ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বস্বান্ত মানুষের পরিচিতি মিলছে বাস্তুচ্যুত হিসেবে কোন কোন পরিবার ২৭ বার পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত হয়েছে ঢাকায় স্থানান্তরিত জাহেদ মোল্লা আবারও কৃষক হয়ে যেতে চান

নদী ভাঙ্গনের মহামারী ॥ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব

প্রকাশিত: ২২:৩৩, ২৫ জানুয়ারি ২০২১

নদী ভাঙ্গনের মহামারী ॥ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব

কাওসার রহমান ॥ কয়েক দশক ধরে নদী ভাঙ্গন বাংলাদেশে এক মহামারী রূপ ধারণ করেছে। নদী ভাঙ্গনের এই নির্মম দুর্যোগে মুহূর্তের মধ্যেই মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছেন। কৃষক, জেলে এবং পেশাজীবী মানুষেরা তার ঐতিহ্যগত পেশা এবং পৈত্রিক ভিটে মাটি হারিয়ে হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। আত্ম পরিচয়টুকুও হারিয়ে সঙ্গায়িত হচ্ছেন বাস্তুচ্যুত মানুষ হিসেবে। ২০১৮ সালে শুধুমাত্র শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলায় ভয়াবহ নদীভাঙ্গনে প্রায় ৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সর্বস্ব হারানো এই বাস্তুচ্যুত মানুষগুলো বেঁচে থাকার তাগিদে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছেন। নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারীরা। নদী ভাঙ্গন এলাকায় পরিচালিত এক গবেষণা থেকে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এই গবেষণা থেকে দেখা যায়, নদী ভাঙ্গনের কারণে কোন কোন পরিবার ২৭ বার পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তবে বাস্তুচ্যুতদের সিংহভাগই অন্যত্র গমনে অনিচ্ছুক বলে জানিয়েছেন। তারা চান, তাদের বাড়ির নিকটবর্তী কোন স্থানেই বসবাস করতে। এর কারণ হচ্ছে তারা তাদের কৃষি কাজ, মাছ ধরা কিংবা ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালানোর মতো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করতে চান। তাইত, চার বার নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে ঢাকায় স্থানান্তরিত জাহেদ আলী মোল্লার করুণ আর্তি, ‘কোন সুযোগ পেলে আমি আমার বর্তমান পেশা বদলে ফেলে চাষাবাদ শুরু করতাম। আমি আবার কৃষক হয়ে যেতে চাই!’ বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনে একটি বিশদ নীতিমালা প্রণয়নসহ ৫ দফা সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। ২০১৮ সালে শরীয়তপুর জেলাধীন নড়িয়া উপজেলায় সংঘটিত ভয়াবহ নদী ভাঙ্গনের ঘটনার পটভূমিতে সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) ২০১৯ সালে সেই অঞ্চলে একটি গবেষণা কার্য পরিচালনা করে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তন কিভাবে নদী ভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত করছে, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিকে বদলে দিচ্ছে, জনমানুষের বাস্তুচ্যুতি এবং অভিবাসন প্রক্রিয়ায় কি করে প্রভাব রাখছে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুসন্ধান এবং বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে এই গবেষণা কার্যটি পরিচালনা করা হয়েছে। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের ক্ষয়ক্ষতির স্বরূপ উন্মোচনের জন্য নড়িয়া উপজেলার এবং ঢাকা জেলার কিছু এলাকাতে (কল্যাণপুর ও বেগুনটিলা বস্তি) আশ্রয় নেয়া অসহায় মানুষের উপরও এই গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছে। রেকর্ডকৃত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আগে পদ্মার বাম তীর কিছু মাত্রায় ভাঙ্গন কবলিত ছিল। কিন্তু গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে এর ডান তীরেও ব্যাপক ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। খরস্রোতা পদ্মার এমন নজিরবিহীন ভাঙ্গনে নড়িয়া উপজেলার ফসলি জমির এক বিরাট অংশ পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়েছে। এমন ভাঙ্গনের চিত্র শত বছরের রেকর্ডকৃত ইতিহাসে পাওয়া যায়নি। এই ভাঙ্গন নড়িয়ার ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল, হাট-বাজার, হাসপাতাল, স্কুলসহ বাণিজ্যিক অঞ্চলে আঘাত হানতে থাকে। ভাঙ্গনের তীব্রতা এবং বিস্তৃতি দেখে নড়িয়ার জনমনে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। ২০১৮ সালে নদীভাঙ্গনের কবলে পড়ে সাধুর বাজারের কমপক্ষে ২০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ওয়াপদা বাজার এলাকার অন্ততপক্ষে ২০০ দোকানসহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয়, হাসপাতাল বিলীন হয়ে গেছে। নড়িয়া উপজেলার প্রায় ৪০০০ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছেন এবং ৪২০০-৫০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ১৯৯৮-২০১৯ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত স্যাটেলাইট চিত্র পর্যালোচনায় ১৯৯৮-০৮ সময়কালে নদীভাঙ্গন এবং চর সৃষ্টির পরিমাণগত ও সংখ্যাগত ওঠানামা লক্ষ্য করা গেছে। ২০০৮-১৮ সালের মধ্যে নদী ভাঙ্গন কিছুটা মন্থর গতির ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালেই নড়িয়া উপজেলাবাসী সর্বনাশা ভাঙ্গনের কবলে পড়ে। অপরদিকে ১৯৯৮-০৮ সাল সময়ব্যাপী চর সৃষ্টির উচ্চমাত্রা পরিলক্ষিত হয়েছে, যা ২০০৮ সালের পরে কমে যায় এবং ২০১৯ সালেও প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নদীতীরের উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী স্থানান্তরগতি পরিলক্ষিত হয়েছে। গবেষণার ফলাফল অনুসারে, নদীভাঙ্গনের কারণে প্রায় ৭৩ শতাংশ উত্তরদাতার কৃষিজমি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে এবং প্রায় ৫১ শতাংশ উত্তরদাতা প্রত্যেকের ৩০ শতাংশের (১০০ শতাংশ = ১ একর) বেশি পরিমাণ কৃষিজমি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। এছাড়া ৭৭ শতাংশ উত্তরদাতা নদীভাঙ্গনের ফলশ্রুতিতে খাদ্য ও পানি সঙ্কটে পতিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে, উত্তরদাতাদের মধ্যে শতকরা ৭৭ ভাগ দুর্যোগকালীন পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। বিশেষ করে নারীরা (৬৭ শতাংশ) সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত। কারণ তারা দুর্যোগকালে প্রতিবেশীর টয়লেট কিংবা তাদের নিজের বাড়ি থেকে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত টয়লেট ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছেন। এটি তাদের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করেছে এবং নানা রকম রোগব্যাধির মধ্যে ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে গৃহস্থালির জন্য পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে নারীদের প্রায় ৩৬ শতাংশ স্থানীয় যুবকদের দ্বারা উত্যক্তকরণ, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, অহেতুক নাম ধরে ডাকা অথবা কটুক্তি প্রভৃতি যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। নদীভাঙ্গনের কারণে অনেকে স্ট্রোক, হার্ট এ্যাটাক, হতাশা, মেন্টাল ট্রমা প্রভৃতি শারীরিক ও মানসিক সমস্যা ভোগ করেছেন এবং ভাঙ্গনকালীন সময়ে গৃহস্থালির উপকরণ যেমন ঢেউটিন, ইট, আসবাবপত্র ইত্যাদি স্থানান্তরকালে বিভিন্নভাবে শারীরিক জখমের শিকার হয়েছেন। এই নদীভাঙ্গন ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে। ভাঙ্গনের অভিঘাতে মানুষ গৃহহীন, ভূমিহীন, সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে। এই গবেষণাটি থেকে উঠে এসেছে, জরিপে অংশগ্রহণকরীদের ৮৩ শতাংশই ব্যক্তিগতভাবে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। হারিয়েছেন বসতবাড়ি ও কৃষি জমি। বিনষ্ট হয়েছে ফসল, হারিয়েছে জিনিসপত্র ও সম্পদ এবং পরিবারের সদস্য। এছাড়া নেতিবাচক শারীরিক-মানসিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন। সর্বস্ব হারানো এই মানুষগুলো বেঁচে থাকার তাগিদে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছেন। গবেষণায় অংশ নেয়া উত্তরদাতারা মনে করেন, অকাল বৃষ্টিপাত ও বন্যা, নদীপ্রবাহের দিক পরিবর্তন এবং সুরক্ষাবাঁধ না থাকা -প্রধানত এই তিনটি কারণে তাদের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে। মোদ্দাকথা, দুর্যোগপ্রসূত নেতিবাচক অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রভাব এবং শারীরিক-মানসিক আঘাত ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীকে বেঁচে থাকার তাগিদে অন্যত্র বসতি স্থাপনে বাধ্য করেছে। সমীক্ষার ফলাফল থেকে দেখা গেছে, বাস্তুহারা মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে কাছাকাছি কোন এলাকায় আশ্রয় খোঁজে। পরবর্তীতে নিকটস্থ শহরে, তারপর আরও বৃহত্তর কোন নগরে এবং সর্বশেষে অন্য কোন মহানগরে বসতি স্থানান্তরে প্রয়াসী হন। নিজের এলাকার চেয়ে পাশর্^বর্তী এলাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার প্রবণতার পেছনে তারা নিজ এলাকায় কর্মসংস্থান এবং বসবাসের নিরাপত্তাহীনতাকে দায়ী করেন। গবেষণাকার্যে অংশ নেয়া উত্তদাতাদের প্রায় ৭৮ শতাংশই তাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের আশায় সাময়িকভাবে নড়িয়াধীন পাশর্^বর্তী এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছেন। অপরদিকে স্বল্পসংখ্যক বাস্তুহারা জীবন-জীবিকার সন্ধানে নড়িয়া থেকে ঢাকায় স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত হয়েছেন। গবেষণাটি থেকে বেরিয়ে এসেছে যে, প্রায় ৯৮ শতাংশ উত্তরদাতার প্রত্যেকেরই নদীভাঙ্গনের কারণে একাধিকবার স্থানান্তরিত হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ উত্তরদাতা ৫ থেকে ৭ বার, ১০ শতাংশ উত্তরদাতা ১০ বার এবং কয়েকজন ২০ থেকে ২৭ বার বাস্তুচ্যুত হওয়ার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে বাস্তুচ্যুতদের সিংহভাগই অন্যত্র গমনে অনিচ্ছুক ছিলেন বলে জানিয়েছেন। বাস্তুচ্যুতরা পার্শ্ববর্তী এলাকায় স্থানান্তরিত হতে আকৃষ্ট হওয়ার পেছনে কর্মসংস্থান এবং বাসস্থানের অনিশ্চয়তা- এই দুটিকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনে বেশিরভাগ বাস্তুচ্যুতই বলেছেন যে, তারা তাদের বাড়ির নিকটবর্তী কোন স্থানে বসবাস করতেই বেশি আগ্রহী। কেননা সেক্ষেত্রে তারা তাদের কৃষি কাজ, মাছ ধরা এবং অটোরিক্সা বা ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালানোর মতো কাজগুলোতে সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম করতে পারেন। আয় সৃষ্টিকারী এই কার্যক্রমগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বড় শহরগুলোতে অনুপস্থিত, যা গবেষণাধীন এলাকার জনস্থানান্তরণের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। অভিবাসনকারীদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন জায়গায় স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে পরিচয় সঙ্কটে পড়েন বলে জানান। বর্তমানে ঢাকার বেগুনটিলায় বসবাসরত জাহেদ আলী মোল্লা, যিনি এক সময় নড়িয়ার ওয়াপদারঘাটের বাসিন্দা ছিলেন, তিনি চার বার নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেন। বর্তমানে ঢাকা শহরে তিনি রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। পরিচয় সঙ্কটে পতিত জাহেদ আলী মোল্লার করুণ আর্তি, ‘কোন সুযোগ পেলে আমি আমার বর্তমান পেশা বদলে ফেলে চাষাবাদ শুরু করতাম। আমি আবার কৃষক হয়ে যেতে চাই!’ দলগত আলোচনাগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা নদী ভাঙ্গনের এই বিপর্যয় মোকাবেলায় তাদের বিভিন্ন কৌশলের কথা তুলে ধরেন। কেউ কেউ, বালুর বস্তা ফেলে, বেড়া দিয়ে, গাছ লাগিয়ে ভাঙ্গনের গ্রাস থেকে বসতবাড়ি রক্ষার চেষ্টা করেছেন। এই গবেষণা থেকে দেখা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা স্থানীয় এনজিওগুলোর কাছ থেকে কিছু কিছু ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা পান, যা দিয়ে তারা দুর্যোগের পরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করেন। এই গবেষণায় দুর্যোগ মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত কৌশলগুলো অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে, শতকরা ৮১ ভাগ উত্তরদাতা স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা প্রাপ্তির কথা স্বীকার করেছেন এবং প্রায় ৮৩ শতাংশ উত্তরদাতা এনজিও এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের (সিএসও) কার্যকর অবদানের ব্যাপারে নিশ্চিত করেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যদাতা, যিনি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিডব্লিউডিবি) এক কর্মকর্তা। আলোচ্য সঙ্কট নিরসনকল্পে তিনি সরকার কর্তৃক গৃহীত কিছু প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিডব্লিউডিবি) কর্তৃক নদীর তীরের ৫০ মিটারের মধ্যে পুকুর-জলাশয় ভরাটকরণ এবং ঝুঁকি হ্রাসকল্পে নদীর তীর বরাবর বালুর বস্তা এবং পাথর ফেলা। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার নদীর তীর (৯ কিমি. দীর্ঘ) রক্ষায় ‘বন্যা ও নদীভাঙ্গন ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিনিয়োগ কর্মসূচী (এফ আর ই আর এম আই পি)’ নামে ১৩ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার মধ্যে রয়েছে নদীর জলপ্রবাহ অবাধ রাখতে নদীর বুকে ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা এবং নদী তীর সুরক্ষায় বালুর বস্তা এবং কংক্রিট ব্লক স্থাপন। অন্যান্য সহায়তা কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে নগদ অর্থ, শুকনো খাবার, স্বাস্থ্য সুরক্ষার সরঞ্জাম, শুকনো বীজ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা সহায়তা, অটোরিক্সা এবং ইঞ্জিনচালিত নৌকা প্রভৃতি সরবরাহকরণ, অক্ষম মানুষের জন্য সহায়ক সরঞ্জাম এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, অক্ষম ভাতা প্রদান, রোগ ও দুর্যোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি কর্মসূচী পরিচালনা, নারীদের অধিকার এবং অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ প্রদান এবং দুর্গত জনগোষ্ঠীর জীবিকার উন্নয়নে কৃষি প্রশিক্ষণ প্রদান। গবেষণাটি থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, উত্তরদাতারা নদীভাঙ্গন সঙ্কট মোকাবেলায় শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণ এবং জীবিকার বৈচিত্র্য সৃষ্টিকরণের উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। গবেষণা থেকে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, নদী ভাঙ্গন আমাদের দেশের অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুতি এবং বসতি স্থানান্তরণের প্রধানতম কারণগুলোর একটি। বিভিন্ন গবেষণায় বাস্তুচ্যুতির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও আশ্চর্যজনকভাবে নদী ভাঙ্গনজনিত বাস্তুচ্যুতি অথবা বসতি স্থানান্তরণ সঙ্কট মোকাবেলায় জাতীয় অথবা বৈশ্বিক কোন পর্যায়েই সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা নেই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জলবায়ুঘটিত বাস্তুচ্যুতির বিষয়টি ১৩তম ও ১৬তম জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনায় আসে। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত ১৮তম জলবায়ু সম্মেলনের ‘লস এ্যান্ড ড্যামেজ ওয়ার্ক প্রোগ্রামে’ এ অন্তর্ভুক্ত হয় এবং জলবায়ু সম্মেলনের প্রক্রিয়ার কল্যাণে এই ইস্যুটিতে সামান্য কিছু প্রক্রিয়াগত অগ্রগতি সাধিত হয় ২০১৮)। ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত ২৩তম জলবায়ু সম্মেলনে বাস্তুচ্যুতি এবং স্থানান্তরণ বিষয়ক একটি টাস্কফোর্স গঠিত হয়। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব চিহ্নিতকরণ, হ্রাসকরণ এবং এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ প্রদানের দায়িত্বটিও এই টাস্ক ফোর্সের উপর অর্পিত হয়। বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনপ্রসূত স্থানান্তরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য একটি জাতীয় কৌশল প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত এই ধরনের উদ্যোগগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের সঙ্কট মোকাবেলায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। গবেষণাটি থেকে প্রাপ্ত উপাত্তের আলোকে জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ের নীতি নির্ধারকদের বিবেচনার্থে পাঁচ দফা সুপারিশ প্রদান করা হয়। এগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ, জীবিকার বহুমাত্রিক করণ, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মতো বিষয়গুলোসহ জলবায়ুঘটিত স্থানান্তরণ সমস্যা রোধে একটি বিশদ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে; নদী ভাঙ্গন সমস্যার টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্র ণালয়গুলোর অংশগ্রহণে একটি উচ্চপর্যায়ের সমন্বয় কমিটি গঠন করতে হবে; বাংলাদেশের নদী ভাঙ্গনের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে নতুন বসতি স্থাপন রোধ করতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য অঞ্চলে স্থানান্তর ও পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; দেশের তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনসমূহ যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় এবং জাতীয় সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলো, উন্নয়ন অংশীদার, গবেষক, একটিভিস্টসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সম্পৃক্ত করে জাতীয় পর্যায়ে একটি ‘জলবায়ু অভিজ্ঞাতে অভিবাসন অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ সেল’ গঠন করতে হবে, যা স্থানান্তরিত মানুষের সঠিক সংখ্যা এবং তাদের গন্তব্যস্থল সংক্রান্ত তথ্য অনুসন্ধান ও সংরক্ষণে নিয়োজিত হবে; এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বাধ্য হয়ে অভিবাসী (দেশের রাজনৈতিক সীমানার ভেতরের এবং বাইরে) মানুষগুলোর জন্য নায্য অধিকার নিশ্চিতকরণের জন্য জলবায়ুসংক্রান্ত বৈশ্বিক আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্র একটি আইনী প্রোটোকল প্রণয়নে বিশ্ব সম্প্রদায়কে চাপ দিতে হবে।
×