ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষায় ফুটেছে চালতা

প্রিয় ফুলের সৌন্দর্যে মদির, ঘ্রাণে মাতোয়ারা

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২২ জুন ২০২১

প্রিয় ফুলের সৌন্দর্যে মদির, ঘ্রাণে মাতোয়ারা

মোরসালিন মিজান ॥ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার মুহূর্তটি কল্পনা করছিলেন জীবনানন্দ দাশ। চির প্রস্থানের মুহূর্ত। সেই মুহূর্তে প্রকৃতিপ্রেমী কবির মনে পড়ল চালতা ফুলের কথা। আক্ষেপ করে তিনি লিখলেন, আমি চ’লে যাব ব’লে/চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে...। অর্থাৎ কবির শূন্যতা অনুভব করবে কিনা তা ফুলটির কাছে জানতে চাইছিলেন তিনি। এ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়, চালতা কবির ভীষণ প্রিয় ফুল। শুধু কি কবির? যার চোখে পড়বে তারই ভাল লাগবে। তারই মন চাইবে আরও দেখি। এবং সে দেখার প্রকৃত সময়টি এখন। নবীনা বর্ষায় চমৎকার ফুটে আছে ফুলটি। শুধু বৃষ্টি দিয়ে বর্ষা চেনা যায়, না, এমন নয়। গাছের দিকে তাকান। ফুলের দিকে তাকান। কিছু গাছ কিছু ফুল আপনাকে ঠিক মনে করিয়ে দেবেÑ বর্ষা এসেছে। চালতা তেমনই একটি ফুল। আষাঢ়ের শুরুতেই সৌন্দর্যের পুরোটা নিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে। একসময় অধিকাংশ গ্রামে এ গাছ দেখা যেত। বাড়ির পেছনে জঙ্গলের মতো জায়গায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চালতা গাছ এখন অনেক ক্ষেত্রেই স্মৃতি হয়ে গেছে। মানুষ বেড়েছে। বাড়ি বড় হয়েছে। দালান কোঠা বানানোর প্রয়োজনে কাটা হয়েছে গাছ। সে তালিকায় চালতা, বলা চলে, সবার আগে। অবশ্য এ সংক্রান্ত একটি লেখার পাঠ প্রতিক্রিয়ায় কোন এক পাঠক মোটামুটি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। তার দাবি, গ্রামে চালতা গাছের অভাব নেই। তো, এ তথ্যটিও বর্তমান লেখায় উল্লেখ করে রাখছি। এদিকে, রাজধানী শহর ঢাকায়ও অল্পস্বল্প চালতা গাছ দেখা যায়। বৃক্ষ শোভিত রমনা পার্ক বা বলধা গার্ডেনে দিব্যি আছে চালতা। জাতীয় জাদুঘরের সীমনে প্রাচীরের ভেতরে আছে। আছে পুরনো সার্কিট হাউস রোডের পিআইবি কম্পাউন্ডেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আছে। এসবের বেশিরভাগই যতœ করে লাগানো। দু’দিন আগে বলধা গার্ডেনে গিয়ে এ বছরের প্রথম চালতা ফুলটি দেখা হলো। অদ্ভুত সুন্দর। আগে পাতার কথা বলি, এ গাছের লম্বা সবুজ পাতা। খাঁজকাটা আউটলাইন। করাতের দাঁতগুলোর মতো দেখতে। ভয়ঙ্কর নয় মোটেও। মনে হয় কেউ কাঁচি দিয়ে কেটে চমৎকার নকশা করে দিয়েছে। পাতার শিরা উঁচু। সমান্তরাল। ঘন পাতার আড়ালে চোখ জোড়ানো সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে আছে চালতা ফুল। ফুলটিকে চারদিক থেকে ঘিরে আছে মাংশল বৃতি। বৃতির গায়ে শিশির কণার সমপরিমাণ জল। অসংখ্য পরাগকেশর এই ফুলকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। জানা যাচ্ছে, চালতার আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। শ্রীলঙ্কা, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কিছু দেশে হয়। বিশেষত এটি ভারতবর্ষীয় উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম ডিলেনিয়া ইন্ডিকা। ইন্ডিকা শব্দটি ইন্ডিয়া থেকে নেয়া। আর ডিলেনিয়া নামটি নেয়া হয়েছে অক্সফোর্ডের বিখ্যাত তরুবিদ জে. জে. ডিলেনিয়াসের নাম থেকে। চালতার ইংরেজি নাম এলিফ্যান্ট আপেল। বাংলাদেশে চালতাকে চালিতা চাইলতে ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। গাছটি আপনি বেঁচে থাকে। বড় হয়। গাছে পাকা ফল বেশি দিন থাকলে তা এক সময় ঝরে পড়ে। সেই বীজ থেকে গাছের নিচে আরও গাছ জন্ম নেয়। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা অনুযায়ী, মধ্যমাকৃতি চিরহরিৎ বৃক্ষ চালতা। গাছের উচ্চতা ১৫ মিটার পর্যন্ত হয়। শাখা-প্রশাখা এলোমেলো। বাকল লালচে মসৃণ। গাছের আয়ু মোটামুটি ২৫ থেকে ৩০ বছর। পাতা ৮ থেকে ১৪ ইঞ্চি দীর্ঘ হয়। বছরের মে থেকে জুন মাসের মধ্যে ফুল ফোটে। ফুলের ব্যাস হয় ১৫ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার। বৃতির সবুজ, দলের শুভ্রতা, পরাগের হলুদ ও তারকাবৃতি গর্বমুÐÑ সব মিলিয়ে চালতা ফুলের গড়ন অত্যন্ত আকর্ষণীয়। চালতা ফুলের বৃতিই একসময় ফলে রূপান্তরিত হয়। টক স্বাদের ফল গ্রামীণ নারীরা ভীষণ পছন্দ করেন। লবণে মেখে নিয়ে গল্প করতে করতে খান। শরত ও হেমন্ত ফল পাকার সময়। শীতকাল পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। চালতার ফল হয় টক মিষ্টি। আচার, চাটনি, টক ডাল রান্নায় ব্যবহৃত হয়। পাকা ফল পিষে নিয়ে লবণ কাঁচামরিচ দিয়ে মেখে খাওয়া যায়। চালতার শাঁস নানা খাদ্যে ব্যবহার করা হয়। জেলি ও শরবত তৈরির হয় চালতা ফল থেকে। গাছটি থেকে শক্ত কাঠ হয়। নৌকা তৈরিতে ব্যবহার কর হয় এ কাঠ। ব্যবহৃত হয় বন্দুকের বাঁট তৈরিতেও। অবশ্য ফুলের আলোচনায় বন্দুক হাতে তুলে নেয়া অনুচিত হবে। তার চেয়ে বরং কবিতায় ফিরি। কবি বিষ্ণু দে লিখছেন: আকাশ নীলের তারাখচা পথে বৃষ্টি পড়ে/চালতা ফুলে ফলের বাগান মদির করে...। কেন কবিকে মদির করে চালতা ফুল? উত্তর জানতে নিজেই একবার দেখে নিন। চালতা ফুলের সৌন্দর্যে মদির, ঘ্রাণে মাতোয়ারা হওয়ার এখনই সময়।
×