ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখী উৎসব বন্ধ হলেও থেমে নেই প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ২৩:০১, ১১ এপ্রিল ২০২১

বৈশাখী উৎসব বন্ধ হলেও থেমে নেই প্রস্তুতি

মোরসালিন মিজান ॥ বাঙালীর বৈশাখ আসছে। আর মাত্র দু’দিন পর বাংলা নববর্ষ। করোনাকালে উৎসব অনুষ্ঠানে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও ১৪২৮ বঙ্গাব্দ ঘিরে আবেগ-উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। সর্বত্রই চলছে বৈশাখের প্রস্তুতি। লোকজ সংস্কৃতির শক্তিতে, প্রতিবাদী চেতনায় ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন স্বপ্ন দেখছে উদার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। বাঙালীর, বলা হয়ে থাকে, বারো মাসে তেরো পার্বণ। স্বাভাবিক সময়ে নানা উৎসব-অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। তবে সবচেয়ে বর্ণিল হয় বর্ষবরণ উৎসব। আনন্দঘন এ মুহূর্তটির জন্য অনেক আগে থেকে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে দেখা যায়। নিজস্ব সংস্কৃতির উৎসবে লোকায়ত জীবনের, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া মৌলিক সংস্কৃতির জয়গান করা হয়। সব ধর্মের মানুষ, সব শ্রেণী-পেশা ও বয়সের মানুষ সমান আগ্রহ নিয়ে উৎসবে যোগ দেন। উদার, অসাম্প্রদায়িক মানবিক আদর্শে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বড় সুযোগ করে দেয় বাংলা নববর্ষ। তবে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় গত বছরের মতো এবারও বর্ষবরণ উৎসবের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে লোকসমাগম এড়িয়ে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুরোধ করা হয়েছে। চলছে আরও নানা তৎপরতা। পহেলা বৈশাখ থেকে এক সপ্তাহের কড়াকড়ি লকডাউনের ঘোষণা এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে। এ বাস্তবতায় বর্ষবরণ উৎসবের খুব চেনা ছবিটা দেখা যাবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। একই কারণে শেষতক বর্ষবরণ অনুষ্ঠান থেকে সরে আসার কথা জানিয়েছে ছায়ানট। সেই ষাটের দশকে রমনা বটমূলে সূচনা করা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আজ এ দেশের জাতীয় উৎসব। গত বছর বন্ধ থাকার পর এবার করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু শনিবার ছায়ানট সাধারণ সম্পাদক দুঃখ করেই জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। শেষতক পারা গেল না। তাই বলে পহেলা বৈশাখের কথা একেবারে ভুলে থাকতে নারাজ বাঙালী। অনেকেই বিকল্প উদ্যাপনের কথা ভাবছেন। পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন। সাংগঠনিক প্রস্তুতি কম দেখা গেলেও, মহাব্যতিক্রম চারুকলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ পহেলা বৈশাখের প্রধানতম অনুসঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করছে এবারও। আয়োজকরা জানিয়েছেন, করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি ও লকডাউনের শর্ত মেনেই প্রতীকী মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করা হবে। এবার বাইরে নয়, চারুকলা অনুষদের ক্যাম্পাসের ভেতরেই আকর্র্ষণীয় মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। এতে বাইরের কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। চারুকলার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্য থেকে ১০০জন শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন। আয়োজনটির আকার ছোট করা হলেও উৎসব-আনন্দের ঘাটতি থাকবে না বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা। বড় কোন স্ট্রাকচারাল ফর্ম এবার রাখা হবে না। বিশাল গরু, ঘোড়া, মাছ, পাখি ইত্যাদি নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করার সুযাগ নেই। চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন শনিবার জনকণ্ঠকে জানান, মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ হবে চারটি চরকা। লোকজ মেলায় যে ধরনের চরকা কিনতে পাওয়া যায় সে ধরনের চারটি চরকা তৈরি করছেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। এগুলোর একটিতে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, একটিতে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী ও একটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের কথা গৌরবের সঙ্গে উপস্থাপন করা হবে। এছাড়াও অংশগ্রহণকারী দশজনের হাতে থাকবে রাজা-রানীর মুখোশ। বাকিদের হাতেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও লোক ঐতিহ্যের নানা ফর্ম দেখা যাবে। সে হিসেবে ১০০ টি উপস্থাপনা থাকবে শোভাযাত্রায়। নিসার হোসেন জানান, মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয়া সকলেই মুখে ফেস শিল্ড ব্যবহার করবেন। করোনা থেকে বাঁচতে যে ফেস শিল্ড, সেটিকেই রঙিন শিল্পকর্ম হিসেবে গড়ে নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে সমকালকে পর্যবেক্ষণে নিয়ে তার আলোকে জাতির উদ্দেশে একটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেন আয়োজকরা। সে অনুযায়ী, এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্বাচন ও পোস্টার ডিজাইন করা হয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ‘কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর।’ কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত রচনা থেকে এ অংশটুকু গ্রহণ করা হয়েছে। পোস্টার ডিজাইন করেছেন আনিসুজ্জামান সোহেল। এতে দেখা যায়, গভীর অন্ধকার ভেদ করে উড়ে আসছে ভীষণ রঙিন দুটি পাখি। একঝলক আলো হয়ে উৎসব, আনন্দ আর ভরপুর প্রাণ হয়ে আসছে। বার্তা দিচ্ছে, জয় হবে শুভ সুন্দরের। জীবনের জয় হবে। চারুকলা অনুষদের ডিন ও শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, বর্তমানে আমরা দুটি বড় দুর্যোগের মুখোমুখি। একটি করোনা, অন্যটি মৌলবাদ। গত বছর থেকে শুরু হয়েছে করোনা। সংক্রমণ ব্যাধি সব কিছু তছনছ করে দিচ্ছে। বর্তমানে সংক্রমণ আরও উর্ধমুখী। এ অবস্থায় আমরা মনে করি, মনোবল ধরে রাখতে হবে। হতাশা কাটিয়ে জীবনের জয়গান করতে হবে আমাদের। মনে রাখতে হবে, যখনই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে তখন নতুন কিছু উপলব্ধির, আবিষ্কারের সুযোগ সৃষ্টি হয়। করোনাকালে প্রকৃতি নিয়ে নতুন করে ভাবছি আমরা। মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক সে সম্পর্ক নিয়ে নতুন রিয়ালাইজেশন হচ্ছে। এভাবেই উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে এ কথাটিই বলার চেষ্টা করা হবে। একই সময়ে আমরা দেখেছি মৌলবাদের উত্থান। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন শিল্পীরা। মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে এই অপশক্তিকে যে কোন মূল্যে দমন করার কথা বলব আমরা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার নতুন শপথ নেব। দুই অশুভ অন্ধকারকে অচিরেই পরাভূত করে শুভ-সুন্দরের প্রত্যাশায় মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করা হবে বলে জানান তিনি। এদিকে, বৈশাখ বরণের অংশ হিসেবে এখন চারুকলার বাইরের দেয়ালে লেখচিত্র অঙ্কনে ব্যস্ত শিল্পীরা। এরই মাঝে সমস্ত দেয়াল রঙিন হয়ে উঠেছে। আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কৌতূহলী চোখে দেয়ালছবি দেখছেন পথচারীরা। এভাবে ছড়িয়ে পড়ছে উৎসবের আমেজ। বৈশাখ সামনে রেখে চলছে কেনাকাটাও। নতুন পোশাক কিনছেন উৎসবপ্রেমীরা। ঢাকার বিভিন্ন মার্কেট ও শপিংমল ঘুরে দেখা গেছে, বৈশাখের পোশাকের পসরা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এবারও প্রাধান্য পেয়েছে দেশীয় কাপড়। গরমের কারণে যতটা সম্ভব হালকা ও আরামদায়ক কাপড় বেছে নেয়া হয়েছে। মূল রং সাদা ও লাল। এ দুটি রংকে প্রাধান্য দিয়ে পোশাকের ডিজাইন করা হয়েছে। কাপড়ের উপরে স্ক্রিনপ্রিন্ট, কাঁথা স্টিচ, এপ্লিকের কাজ করা হয়েছে। বসানো হয়েছে পুঁতি, জরি ইত্যাদিও। দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর মধ্যে রঙ বাংলাদেশ, নিপুণ, কে-ক্রাফট, অঞ্জনস, নগরদোলা, দেশাল, বাংলার মেলা, বিবিয়ানা, সাদাকালো, অন্যমেলার মতো প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো সামনে এসেছে স্বতন্ত্র আবেদন নিয়ে। দেশীয় ফ্যাশন হাউজের নামকরা দশটি শোরুম একসঙ্গে পাওয়া যায় বসুন্ধরা সিটি শপিংমলে। ‘দেশী দশ’ নামের প্ল্যাটফর্মটিতে ক্রেতার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। শনিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বৈশাখের রংটাকে পুরোপুরি ধারণ করছে শোরুমগুলো। প্রতিটি দোকানের সামনে বৈশাখী পোশাক। ভেতরটাও সুন্দর সাজানো। রঙ বাংলাদেশের আউটলেটের ইনচার্জ গৌতম জানান, করোনাকালেও বেশ কিছু ডিজাইনের পোশাক তৈরি করেছেন তারা। গত দুই দিন ভাল বিক্রিও হয়েছে। এর পাশাপাশি অনলাইনে বৈশাখের জামাকাপড় বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি। বৈশাখ উপলক্ষে অনেকে আবার ফ্যামিলি সিরিজ করেছেন। স্বামী-স্ত্রী-সন্তান সবার এক রং আর অভিন্ন ডিজাইনের পোশাক। এটিও বেশ জনপ্রিয় এখন। বৈশাখের পোশাকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্থান শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট। এখানকার নামকরা ব্র্যান্ড নিত্য উপহারে গিয়ে দেখা যায়, বৈশাখ উপলক্ষে অনেক নতুন শাড়ি তোলা হয়েছে। কোনটির জমিনে বাংলাদেশ। কোনটির আঁচলে গ্রামীণ গল্পগাঁথা। বিখ্যাত শিল্পীদের শিল্পভাষায় তুলে ধরা হয়েছে বৈশাখকে। কাপড়-ই- বাংলা’র শোরুমে মেয়েদের থ্রিপিস। ফতুয়া। বেশ রঙিন। দূর থেকে চোখে পড়ে। কাটিংয়েও কিছু ভিন্নতা আছে। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বিথুন জানান, অনেকদিন ধরে খড়া চললেও, গত দুই দিন তাদের বিক্রি অনেক বেড়েছে। আগেভাগেই অনেকে পোশাক কিনে রাখছেন বলে জানান তিনি। এদিকে, রাজধানীর হাইকোর্ট এলাকায় বসেছে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের পসরা। সব সময়ই দেখা যায়। তবে এখন অনেক বেশি। মাটির ছোট ছোট সরা উজ্জ্বল রঙে এঁকে নেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন রকমের পাত্রের গায়ে প্রাকৃতিক রং। ফোক মোটিফ। আছে শখের হাঁড়িও। গ্রামীণ ঐতিহ্যের হাঁড়ি পাটের শিকেয় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। চেনা দোকানগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে বাঁশের তৈরি কুলা। আলপনা আঁকা কুলা বিছিয়ে রাখা হয়েছে ফুটপাথে। আছে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির ঝুরি। দোকানিদের কর্মব্যস্ততাও চোখ এড়ায় না। পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন বাসাবাড়ির ফ্রিজে জমা হচ্ছে ইলিশও। চলছে বৈশাখে বাঙালী রান্নার প্রস্তুতি। সব দেখে বোঝা যায়, করোনাকালেও বাদ যাবে না উদ্যাপন। বিকল্প উদ্যাপনে রঙিন হয়ে উঠবে বাঙালীর পহেলা বৈশাখ।
×