ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

মুক্তিযুদ্ধে নারী ও একজন যুদ্ধশিশুর অসমাপ্ত যুদ্ধ

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ২৭ জানুয়ারি ২০২১

মুক্তিযুদ্ধে নারী ও একজন যুদ্ধশিশুর অসমাপ্ত যুদ্ধ

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর। এ বছরের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রু“মুক্ত করি। স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে পথ চলতে হলে মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত অনেক সত্যকে সামনে অনাবৃত করতে হবে। নির্মম সেইসব সত্যকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকালে লক্ষ লক্ষ বাঙালী নারীর আত্মত্যাগ স্মরণ করার সময় এসেছে। এই সত্য নিয়ে কথা বলার আগে এটিও জানতে হবে কোন প্রেক্ষাপটে অবশেষে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অনেক পুরনো। রয়েছে বিশাল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। কিভাবে চরম বৈষম্য ও নিপীড়নের পথ ধরে অবশেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-এর আহ্বান ও নেতৃত্বে জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে সেটিও অনিবার্যভাবে জানা প্রয়োজন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পূর্বে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাবের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। এই প্রস্তাবটিকেই পাকিস্তান প্রস্তাব নামে অভিহিত করা হয়। এই প্রস্তাবের খসড়ার বেশকিছু সংশোধন সাপেক্ষে শের ই বাংলা এ.কে ফজলুল হক তা অধিবেশনে পেশ করেন। অন্যান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ কর্তৃক প্রস্তাবটি সমর্থিত হয়েছিল। ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দাবি প্রকট হতে থাকে। এরই মধ্য দিয়ে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নেতা মোহাম¥দ আলী জিন্নাহ ভারতীয় উপমহাদেশে স্বতন্ত্র স্বাধীন স্বার্বভৌম মুসলিম আবাস ভূমির দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান। ১৯৪৬ সালে সর্বভারতীয় নির্বাচনী ফলাফলে জিন্নাহর দাবির প্রতি মুসলমানদের সমর্থনের বহির্প্রকাশ ঘটে। ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের ৩০টি মুসলিম আসনের সব ক’টিই পায় মুসলিম লীগ। প্রদেশগুলোর মধ্যে ৫২৫টি মুসলিম আসনের মধ্যে জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ ৪৬৪টি আসনে জয়লাভ করে। এ বিজয়ের ভিত্তিতে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ দাবি করতে থাকেন যে, ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সংগঠন হলো মুসলিম লীগ। ১৯৪৬ সালের ২৪ মার্চ ব্রিটিশ কেবিনেটের ৩ জন সদস্য ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার জন্য ভারতবর্ষে আসেন। অনেক আলাপ আলোচনা এবং দেনদরবারের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয় যথাক্রমে ১৪ ও ১৫ আগস্ট ১৯৪৭-এ। এভাবেই হয় দেশ বিভাগ। ১৪ আগস্ট জন্ম নেয় পাকিস্তান নামক একটি মুসলিম রাষ্ট্র, যার পরবর্তী নাম হয় ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান। আরেকটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্ররূপে জন্ম হয় ভারত-এর। পাকিস্তানের জন্মের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানে বাঙালী জনগোষ্ঠীর অধিকার ও ভবিষ্যত নিয়ে ক্রমেই সন্দিহান হয়ে উঠছিলেন। ব্রিটিশ শোষণের হাত থেকে ভারতবর্ষের মানুষ যখন স্বাধীনতা লাভ করে এর স্বাদ ভোগ করছে, ঠিক তেমনি সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক আচরণে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ অনুভব করতে থাকে— ‘সম্ভবত আমরা জ্বলন্ত আগুন থেকে ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে ঝাঁপ দিয়েছি।’ মোহাম¥দ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের ওপর প্রথম যে আঘাতটি আসে সেটি হলো, রাষ্ট্র ভাষার ওপর আঘাত। জিন্নাহ চাইলেন পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু তদানীন্তন পূর্ব-বাংলার মানুষ জিন্নাহর দূরভিসন্ধি বুঝতে পেরে প্রতিবাদে ফেটে ওঠে। বিশেষ করে পূর্ব-বাংলার ছাত্র সমাজ সেদিন জিন্নাহর উপস্থিতিতেই শুধু উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার পায়তারা করার প্রকাশ্য বিরোধিতা করে। শুরু হয় বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন। এই অন্দোলনের গোড়া থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন তদানীন্তন তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালে রফিক, শফিউর, সালাম, জব্বার, বরকতসহ আরও অনেক নাম না জানা শহীদের রক্তের বিনিময়ে পূর্ব-বাংলার মানুষ ‘বাংলা’কে পাকিস্তানের অন্যতম দাফতরিক ভাষার স্বীকৃতি আদায় করতে সমর্থ হয়। ’৫২ সালের শহীদদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতি এগিয়ে যেতে থাকে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার দিকে। ’৫৪ সালের নির্বাচনে এই ভূখণ্ডের মানুষ তাদের ইচ্ছার বহির্প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ অঞ্চলে এক নতুন বৈষম্য ও নীপিড়নের অধ্যায়। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এই ৬ দফা ছিল তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের মেনিফেস্টো। আইয়ুব খান সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে শেখ মুজিবকে ৬ দফা প্রণয়নের অপরাধে কারান্তরালে নিক্ষেপ করে। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ভারতের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে তাদের সাহায্যে পূর্ব-পাকিস্তানকে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্র করার চেষ্টা করেছিলেন। পূর্ব-পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণের চাপে আইয়ুব খান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ১৯৬৯-এ এক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ থেকে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। পাকিস্তানী স্বৈরাচারী ক্ষমতার পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের আবির্ভাব ঘটে। ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পরই ঘোষণা করেন দেশে অনতিবিলম্বে তিনি সাধারণ নির্বাচন দেবেন এবং এর মধ্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ৬ দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ তৎকালীন সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে নির্বাচনী প্রচারণায় নামেন। এই ভূ-খণ্ডের মানুষ ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের ৭ এবং ১৭ তারিখের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে (মহিলা আসনসহ)। পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছিল, কিন্তু তাদের কেউই নির্বাচিত হননি। নির্বাচনী ফলের ধরণে এমনভাবে প্রতিবাদ হয় যে, পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণও পাকিস্তানপন্থী কাউকেই তাদের নেতৃত্বে দেখতে চায়নি। ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু পিডিপি নেতা নুরুল আমিন ও চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়। পাকিস্তানভিত্তিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর কাছে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চরম ও দৃশ্যমান অনীহা প্রকাশ করে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর এমন নেতিবাচক মানসিকতার বিষয়টি বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সাল থেকে অর্থাৎ, পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে অন্যান্য লেখকের লেখা বই থেকেও বঙ্গবন্ধুর এই অভ্রান্ত ধারণার প্রমাণ মেলে। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ও আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে কারাবন্দী করা হয় পাকিস্তানে। তাঁর অবর্তমানে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অকুতোভয় দামাল ছেলেরা প্রিয় দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ নয় মাস প্রাণপনে যুদ্ধ করে। তাদের সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহায়তায় আমাদের মুক্তিবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশকে চূড়ান্তভাবে শত্রু“মুক্ত করতে সক্ষম হয়। বাঙালী অর্জন করে বিজয়। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা লেঃ জেঃ নিয়াজী ও তার অধীন ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কবর রচিত হয় বাংলাদেশের মাটিতে। নয় মাসের এই দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন ৩০ লক্ষ মানুষ আর সম্ভ্রম হারিয়েছেন ২ লক্ষ মা-বোন। মুক্তিযুদ্ধে আত্মবলিদানকারী ৩০ লক্ষ শহীদের মধ্যে কতজন পুরুষ আর কতজন নারী তার হিসেব হয়ত কেউ রাখেনি। হয়ত এই হিসাবও আমরা রাখিনি যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কতজন নারী সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। তারামন বিবি, ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, কাঁকন বিবি, গিতা কর, শিরিন বানু, মিথিল প্রমুখ বিশিষ্ট নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নাম হয়তবা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু আরও যে অগণিত মা-বোন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তার হিসেব আমরা কি কখনও রেখেছি? এ নিয়ে কি কোন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে? এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি লজ্জার বিষয়। কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে/কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় এই সত্য বচন তুলে ধরেছেন আমাদের চৈতন্যোদয়ের জন্য। আমাদের দেশের নারীরা যতজন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তারচেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক নারী এই মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাদের সর্বোচ্চ সম্মান নিজ সম্ভ্রম হারিয়েছেন। মা-বোনদের ওপর পাকিস্তানী দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় কুখ্যাত দোসর রাজাকার আল বদরদের নির্মম অত্যাচারের বর্বর সত্য আমরা যেন কোনদিন বিস্মৃত না হই, সেই শপথ আমাদের নিতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের প্রতি যে বর্বর পাশবিক নির্যাতন পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের কুখ্যাত দোসররা করেছিল, তার একটি চিত্র শহীদ রুমি স্কোয়াডের গবেষণায় উঠে এসেছে। ‘খুলনার ডাঃ বিকাশ চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘যুদ্ধ শেষে ক্যাম্প থেকে কয়েকটি কাচের জার উদ্ধার করা হয়, যার মধ্যে ফরমালিনে সংরক্ষিত ছিল মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন অংশ। অংশগুলো কাটা হয়েছিল খুব নিখুঁতভাবে।’ কি নির্মম ও অমানবিক! এ যেন কেবল নারীর প্রতি নয়, পুরো মানবতার বিরুদ্ধেই পাশবিক আক্রমণ। কুমারখালির বাটিয়ামারার মোঃ নুরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘মার্চে মিরপুরের একটি বাড়ি থেকে পরিবারের সবাইকে ধরে আনা হয় এবং কাপড় খুলতে বলা হয়। তারা এতে রাজি না হলে বাবা ও ছেলেকে আদেশ করা হয় যথাক্রমে মেয়ে এবং মাকে ধর্ষণ করতে। এতে রাজি না হলে প্রথমে বাবা এবং পরে ছেলেকে টুকরো টুকরো করে হত্যা করা হয় এবং মা মেয়ে দু’জনকে দু’জনের চুলের সঙ্গে বেঁধে উলঙ্গ অবস্থায় টানতে টানতে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।’ মুক্তিযুদ্ধের পর পুনর্বাসন সংস্থায় ধর্ষিতাদের নিবন্ধীকরণে যুক্ত সমাজকর্মী মালেকা খান এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘আমাদের সংস্থায় আসা ধর্ষিতা নারীদের প্রায় সবারই ছিল ক্ষত-বিক্ষত যৌনাঙ্গ। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিড়ে ফেলা রক্তাক্ত যোনিপথ, দাঁত দিয়ে ছিড়ে ফেলা স্তন, বেয়োনেট দিয়ে কেটে ফেলা স্তন-উরু এবং পশ্চাৎদেশে ছুরির আঘাত নিয়ে নারীরা পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসত।’ এমন বর্বর সম্ভ্রমহানির ঘটনা বুঝি পৃথিবীতে বিরল। জীবনের বাকি সময়টিতেও সম্ভ্রমহানির ক্ষত তাদের বয়ে বেড়াতে হয়েছে। বিচারপতি কে. এম সোবহান তার এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘১৮ ডিসেম্বর মিরপুরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া একজনকে খুঁজতে গিয়ে দেখি মাটির নিচে বাঙ্কার থেকে ২৩ জন সম্পূর্ণ উলঙ্গ, মাথা কামানো নারীকে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে পাক আর্মিরা।’ (এখানে উল্লেখ্য, মিরপুর শত্রুমুক্ত হয় ১৯৭২ এর জানুয়ারির শেষের দিকে) (চলবে) লেখক : বিচারপতি, আপীল বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট ও সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২
×