাচনে ভূ-ধস মেজরিটিপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। জামায়াত ও জাতীয় পার্টি থেকেও এই আল্টিমেটামকে সমর্থন জানানো হয়। মানি-পানি-বিরিয়ানি তথা সম্পূর্ণ রসদ জোগান দেয় জামায়াত-বিএনপি-জাতীয় পার্টি। তারা ভুলেই গিয়েছিল ১৯৭১ সালে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালীকে পাকিস্তানী জান্তারা রাইফেল-বোমা-বেয়নেট দিয়েও দমাতে পারেনি কিংবা কাবু করতে পারেনি। এ-ও ভুলে গিয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের তর্জনীর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, নয় মাস যুদ্ধ করে বাংলা মায়ের স্বাধীনতা সূর্য ছিনিয়ে আনতে পারে যে বাঙালী এখন ১৮ কোটি, তাদেরকে ওই দুগ্ধপোষ্য লাখ দুয়েক শিশু দিয়ে কিছুই করা যাবে না। তারা ভাবতেই পারেনি নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে ওই কয়েকজন ইসলামবিরোধী হেফাজত নেতা যদি গদিচ্যুত করে তাহলে আপামর বাঙালী চুপ করে বসে থাকবে না। হলোও তাই। তাৎক্ষণিক যথাব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম বাংলাদেশ পুলিশ-বিজিবি-র‌্যাবের ‘অপারেশন শাপলার’ শব্দ-গ্রেনেড নামক কৌশলেই পলায়ন করে তারা। রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর কোনরকম হস্তক্ষেপের প্রয়োজনই হয়নি। অমিততেজী ১৮ কোটি বীর বাঙালীর প্রতিরোধযুদ্ধেরও প্রয়োজন হয়নি। রাতের আঁধারে পালিয়ে আর পিছু হটে পিঠ বাঁচিয়েছিল এই গদিলোভী জঙ্গীগোষ্ঠী, যাদের পেছনের মদদদাতা ছিল জামায়াত-বিএনপি। আইনের ভাষায় ১৮৬০ সালের প্যানেল কোডের ৩৪ ধারা মোতাবেক ‘কমন ইন্টেনসন’ ছিল এদের সবার। এরপর দেশে হেফাজতীরা ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে কয়েক বছর ধরে উগ্রতা প্রচার করে, সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রচার করে, সরকারের প্রতি আনুগত্যহীনতা প্রচার করে। সাড়ে সাত বছর পর ৫ ডিসেম্বর ২০২০ কুষ্টিয়ার পাঁচ রাস্তার মোড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাংচুর করে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন এই হেফাজত। কদিন পরেই কুষ্টিয়ার অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী বাঘা যতীনের ভাস্কর্যও ভাংচুর করে তারা। সেইসঙ্গে হেফাজত নেতা মামুনুল হক হুঙ্কার ছাড়েন, ঢাকার ধোলাইপাড় মোড়ে বন্ধুরাষ্ট্র চীনের সহায়তায় যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ হওয়ার কথা তা ভেঙ্গে-গুঁড়িয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে নিক্ষেপ করা হবে। তিনি ইসলামী জলসার ওয়াজের মধ্যে নির্দেশ দেন প্রখ্যাত চিন্তাবিদ-লেখক শাহরিয়ার কবির, স্বাধীনতা সংগ্রামী রাশেদ খান মেনন প্রমুখকে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই জুতাপেটা করার। যাতে ‘ঠিক ঠিক’ বলে সমর্থন জানায় তার অনুসারীরা। এরপর এ বছর ১৭ মার্চ যেদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস পালিত হচ্ছিল সেদিন সুনামগঞ্জ জেলার সাল্লার হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে আক্রমণ চালায় মামুনুলের ভাবপুষ্ট ও তার ওয়াজ-মাহফিলের বক্তব্যে পথভ্রষ্ট ও প্ররোচিত হেফাজত কর্মীরা। ৮৮টি হিন্দু বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে ও ভাংচুর চালায় তারা। ৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার গায়ে হাত তোলে ও তাদের লাঞ্ছিত করে হেফাজতীরা। ভেবে নেয় হিন্দুদের মারধর ও নির্যাতন করলে বাঙালী মুসলিমরা বাহবা দেবে। কিন্তু তারা এবারও ভুলে গিয়েছিল যে, ছিয়ানব্বই থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় বাঙালী মুসলমান এখন অনেক বেশি রাজনীতিসচেতন, অনেক বেশি সংবিধান ও আইন জানা, অনেক বেশি আইন মান্যকারী। আরও ভুলে গিয়েছিল যে, এই জনগণের আবেদন-আগ্রহেই ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে বাহাত্তরের মতো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নামক বিধান সংযোজন করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। আর ধর্মনিরপেক্ষতার বিধান বাস্তবায়নের জন্য সরকার সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদের অধীন ‘সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা’ বিলোপ করতে, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার’ বিলোপ করতে ও তদুদ্দেশ্যে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করতে বদ্ধপরিকর। এরপর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি ও মুজিববর্ষের চূড়ান্ত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকালীন অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত হয়েছিলেন। সেদিন শুক্রবার ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে হেফাজত নেতারা হুঙ্কার ছাড়ে সরকারের বিরুদ্ধে, তা-ব চালায় ঢাকায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে। মামুনুলের রিমান্ডে তথ্য বেরিয়ে আসছে সেদিন চট্টগ্রামের হাটহাজারী পুলিশ স্টেশনে আক্রমণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে হত্যারও প্ল্যান ছিল তাদের। পুলিশের বুদ্ধিমত্তা ও সতর্ক অবস্থানের দরুন ভেস্তে যায় হেফাজতের এই নীলনকশা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেল স্টেশনে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করতে, এমনকি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি শাবল দিয়ে ভাংচুর করতেও পিছপা হয়নি এরা। মূলত মোদির এ রাষ্ট্রীয় সফরের বিরোধিতা ও প্রতিবাদের জন্য এই তা-ব ছিল তাদের। ২০১৩ সালের সন্ত্রাসী কর্মের জন্য ঢাকায় ৫৩টি মামলা চলমান। এবারের ২৬ মার্চের দোকানপাট, সরকারী-বেসরকারী স্থাপনা ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৪২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় হেফাজতের প্রায় ৯০০ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হেফাজত ও সহযোগীদের এ সমস্ত ঘটনা বিবেচনায় আনলে প্রতীয়মান হয় যে, বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধকর্ম সংঘটন করেছে হেফাজত, কয়েকটি আইনের বিধানও লঙ্ঘন করেছে তারা। সরকারের সুদৃঢ় পদক্ষেপ এক্ষেত্রে অটুট থাকা আবশ্যক। হেফাজত কর্মীরা সন্ত্রাস-তা-ব মোটা দাগের যে কয়েকটি অপরাধ ঘটিয়েছে সেগুলো এরকম- প্রথমত, হেফাজতীরা ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রতীক’ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য আক্রমণ করে ভাংচুর করেছে। এই জাতীয়তাবাদের প্রতীক আক্রান্ত হয়েছে মানেই সংবিধানের ৬ ও ৯ অনুচ্ছেদ আক্রান্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাংচুরের মাধ্যমে সংবিধানের ওই দুটি অনুচ্ছেদের (বা বাঙালী জাতীয়তাবাদের) বিধানের প্রতি জনগণের আস্থা, বিশ্বাস ও প্রত্যয় (confidence, belief or reliance) পরাহত (subverted) করা হয়েছে বা তার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে ভাস্কর্য ভাংচুরের কর্মটি সংবিধানের ৭ক(১)(খ) অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয়ে গেছে। ১৮৬০ সালের প্যানেল কোডের ১২৪ক ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রদ্রোহ হলো আইনানুযায়ী প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি কথা, কর্ম, লেখা, চিহ্ন বা প্রতীক দ্বারা ঘৃণা, বিদ্বেষ বা বৈরিতা সৃষ্টি করা বা সৃষ্টির চেষ্টা করা। সংবিধান মোতাবেক এর শাস্তি দণ্ড বিষয়ক আইনে বর্ণিত সর্বোচ্চ সাজা। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক অপরাধও ঘটিয়েছে হেফাজতের সন্ত্রাস ও তা-ব। সুনামগঞ্জের সাল্লায় হিন্দু গ্রামে আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগ এরকম আন্তর্জাতিক অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে। ১৯৭৩ সালের আইসিটি [International Crimes (Tribunals) Act No. XIX of 1973] আইনের ৩ ধারা মোতাবেক প্রধানত চার প্রকার অপরাধ বাংলাদেশে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত যথা- মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তিবিরোধী অপরাধ, জেনোসাইড বা গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধ। এর মধ্যে দুটি যথা মানবতাবিরোধী ও জেনোসাইড অপরাধ ঘটিয়েছে হেফাজতীরা। ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দু বেসামরিক লোকদের উপর টর্চার, রেইপ বা অন্যান্য অমানবিক (ইনহিউমেন) আচরণ করাটি ওই আইনের ৩(২)(ক) ধারা মোতাবেক মানবতাবিরোধী অপরাধ। আবার হিন্দু ধর্মীয় জনসমষ্টির সদস্যদের ওপর মারাত্মক শারীরিক বা মানসিক ক্ষতিসাধন করাটি ৩(২)(গ)(রর) ধারা মোতাবেক জেনোসাইড। তৃতীয়ত, উপর্যুক্ত অপরাধে সরাসরি জড়িতদের সঙ্গে দূরবর্তীভাবে যারা জড়িত তাদেরও ‘কমন ইন্টেনসনের’ জন্য একই শাস্তি হতে পারে। প্যানেল কোডের ৩৪ ও ১২০ক ধারা এবং সাক্ষ্য আইনের ১০ ধারা তা-ই বলে। সুতরাং শুধু দাবা বোর্ডের হাতি-ঘোড়া-বোড়ে নয়, পেছনের মাস্টার বা গ্র্যান্ড মাস্টাররূপী বিএনপি-জামায়াতের যে হাত হাতি-ঘোড়া চালছে সে হাতও এক্ষেত্রে আইনের আওতায় আসতে পারে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফকরুল মামুনুলের মুক্তি দাবি করায় আলোচ্য কর্মগুলোতে বিএনপির লোকজনের সংশ্লিষ্টতা থাকার আভাস পাওয়া যায় বৈকি। বস্তুত, হেফাজতীদের বহু লাই দেয়াটা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। এদের আবদার মোতাবেক পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাস পরিবর্তন করার ফলে দেশের সুস্থ ও উৎপাদনমুখী রাজনৈতিক ধারা ও শিক্ষা ব্যবস্থা বহু পিছিয়ে গেছে। সাধারণ ধারার শিক্ষা ব্যবস্থাকে তাদের কথায় ব্যাক-ফুটে আর নেয়ার সুযোগ বোধ হয় নেই, বরং যেটুকু নেয়া হয়েছে সেটুকু বাতিল করে পূর্বাবস্থায় নেয়া প্রয়োজন। সাধারণ ধারার শিক্ষাবিদদের কথায় তো কওমি ধারার কোন পরিবর্তন করা হয়নি। তাহলে তাদের কথায় সাধারণ ও উৎপাদনমুখী ধারা পরিবর্তনটা না করলেও চলত। সরল ও ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ধর্মীয় আবেগ ও কষ্টার্জিত টাকার দান-খয়রাতে পুষ্ট হয়ে এরা ওই মুসলিমদের সন্তানদের কওমি মাদ্রাসা নামক কয়েদখানায় পুরে জ্ঞানের সূর্যালোক থেকে বঞ্চিত রাখে। আধুনিক পৃথিবীর কোন আলো-বাতাস, সংবাদপত্র-অগ্রগতির খবর কোন কিছুই আসতে দেয় না কোমলমতি শিশুদের নিকট। শিশুরা যেন একেকটি কুয়োর ব্যাঙের মতো বেড়ে ওঠে। মাদ্রাসার চার দেয়ালই তাদের পৃথিবী। মাদ্রাসার লাঠিওয়ালা পিটানদার শিক্ষকরাই যেন পৃথিবীর সর্বজ্ঞানের অধিকারী, যারা শিক্ষার্থীদের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে দেয় না, বাঙালী জাতীয়তা কী বা জাতির পিতা কে, কিছুই শিখতে দেয় না। বরং তাদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ শেখায়, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যহীনতা শেখায়, বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টানদের প্রতি বৈরিতা ও বিদ্বেষ শেখায়। অথচ পবিত্র কোরানের ১০৯ নম্বর সুরা কাফিরুনের ৬ নম্বর বাক্যের অমর বাণী ‘লাকুম দ্বীনুকুম অলিয়াদ্বীন’ (আমার ধর্ম আমার কাছে, তোমার ধর্ম তোমার কাছে) শেখায় না। সুতরাং এদের ব্যাপারে সরকারের বর্তমান কঠোর অবস্থান আরও দৃঢ় ও অনমনীয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক ডিন, আইন অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া এবং সদস্য, কেন্দ্রীয় পরিচালনা বোর্ড, বঙ্গবন্ধু পরিষদ
×