ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘আর তো আমার পুত নাতি ভাইসা যাইত না’

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ২৪ জানুয়ারি ২০২১

‘আর তো আমার পুত নাতি ভাইসা যাইত না’

মোরসালিন মিজান, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ॥ মানুষগুলো, কী আশ্চর্য, এখনও কাঁদছে! কদিন আগেও জলে ভাসা পদ্মের মতো জীবন ছিল তাদের। কোথাও ঠাঁই হচ্ছিল না। বেঁচে থাকার বয়স যত, তত বছর ধরে ভাসছে। ভাসতে ভাসতে যখন চূড়ান্তভাবে তলিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে ঠিক তখন অদ্ভুত অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। কূল খুঁজে পেল চির বঞ্চিতরা। এখন তারা একটি আস্ত বাড়ির, শুধু তো বাড়ি নয়, জমিরও মালিক। সেমিপাকা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখ করে তাকাচ্ছেন আর ভাবছেন নিজের একটি ঠিকানা হলো, ছাদ হলো, সত্যিই কি হলো? সকল রেইস থেকে ছিটকে পড়া জীবনে এত বড় চমকও আসে ? আসতে পারে? ভাবতে ভাবতেই দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। এ জল আসলে জলের অধিক। আনন্দ অশ্রু। শনিবার সরকারের পক্ষ থেকে বাড়ি হস্তান্তরের পর কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একাধিক আশ্রায়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে এমন অনেক আবেগঘন দৃশ্য। এদিন দুই জেলার ভূমিহীন গৃহহীন দেড় হাজারের বেশি পরিবারকে মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে ঘর প্রদান করা হয়। এরপর থেকে আরও বেশি করে সামনে আসতে থাকে হতদরিদ্র মানুষগুলোর জীবন সংগ্রাম ও নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। মনের শোকে এতকাল কেঁদেছেন তারা। এখন সে কান্না বদলে সুখের হয়েছে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার দীঘিরপাড়ে ঘর বুঝে পেয়েছে ২৫টি পরিবার। সরেজমিন সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অদ্ভুত এক আবেগঘন পরিবেশ। ভাগ্যের কাছে বারবার মার খাওয়া মানুষগুলোর মন যেন এখনও বিশ্বাস করতে চায় না তাদের ঘর হয়েছে। হয়ত তাই কেউ নিজের বাড়ির ভেতরটা বারবার ঘুরে ফিরে দেখছিলেন। কেউ আবার বাইরের ছোট বারান্দায় বসে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর উপহার পাওয়ার পর সামাজিকভাবেও গুরুত্ব বেড়েছে তাদের। কত ডিসি এসপি ইউএনও উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আসছেন তাদের বাড়ির আঙিনায়! টেলিভিশনের ক্যামেরা গুনে শেষ করা যায় না। এটা ওটা জানতে চান গণমাধ্যমকর্মীরা। উত্তরে ঠিক কী বলবেন, কীভাবে বলবেন, ভেবে পান না তারা। এ অবস্থায় লম্বা সময় হাঁটু গেড়ে তাদের সঙ্গে বসে থেকে কথা বের করতে হয়। আর তখনই জানা যায়, এখানে আশ্রয় পাওয়া অধিকাংশ মানুষ নদী ভাঙনের শিকার। কোন কোন পরিবার পাঁচ থেকে আটবার ভাঙনের শিকার হয়েছে। ঘোড়াউত্রা নদী তাদের নিঃস্ব করে ছেড়েছে। শনিবার ঘর বুঝে পাওয়া নারীদের একজন শাহজাহান খাতুন নামের এক বৃদ্ধা মোট তিনবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন বলে জানান। তার আগে একটু একটু করে কথা জমে ওঠে তার সঙ্গে। বয়স কত হলো, খালা ? জানতে চাইলে তার কণ্ঠে শিশুর সারল্য। বলেন, ‘বয়স, বাবা, আনহেরাই কইন (আপনারাই বলুন)। সংগ্রামের আগে অইছি। আইয়ুব খানের যুদ্ধ দেখছি। মুক্তি (বীর মুক্তিযোদ্ধা) দেখছি। রেজাবাহিনী (রাজাকার বাহিনী) দেখছি। আর মজিবুর তো এই সময় রাষ্ট্র চালাইত।’ স্বাধীনতাযুদ্ধের পর পর শাহজাহান খাতুনের নিজের সংগ্রাম শুরু হয়। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, দুই বছরের মাথায় স্বামীর মৃত্যু হয়। গর্ভে তখন তিন মাসের সন্তান। মাটি কাটার কাজ করে, মানুষের বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করে, ধান কুড়িয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছেন। এভাবে একাই সন্তানকে বড় করেছেন। কিন্তু ভাগ্য বদলাতে পারেনি সন্তানও। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, ‘আমরারে গাঙ্গে বানাইছে বাবা সর্বহারা।’ তার একটি বর্ণনা শুনে গা শিউরে ওঠে। বৃদ্ধা জানান, একবার রোজার মাসে সেহরী খেয়ে ঘুমিয়েছেন তারা। হঠাৎ ঘর কেঁপে ওঠলে ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ খুলে দেখেন, ঘরের বেড়ার নিচ দিয়ে হাড়িপাতিল আর তার শিশু নাতিটি ভেসে যাচ্ছে। ঝাপিয়ে পড়ে জলের নিচ থেকে তাকে তুলে আনেন তিনি! এখন ঘর পেয়ে তার মনে ভীষণ আনন্দ। বলেন, ‘আর তো আমার পুত (পুত্র) নাতি ভাইসা যাইত না।’ আমি আর কয়দিন বাঁচমু? মইরা গেলে পুতে থাই পাইবো (মরে গেলে ছেলে ঠাঁই পাবে)। কইবো নে, আমার মার উছিলায় বাড়ি পাইছি।’ প্রকল্পের ১৩ নম্বর বাড়িটি বুঝে পেয়েছেন নদী ভাঙনে নিঃস্ব আব্দুল আওয়াল ও রুবিনা দম্পতি। প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আওয়াল বলছিলেন, ‘পানি বাড়লে চাঙ বাইন্দা ঘুমাইছি। চাঙ-ও ভাইঙ্গা নিছে পানিয়ে।’ এহন এইহান আমরার একটা স্থান অইছে। নুন খাই ফ্যান খাই, যেইডই খাই, ঘরের মইধ্যে আয়া থাকতা ফারুম। এর থাইক্যা আর শান্তি পৃথিবীর মধ্যে কেডা দিব? কেউ না। কেউ দিব না।’ রুবিনার চোখে ততক্ষণে জল। আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে তিনি বলছিলেন, ‘অনেক কষ্ট করছি। নির্যাতিত অইছি। ভিতরটা অতোদিন ছুডু আছিল। এহন বড় হইছে। খাই বা নাই ঘরে ঘুমাইতে পারমু।’ স্বামী পরিত্যক্তা সোমাও এখানে একটি ঘর পেয়েছেন। অতীতের দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলছিলেন, বাচ্চা জন্মের পর তাকে ফেলে রেখে স্বামী চলে গেছে। আর আসেনি। তারপর থেকে বেঁচে থাকার লড়াই। তার ভাষায়Ñ ‘কত ঝাড়ু হাছুনের বাড়ি খাইয়া মাইনষের বাড়িত থাকছি! ছয় মাস পাঁচ মাস পরে পরে বাড়ি ছাড়ন লাগছে। আর আইজ...।’ কথা শেষ করতে পারেন না তিনি। ময়লা আঁচল টেনে চোখের ওপর চেপে ধরেন। সুখ ও দুঃখের কান্না এভাবে একাকার হয়ে যায়। একইভাবে কাঁদলেন সালমা বেগম। বললেন, ‘কত লাত্থি উষ্ঠা খাইছি গো জীবনে। আজকে ঘর পায়া ঈদের দিন মাইনষে আনন্দ করে না? হেই ঈদের মতো মনে আনন্দ হইছে।’ আশ্রয়ণ প্রকল্পের এ কাজে অনেকদিন ব্যস্ত ছিলেন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, জেলায় মোট ৬১৬টি গৃহ হস্তান্তর করা হয়েছে। বাড়ি পাওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকেই মানুষগুলো খুশি। নতুন করে বাঁচার শক্তি পেয়েছে। এই আনন্দ ধরে রাখতে ঘরের বাসিন্দাদের জন্য ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় মোট ১০৯১টি গৃহ হস্তান্তর করা হয়েছে। কুলাউড়ার একটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর বুঝে পেয়েছে ৪৫টি পরিবার। সরেজমিন সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অনেকে বাসার ভেতরে চৌকি বসানোর কাজ সেরে ফেলেছেন। কেউ কেউ বাড়ির সামনে চারাগাছ লাগিয়েছেন। সব দেখে বোঝা যায়, ভীষণ ভাল আছেন তারা। বৃদ্ধ নূরু মিয়া বলছিলেন, সারাজীবন কত কষ্ট করলাম। কোন আশ্রয় আর পাই না। ‘নিজে জমিন কিনতা ফারছি না। বাফেও দিয়া গেছে না। ব্যবসা করতে গিয়াও লস দিসি। সব শ্যাষ কইরা খালি মরার বাকি আছিন। ঘরডা ফাইয়া বাঁচছি। স্বামী পরিত্যাক্তা মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে নিজের ঘরে বাস করবেন বলে জানান তিনি। জাহানারা নামের আরেক উপকারভোগী বলছিলেন, ‘এহনকার দিনে ছেলে মেয়েরা বিয়ে শাদী করলে কি আর মা বাপরে দেহে? ছেলে কুমিল্লায় গার্মেন্টস করে। বউ নিয়া তাহে। অহন প্রধানমন্ত্রী সাব ঘর দিছে। অহন আমরা শান্তিতে মরতাম ফারমু। কথা বলতে বলতে কণ্ঠ বুজে আসে তার। ‘এতো সুখ সইবো কেমন করে/বুঝি কান্নাই লেখা ছিল ভাগ্যে আমার/সুখেও কান্না পায় দুচোখ ভরে...। সেই কান্না যেন নেমে আসে জাহানারার চোখে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে দিন রাত কাজ করেছেন। সে অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, এই কাজ করতে গিয়ে আমাদের বহু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। খাস জমির ওপর প্রভাবশালী চক্রের নজর থাকে। নানা ঝামেলা বাধাতে আসেন অনেকে। আমরা এসব মোকাবেলা করে এগিয়ে গেছি। অসহায় মানুষগুলোর মুখে হাসি দেখে তার নিজেরও মনে প্রশান্তি হয় বলে জানান তিনি। হবিগঞ্জে এদিন মোট ৭৮৭টি পরিবারকে ঘর প্রদান করা হয়। সকালে চুনারঘাট উপজেলার ইকরতলী গ্রামের আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, ৭৪টি পরিবারের কয়েকশ’ মানুষ উপস্থিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন। ফলে সবার মাঝেই আলাদা আবেগ উত্তেজনা কাজ করছিল। প্রধানমন্ত্রীর সামনে একজন উপকারভোগী তার অনুভূূতি ব্যক্ত করেন। বাকিদের বুকেও অনেক কথা জমা ছিল। তারও বেশি কান্না। রফিকুন্নেসা জয়তুন নামের এক বৃদ্ধা জনকণ্ঠকে বলছিলেন, ‘আমার স্বামী মারা গেছে বহু বছর আগে। আত্মীয় স্বজন কেউ নাই। বহু কষ্টের জীবন। আমার মেয়েটাও শ্বশুর বাড়িতে কষ্ট করতাসে। জামাইডা যৌতুক চায়। দিতা ফারি না। এর লাগি মারে। নির্যাতন করতে করতে আমার মেয়ের অঙ্গ পচাইয়া ফালাইছে।’ পরের কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘অখন একটা ঘর অইছে। মাইয়াডারে লইয়া থাকতাম ফারমু’। শামসুন্নাহার নামের আরেক নারীর স্বামী এখন পঙ্গু। তিনি বলছিলেন, ‘স্বামীরে এখন অন্তত ঘরে রাইখা কাজে যাইতা ফারমু। আমার ওজনডা একটু কমাইয়া দিসোইন শেখ হাসিনা’। কথা বলতে বলতে চোখ মুছেন তিনি। একটা হাসি খেলে যায় তার মুখে। এভাবে একদিনে ৬৬ হাজার মানুষের কান্না হাসিতে বদলে দিয়েছে অভূতপূর্ব ইতিহাস গড়ল বাংলা।
×