ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

ওরা এখন সেই রাজাকার আল-বদরের ভূমিকায় খুন-খারাবিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভীতিকর পরিবেশ

জান্তার দোসর আরসা ॥ প্রত্যাবাসন ঠেকাতে মিয়ানমারের নয়া কৌশল

প্রকাশিত: ২৩:১২, ২৭ অক্টোবর ২০২১

জান্তার দোসর আরসা ॥ প্রত্যাবাসন ঠেকাতে মিয়ানমারের নয়া কৌশল

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ॥ মিয়ানমারে সীমাহীন নির্যাতিত, বঞ্চিত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যানারে জন্ম নেয়া আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) বা আল-ইয়াকিন এখন সেই রাজাকার আল-বদরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির দোসররা রাজাকার আল-বদর আল-শামস বাহিনী গঠন করে যেভাবে পাক সেনাবাহিনীকে মদদ জুগিয়েছে, বাঙালীদের হত্যা ও নির্যাতনে সহযোগিতা দিয়েছে ঠিক অনুরূপ পরিস্থিতি এখন মগের মুল্লুকের দেশখ্যাত মিয়ানমারে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের পক্ষ হয়ে লড়াই করে আসা সেই আরসা এখন তাদের পক্ষে পরোক্ষভাবে বন্ধুত্বের হাত মিলিয়েছে। যা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতিত নিপীড়িত, ধর্ষিত, জ¦ালাও পোড়াওয়ে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং স্বজন হারানো এপার ও ওপারের সাধারণ রোহিঙ্গাদের জন্য বিস্ময়কর ঘটনা। আরসা এখন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দালাল।স্থানীয় ভাষায় তাদেরকে তাব্যে বলা হয়। অনেকের বিশ^াসে না এলেও কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার পথ বেছে নিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। একদিকে সেনা বর্বরতার বদনাম ঘুচানো, অন্যদিকে রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গাশূন্য করতে পূর্ব প্রণীত নীলনক্সা থেকে তারা একচুলও নড়েনি। আশ্রয় শিবিরে সহিংসতা এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে থাকার বিষয়টি তাই প্রমাণ করছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের সর্বশেষ যে গোপন পরিকল্পনা হয়েছে তাতে এ তথ্য মিলেছে। সীমান্তের এপার ও ওপারের বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে অতীতে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইকারী আরসা বা আল-ইয়াকিন নামের সংগঠনটি সে দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করেছে। বর্তমানে এ সংগঠনটি রোহিঙ্গাবিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত রয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে এদের সমঝোতা হয়েছে। সমঝোতায় রয়েছে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ওপর দমন নিপীড়ন চালানো। প্রত্যাবাসন হতে ইচ্ছুকদের রুখে দেয়া। সব মিলিয়ে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে রেখে দেয়ার যাবতীয় অপতৎপরতা। আরসার অস্ত্রধারী সদস্যরা বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে হত্যা, গুম, সংঘর্ষসহ বিভিন্ন ধরনের হানাহানির ঘটনা ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছে। প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকবে। এর ফলে যারাই প্রত্যাবাসনের পক্ষে সরব হবে তাদের দমন করা হবে। মুহিবুল্লাহর পর এর মধ্যে আরও ৬ মাদ্রাসা শিক্ষক ও ছাত্রকে হত্যার ঘটনা এর জ¦লন্ত উদাহরণ হিসেবে উঠে এসেছে। কেননা নিহতরা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে তৎপর ছিলেন। এছাড়া আরও বহু রোহিঙ্গা রয়েছে যারা নিজ নিজ ভিটেমাটিতে ফিরে যেতে উন্মুখ। এদিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বাংলাদেশ জোর তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। কয়েক বছর ধরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি বারবার তুলে ধরছেন। বিশ^ সম্প্রদায়ের জোর সহায়তা কামনা করছেন। মিয়ানমারে সেফ জোন সৃষ্টি করে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। বিশ^ জনমতও বাংলাদেশের বক্তব্যের পক্ষে জোরালো হচ্ছে। মানবিকতাও বাড়ছে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রতি। ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার বড় ধরনের চাপের মুখোমুখি হতে পারেÑ এমন আশঙ্কায় সে দেশের সেনাবাহিনী আরসার সঙ্গে আঁতাত করে তাদের বশে নিয়েছে এবং ফিরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের দমনে তৎপরতা শুরু করেছে। এ ঘটনা একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আল-বদরদের তৎপরতাকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। সূত্রে জানা গেছে, সীমান্তের ওপারে জিরো পয়েন্টে প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গার অবস্থান রয়েছে। এরা মিয়ানমার এলাকা ছেড়ে এদেশে না এসে সীমান্ত সংলগ্ন জিরো পয়েন্টের কোনার পাড়ায় ক্যাম্প গেঁড়েছে। এই ক্যাম্পেই আরসার শীর্ষ পর্যায়ের অস্ত্রধারীদের অবস্থান রয়েছে। যেখানে আরসার শীর্ষ নেতা আতা উল্লাহ আবু আম্মর জুনুনিও রয়েছে বলে খবর চাউর হয়ে আছে। তবে জুনুনি জীবিত না মৃত, না বিদেশে এসব বিষয় ও তার নেতৃত্বাধীন আরসার কার্যক্রম রহস্যে ঘেরা। এই আরসা আবার দুগ্রুপে বিভক্ত। কোনারপাড়া ক্যাম্পটি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার অভ্যন্তরে জিরো পয়েন্টে। এপার থেকে এটি প্রায় দেড়শ গজ দূরে। যদিও বছর খানেক আগে এ জুনুনিকে নিয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রচার হয়। কোন সূত্র প্রচার করেছে জুনুনি মিয়ানমারে সেনা অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে। আবার অন্য সূত্র বলেছে, জুনুনি মধ্যপ্রাচ্যের কোন একটি দেশে পালিয়ে গেছে। এখন বলা হচ্ছে, জুনুনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে মালয়েশিয়া হয়ে বাংলাদেশে এসে সীমান্ত পার হয়ে এই কোনার পাড়া ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছে। কাজ করছে মিয়ানমার সেনাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী। যা রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে। এদিকে বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, কোনারপাড়া ক্যাম্পে আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের সমস্ত খাদ্য সামগ্রী বা রসদপত্র যায় সীমান্তের এপার অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার মাধ্যমে। আর কোনারপাড়া ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা অবাধে যখন ইচ্ছা এপারে আসা-যাওয়াও করে থাকে। নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ এবং অতিসম্প্রতি ৬ মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্রকে আরসা ক্যাডার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যার পর আশ্রিত রোহিঙ্গারা অজানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে। আরসার সশস্ত্র ক্যাডাররা ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘটনা ঘটিয়ে কখনও কোনারপাড়া ক্যাম্প, আবার কখনও এর অদূরে গহীন জঙ্গলে অবস্থান নিয়ে থাকছে। জঙ্গলে রয়েছে এদের সবচেয়ে বড় ক্যাম্প। রয়েছে অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুদ। সে দেশের সেনাবাহিনী এখন রোহিঙ্গাদের দমনে এবং প্রত্যাবাসনের পথ থেকে দূরে রাখতে আরসাকে ব্যবহার করছে। কেননা ইতোপূর্বে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সেনা অভিযান বিশ^ব্যাপী নিন্দা ও ব্যাপক সমালোচনা কুড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতে হয়েছে মামলা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর শীর্ষ কয়েক জেনারেল যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েক দেশে নিষিদ্ধ হয়েছেন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৩৪ রোহিঙ্গা শিবির ঘিরে ১৪ সন্ত্রাসী গ্রুপের তৎপরতা রয়েছে। এর মধ্যে বড় গ্রুপটি হচ্ছে আরসা বা আল-ইয়াকিন। ক্যাম্পে অবস্থানরত সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে এরা চাঁদা আদায় করে থাকে। এছাড়া অস্ত্রের চোরাচালান, মাদক ও মানব পাচারের সঙ্গে এই ১৪ সন্ত্রাসী গ্রুপের ক্যাডার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এদের আয়ের মূল উৎসব এসব অপকর্ম থেকে। ১৪ সন্ত্রাসী গ্রুপের ক্যাডার বাহিনী দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। যে কারণে ৩৪ আশ্রয় ক্যাম্পের পরিবেশ ভারী হয়ে যাচ্ছে। ১৪ সন্ত্রাসী গ্রুপ ॥ ১৪ সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে হরাকাহ আল-ইয়াকিন বা আরসা। এর প্রধান হচ্ছে আতা উল্লাহ আবু আম্মর জুনুনি, আরসার আরেকটি গ্রুপ রয়েছে। এর প্রধান হচ্ছে মুন্না, এরপরে রয়েছে আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন), ইত্তোহাদুত তুল্লাবুল মুসলিমিন (আইটিএম)। এর প্রধান হচ্ছে ঈসা সাঈদী, আরাকান ইসলামিক জমিয়া, যার প্রধান মাওলানা নছরুল্লাহ, ইসলামী মাহাদ (এর সাবেক নাম হরকাতুল জিহাদ ইসলামী বুরমা)। এর প্রধান হচ্ছে মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, হাশিম গ্রুপ, লাদেন গ্রুপ, পুঁতিয়া গ্রুপ, জমিয়তুল মুজাহিদিন আরাকান সাহেল। এর প্রধান হানিফ রাগেব, আরাকান ইসলামী ফ্রিডম পার্টি। এর প্রধান হাফেজ মাওলানা নুর হোসাইন, সোসাইটি ফর আরাকান জিহাদ। এর প্রধান হচ্ছে হাফেজ সালাহুল ইসলাম, ফয়েজিয়া ফাউন্ডেশন। এর প্রধান মৌলবী ইদ্রিস জিহাদী এবং ইসলামী মাহাত। এর নির্বাহী প্রধান হচ্ছে শায়খ সালামত। এসব সংগঠনের অস্ত্রধারী কারও কারও বাংলাদেশী এনআইডিও রয়েছে। এরা নিজেদের বাংলাদেশী দাবি করে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে স্থায়ী বসতিও রয়েছে। আরসা কি ও নেপথ্যে কারা ॥ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা এখন এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। সংগঠনটির আরবি নাম ‘আল-ইয়াকিন।’ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠীর সঙ্গে গভীর যোগাযোগের অভিযোগ রয়েছে আল-ইয়াকিন তথা আরসার বিরুদ্ধে। এই ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী গ্রুপের প্রধান হচ্ছে হাফেজ আতা উল্লাহ আবু আম্মর জুনুনি। নেপথ্যের পরিচালক হচ্ছে দেশ-বিদেশে ঘাপটি মেরে থাকা ধনাঢ্য রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী ও প্রবাসী। তবে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, আরসার সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে আঁতাত সৃষ্টির বিষয়টি। রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টিতে যেমন আরসার ভূমিকা রয়েছে, তেমনি মিয়ানমারের ইশারায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার পেছনেও তারা ভূমিকায় রয়েছে। আরসার তথাকথিত হামলার অভিযোগ করেই ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে বর্বর অভিযান চালিয়ে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ ঠেলে দিয়েছে। ঠিক তেমনি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে জোরালো ভূমিকা রাখায় মুহিবুল্লাহকে হত্যা করানো হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রত্যাবাসনবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি, ভাসানচরে যাবার বিরোধিতা করা, রোহিঙ্গাদের দিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দাবি করানো, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক এনজিও ও দাতা সংস্থার ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করা প্রভৃতি বিষয়ে আরসার ভূমিকা রয়েছে অগ্রভাগে। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেকটা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে কায়েম করতে তৎপর আরসা। বাংলাদেশে আশ্রিত হলেও কার্যত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ তাদেরই হাতে নিতে তৎপর। যদিও সম্প্রতি দিনের মতো রাতের বেলায়ও ক্যাম্পে টহল দিচ্ছে এপিবিএন সদস্যরা। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এরপরও চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা, নেতৃত্ব, ক্যাম্পের সব কিছুই আরসার নিয়ন্ত্রণে। এছাড়াও মানব পাচার, মাদক পাচার, এপার-ওপার যোগাযোগ, নারী পাচার ও ধর্ষণ, স্থানীয় বাঙালী বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি ও স্থানীয়দের ওপর নির্যাতন সবকিছুতেই আরসার হাত রয়েছে। ক্যাম্পের প্রায় সকল হেড মাঝি তারা নিয়োগ দিয়ে থাকে। প্রত্যেক হেডমাঝি থেকে প্রতিমাসে চাঁদা দিতে হয় আরসা ক্যাডারদের। রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশ থাকলেও, বাংলাদেশের সহায়তায় দুমুঠো খেতে পারলেও এই রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর যুবকদের (আরসা) মূল চাবিকাঠি এখন মিয়ানমারের হাতে। মিয়ানমার সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে গভীর যোগাযোগের রয়েছে তাদের। মিয়ানমার মোবাইল কোম্পানি এমটিপির সিম ব্যবহার করে ক্যাম্পে বসেই তারা সব ধরনের যোগাযোগ করে মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে। এছাড়াও আল-ইয়াকিন নাম ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের আঙুলের ইশারায় পরিচালিত হয় এই আরসা। এই আরসাতে বহু নারী ক্যাডারও রয়েছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই প্রমাণ করতে চাইছে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ, কাজেই এ ব্যাপারে তাদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ক্রীড়ানক হিসেবে কাজ করছে আরসা। এদিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ ও শুক্রবার ছয় খুনে জড়িত সশস্ত্র ক্যাডার আবদুর রহিমসহ হোতারা কোনারপাড়া ক্যাম্পে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। প্রশাসন ওই সন্ত্রাসীদের ধরতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তারা কোনারপাড়া ক্যাম্প ও মিয়ানমারের গহীন জঙ্গলে আত্মগোপনে থাকায় তাদের সহজে পাকড়াও করা যাচ্ছে না। সূত্র জানায়, একাধিক হত্যাকা-ের পর ক্যাম্পে ধরপাকড় শুরু হলে আরসা ক্যাডার আবদুর রহিম ও মোরশেদসহ কয়েকজন সন্ত্রাসী জিরো পয়েন্টের ক্যাম্পে আত্মগোপনে চলে যায়। ওই ক্যাম্পটি মিয়ানমার অভ্যন্তরে হওয়ায় প্রশাসনের পক্ষে সেখানে গিয়ে অভিযান চালানো সম্ভব নয় বিধায় সন্ত্রাসীরা ওই ক্যাম্পে অবস্থান করছে বলে সূত্রটি দাবি করেছে। সেখানে (কোনারপাড়া ক্যাম্প) বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত ত্রাণসামগ্রী পাচার হচ্ছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে উদ্বাস্তু না হয়েও মিয়ানমারে বসবাস করে ওইসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশ থেকে ত্রাণসামগ্রী পাচ্ছে ৪ বছর ধরে। এই ক্যাম্পটি বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে মত প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সূত্রে। মানবতা দেখাতে গিয়ে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশে। তবে বাংলাদেশের তুমব্রু সীমান্ত সংলগ্ন স্থানে (জিরো পয়েন্টে) মিয়ানমার অভ্যন্তরে একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থাপন হওয়ায় আরও বেশি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সূত্র জানায়, গত বছর দেশটির সরকারী বাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তার সঙ্গে ওই ক্যাম্পে অবস্থানকারী সন্ত্রাসীদের পরামর্শমূলক বৈঠক হয়েছে। সিদ্ধান্ত হওয়ার পর থেকে সরকারী বাহিনীর সদস্যরাও ক্যাম্পটিতে বা ক্যাম্পের আশপাশে অভিযানে যায়নি এ পর্যন্ত। বৈঠকের শর্ত মতে তারা (আরসা) মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করবে না। সন্ত্রাসীরা শুধু প্রত্যাবাসন ঠেকাবে। মিয়ানমার সেনা বাহিনী-বিজিপির কর্মকর্তাদের সঙ্গে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ আরসার সিদ্ধান্তমূলক এই বৈঠক হওয়ার (২০২০) পর থেকে এ পর্যন্ত বিজিপি বা মিয়ানমার আর্মি ওই ক্যাম্পের আশপাশেও আসেনি। বৈঠকের আগে প্রতিরাতে কোনারপাড়া ক্যাম্পের আশপাশে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করত মিয়ানমার বাহিনী। সশস্ত্র অবস্থায় টহল দিত ওই এলাকায়। মিয়ানমারের সীমানা থেকে সরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে ঢুকে পড়তে হুমকি দেয়া হতো সেখানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের। বাংলাদেশে পালাতে মাইকিং করে জানিয়ে দিত। ওইসময় কোনারপাড়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা চরম আতঙ্কে আছে বলে হা-হুতাশ করে বাংলাদেশে আশ্রয় পাবার আগ্রহ প্রকাশ করত। আর এখন! সেখানে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা নিশ্চিন্তে বসবাস করছে। ভয় নেই সেনা বা মগ ও উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের। আসে না সরকারী কোন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। নিয়মিত ত্রাণসামগ্রী যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ওয়ার্কিং কমিটির যৌথ প্রতিনিধিদল ওই ক্যাম্পটি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। ওইসময় বান্দরবানের ডিসির নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল মিয়ানমারকে বলেছিল, যেহেতু এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হয়নিÑ তাই তাদের আরও ভেতরে বা তাদের বাড়িঘরে নিয়ে যাওয়া দরকার। মিয়ানমার প্রতিনিধিদল সম্মতি জানিয়ে এবং তাদের জন্য বাংলাদেশ থেকে ত্রাণসামগ্রী না পাঠাতে প্রস্তাব রেখে আরও ভেতরে নিয়ে যাবার কথা দিয়েছিল। কিন্তু ৩ বছরেও সে কথা রাখেনি মিয়ানমার। সূত্র জানায়, কোনারপাড়া ক্যাম্পের কমিটি প্রধান আরেফ আহমদ ও দিল মোহাম্মদ ছাড়াও সন্ত্রাসী চক্রের অসংখ্য সদস্য সীমান্ত অতিক্রম করে এপারে আসা যাওয়া করে থাকে প্রতিদিন। তারা দামি মোবাইল সেট হাতে নিয়ে তুমব্রুসহ উখিয়া টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে বেড়ায়। ভিডিও ফুটেজ ধারণ করে সরবরাহ করছে মিয়ানমার সরকারের কর্মকর্তা, গোয়েন্দাদের কাছে। এমনকি মিয়ানমার সরকারের কাছে দেশের গোপনীয়তাও ফাঁস করছে তারা। মিয়ানমার অভ্যন্তরে স্থাপিত ওই ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন রোহিঙ্গারা এপারে তুমব্রু বাজারে কেনাকাটা করতেও যে আসে তা দিবালোকের মতো সত্য। আবার অনেকে বিভিন্ন ক্যাম্পে এসে থেকেও যায় এবং কয়েকদিন পর ওপারের ক্যাম্পে ফিরে যায়। জানা গেছে, মানবতার খাতিরে নাকি তাদের গ্রেফতার করা হয় না। সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে অবস্থিত ওই ক্যাম্পটিতে রয়েছে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দলপতিসহ বহু ক্যাডার। কোনারপাড়া ক্যাম্পে ভারি অস্ত্রের মজুদ রয়েছে বলে একাধিক সূত্র থেকে খবর মিলেছে। বিভিন্ন সূত্র আরও জানিয়েছে, মিয়ানমারে ক্যাম্প করে বসবাসকৃত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে আর যাচ্ছে। এটা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি। এছাড়াও বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্পগুলোতে অপরাধ সংঘটিত করে ধরপাকড় ও গ্রেফতার এড়াতে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিতে সুবিধা পাচ্ছে ওপারের ওই ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থানে। ক্যাম্পে আশ্রিত সাধারণ রোহিঙ্গা সূত্রগুলো জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে যেসব সন্ত্রাসীর কারণে প্রাণ বাঁচাতে নিরীহ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তারাই (আরসা) ধারাবাহিক হত্যাকা- চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন রবিবার পরিষ্কার করে বলেছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট ঝুলে আছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের নেতিবাচক ভূমিকায়। তিনি এ পাঁচ দেশকে মাতব্বর বলতেও দ্বিধা করেননি। পাঁচ দেশের মধ্যে চীন ও রাশিয়া সদয় হলে এই ইস্যুটি ঝুলে থাকে না বলে মন্তব্য করেছেন।
×