ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গণসংগ্রামের আদর্শ বিশুদ্ধ আবেগ ইতিহাস চেতনা

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ২৫ জুলাই ২০২১

গণসংগ্রামের আদর্শ বিশুদ্ধ আবেগ ইতিহাস চেতনা

মোরসালিন মিজান ॥ ফকির আলমগীর যে চলে যাচ্ছেন, সত্যি বলতে, চলে যাওয়ার পরই তা উপলব্ধি করেছি। যত সময় যাচ্ছে এ উপলব্ধি তত গাঢ় হচ্ছে। আসলে গণসঙ্গীতের একমাত্র তারকাটি খসে পড়ার মতো দুর্বল ছিল না কখনই। বয়স ৭১ হয়ে গিয়েছিল। তাতে কী? তার গানের মতো গায়ের বল নিয়েও অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করতেন। ভরপুর প্রাণ ও কর্মচাঞ্চল্য তাকে হারানোর ভয় দূর করে দিয়েছিল। কিন্তু হায়! একেবারেই অকল্পনীয়ভাবে চলে গেলেন তিনি। হাসপাতালে ভর্তির পর আর কথা হয়নি তার সঙ্গে। সেই থেকে বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদ চিরস্থায়ী হয়ে গেল! অথচ গণসঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী গণমানুষের স্বভাব রপ্ত করেছিলেন। সবার সঙ্গে খুব সহজে মিশতে পারতেন। এই অতি মিশে যাওয়ার কারণে কিছু সমালোচনাও তাকে হজম করতে হয়েছে। তাই বলে নিজেকে বদলাতে যাননি। অদ্ভুত এক সারল্য তার মাঝে ছিল। দুর্লভ আবেগ ছিল। করোনাকাল শুরু হওয়ার পর কিছুটা হয়তো ভয় পেয়েছিলেন। নিয়মিত বিরতিতে গুণীজনদের মৃত্যু তাকেও বিষণœ করে তুলেছিল। একদিন ফোন করে বললেন, ‘আহারে, দেখছ কী সব গুণী মানুষ চইলা যাইতেসে। আমারও তো বয়স হইছে। তুমি না বলছিলা, আমার সঙ্গে একদিন বসবা। আমার কাছে কত কিছু আছে, তোমার লেখার কাজে লাগব। কবে আসবা, বলো? অগত্যা তার অফিসে গিয়ে উপস্থিত হতে হলো। তারও আগে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। কাঁধের ব্যাগে অনেক ছবি আর দেশী-বিদেশী পত্রিকার কাটিং নিয়ে এসেছেন। ফকির আলমগীরের আর্কাইভ সেন্স, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বললে, ভীষণ ভাল ছিল। ডকুমেন্ট সংগ্রহ ও সংরক্ষণে সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা যেত তার মাঝে। দীর্ঘ শিল্পী জীবনে ফকির আলমগীর বিশাল এবং বিস্ময়কর এক ফটো আর্কাইভ গড়ে তুলেছিলেন। সবাই এর কদর বুঝতেন, না, তা বলা যাবে না। তবে যারা বুঝতেন তাদের সামনে ঝাঁপি খুলে বসতে ভাল বাসতেন তিনি। পেশাগত কারণে মাঝেমধ্যেই তার সংগ্রহে থাকা ছবি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। এজন্য বাড়তি সময় হাতে নিয়েই তার কাছে যেতাম। ছবি দেখাতে দেখাতে তিনি বলতেন, ‘দেখো, কোনটা কোনটা তোমার লেখার কাজে লাগব, নিয়া যাও। তোমারেই তো দিমু। তুমিই তো লেখবা।’ এসব ছবিতে ফকির আলমগীরের নিজের কালটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পাওয়া যেত। একইভাবে তার সমকালীন প্রায় সকল শিল্পীকে ফ্রেমবন্দী করতেন তিনি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে পপসঙ্গীতের যে ধারা সৃষ্টি হয়েছিল, সে ধারার শিল্পীদের দু’একজন ছাড়া কেউ আর বেঁচে নেই। কিন্তু ফকির আলমগীরের আর্কাইভে জীবন্ত হয়ে আছেন তারা। আযম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ (এখনও জীবিত), ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজদের অবদানের কথা কী যে আগ্রহ নিয়ে বলতেন তিনি! তার আগের কালের বিখ্যাত শিল্পী ও সংগঠকদের প্রতি ছিল বিশেষ এক ধরনের দুর্বলতা। সাধারণত আমরা যাদের ভুলে থাকি তাদের তিনি একেবারে বুকে বাঁচিয়ে রাখতেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কলিম শরাফী, অজিত রায়, গাজিউল হক, ফয়েজ আহমদ, দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, সোহরাব হোসেন, আলতাফ আলী হাসু, এম আর আকতার মুকুল...। একেক প্রসঙ্গে একেক নাম উচ্চারণ করতেন তিনি। কত কত বছর আগের ছবি, ছবির মানুষ ও তাদের কীর্তি সম্পর্কে অনর্গল বলতে পারতেন। এ ক্ষেত্রে সব সময়ই অকৃপণ মনে হয়েছে তাকে। বড়দের আরও বড়, আরও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরতেন। এ সময় তার চোখে মুখে বিশুদ্ধ এক আবেগ ও ইতিহাস চেতনা কাজ করত বলেই আমার বোধ হয়েছে। বহু বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন এমন অনেক যুগস্রষ্টার নাম কেবল ফকির আলমগীরের সঙ্গে আড্ডায় বসেই শুনতে পেতাম। সবচেয়ে বেশি অবাক হতাম তার স্মরণ শক্তি দেখে। দিন তারিখসহ ছবির ঘটনাবলি বর্ণনা করতে পারতেন। ফকির আলমগীর কথার ফাঁকে ফাঁকে গান ধরতেন। গানের ফাঁকে ফাঁকেও জুড়ে দিতেন কথা। এভাবে একটি অপরটিকে সমর্থন করে এগিয়ে নিয়ে যেত। বড় গীতিকার সুরকার বা শিল্পীর কথা বলতে গিয়ে তাদের গানের কয়েক লাইন গেয়ে শোনাতেন। গানের লাইন শেষ করে সেই গানের ইতিহাস বর্ণনা করতেন। ফকির আলমগীরে মাঝে আরও দেখেছি আন্তর্জাতিকতাবাদ। তিনি শিল্পী সত্তার মিল খুঁজতে, সম্মিলন ঘটাতে বহির্বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন। বিশ্বসঙ্গীতে মাইকেল জ্যাকসনের অবদান বিনা দ্বিধায় স্বীকার করেছেন তিনি। জন হেনরি, নেলসন ম্যান্ডেলার মতো বিশ্ব নেতাদের গানে বেঁধেছিলেন। কিছুদিন আগে চির বিদায় নেন বলিউডের একসময়ের সুপারস্টার দিলীপ কুমার। তাকে নিয়ে লিখব, কী লিখব, ভাবছি। ঠিক তখন চোখে পড়ল ফকির আলমগীরের ফেসবুক পোস্ট। দিলীপ কুমারের সঙ্গে একই ছবিতে পাওয়া দেখা গেল তাকে। সঙ্গে সঙ্গে ফোন। বলিউড তারকার ঢাকা সফর সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য জানতে তার সহযোগিতা চাইলাম। তৎক্ষণাত হোয়াটসএ্যাপে কয়েকটি ছবি পাঠিয়ে দিলেন তিনি। দিলীপ কুমারের সফর নিয়ে নিজে তিনি লিখেছিলেন, সেই লেখা পাঠিয়ে দিলেন পড়ার জন্য। এভাবে বিরল তথ্যভান্ডারে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। ফকির আলমগীর খুব আনন্দের সঙ্গে সেদিন বলছিলেন, দিলীপ কুমার আমার পরিচয় জানতে পেরে ‘ফকির সাহাব’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু ‘ফকির সাহাব’ বলায় এত কেন আনন্দ কেন? জানতে চাইলে ফকির আলমগীরের এক অজানা কষ্টের কথা সামনে চলে আসে। নিজের নামের কারণে নাকি মারাত্মক ভুগতে হয়েছিল এই গণসঙ্গীত শিল্পীকে। বিব্রত হতে হয়েছিল। কারণ তার নামের সঙ্গে জুড়ে ছিল ‘ফকির’ শব্দটি। প্রচলিত ধারণা মতে, ফকিররা একেবারেই প্রান্তিক এবং অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠী। অনেকে ফকির আলমগীরকে নিয়ে পরিহাস করতে এই শব্দ ব্যবহার করে বসতেন। এমন নিষ্ঠুর আচরণে তিনি অপমানিত বোধ করেছেন। কষ্ট পেয়েছেন। দীর্ঘশ্বাস গোপনের চেষ্টা না করেই তিনি বলছিলেন : ‘ফকির তো হইল গিয়া বাংলার বাউল। বাংলার সাধকরা। সুফিরা। আমি সেই অর্থে ফকির। অথচ এই শব্দটার ভুল ব্যবহার, ইশ, কী যে কষ্ট দিসে আমারে! আমার সন্তানরাও অনেক কষ্ট পাইছে।’ হয়তো এ কারণেই নিজের তিন ছেলের নামের সঙ্গে ‘আলমগীর’ শব্দটি রাখলেও, ফকির রাখার আর সাহস করেননি। শিল্পীর আরও কোন দুঃখ কি ছিল? না, আর জানা যাবে না। আমরাই শুধু ফকির আলমগীরকে হারানোর দুঃখ নিয়ে থাকব।
×