ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৫ দফা নির্দেশ আইজিপির অতিরিক্ত আইজিপিকে প্রধান করে কমিটি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের প্রত্যাশা

পুলিশ যাবে মানুষের কাছে ॥ সারাদেশে ওয়ার্ড পর্যায়ে বিট পুলিশিং

প্রকাশিত: ২২:৩৪, ৩০ ডিসেম্বর ২০২০

পুলিশ যাবে মানুষের কাছে ॥ সারাদেশে ওয়ার্ড পর্যায়ে বিট পুলিশিং

শংকর কুমার দে ॥ জনগণকে আর পুলিশের কাছে যেতে হবে না, সেবা নিয়ে পুলিশ যাবে মানুষের কাছে। এই ধারণা সামনে রেখে সারাদেশে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে চালু হচ্ছে বিট পুলিশিং। পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। এজন্য স্থায়ী কার্যপ্রণালী বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) তৈরির জন্য অতিরিক্ত আইজিপি কামরুল আহসানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদ পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ কথা বলেছেন, এমন একটি ব্যবস্থা চালু করতে চাই, যাতে জনগণকে পুলিশের কাছে আসতে না হয়। বরং পুলিশই জনগণের কাছে সেবা নিয়ে যাবে। আর সেই ব্যবস্থা হচ্ছে বিট পুলিশিং। সারাদেশে বিট পুলিশিং ব্যবস্থা চালু করে আমরা মানুষের কাছে যেতে চাই। মানুষের হৃদয় জয় করতে চাই। করোনার সময় জনগণের কাছ থেকে পাওয়া ভালবাসা ধরে রাখতে চাই। পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদ বিট পুলিশিংয়ের জন্য যে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন তাতে রয়েছে, পুলিশকে দুর্নীতিমুক্ত হওয়া, মানুষকে নির্যাতন করা থেকে বেরিয়ে আসা, মাদকের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা, সারাদেশে বিট পুলিশিং চালু করা ও কর্মরত অবস্থাতেই পুলিশের কল্যাণ নিশ্চিত করা। এই পাঁচ দফা বাস্তবায়নের জন্য বিট পুলিশিং সারাদেশের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতিতে সবাইকে যখন বেশি করে ঘরে বন্দীর মতো থাকতে হয়েছে, তখন মানুষকে সেবা দিতে রাস্তায় নেমে প্রায় ২০ হাজার পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন আশি জন। করোনার মধ্যে বিভিন্নভাবে সেবা দিতে পেরে সাধারণ মানুষের ভালবাসা এবং জনতার পুলিশ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে এই বাহিনী। এই ভালবাসা ও খ্যাতি ধরে রাখতে মানুষের আরও কাছাকাছি যেতে চান তারা। তাই ‘বিট পুলিশিংকে’ মানুষের কাছে যাওয়ার অন্যতম উপায় বিবেচনা করা হচ্ছে। বিট পুলিশিং ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্প্রসারিত করার কাজ এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। ২০১৭ সালে সিলেট রেঞ্জের বিভিন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়নে ‘সম্প্রসারিত বিট পুলিশিং’ নাম দিয়ে কাজ শুরু করেন তখনকার সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি কামরুল আহসান। তিনি ক্রাইম নোট বুকের পরিবর্তে নির্ধারিত ছকে মাসিক প্রতিবেদন নিতেন বিট পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে। এতে অপরাধ দমনে তিনি ব্যাপক সুফল পান এবং জনগণের কাছে প্রশংসিত হয় পুলিশ। সেই সফলতার ধারণা থেকেই এখন সারাদেশে স্থায়ীভাবে বিট পুলিশিং কার্যক্রম চালু করার কাজ শুরু করেছে পুলিশ সদর দফতর। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলামের নির্দেশে রাজধানী ঢাকায় বিট পুলিশিং পদ্ধতিকে আরও জোরালো ও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। পুলিশের কাছে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা রয়েছে তা পূরণে বিট পুলিশিং একটি চমৎকার পদ্ধতি প্রয়োগ করার জন্য পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ তার অধীক্ষেত্রকে প্রায় ৪৮০টি বিটে ভাগ করেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন প্রতিষ্ঠার লগ্নেই তৎকালীন অধিক্ষেত্রকে বিটে ভাগ করা হয়েছিল। বর্তমানে তা সম্প্রসারণ করা হয়েছে মাত্র। ডিএমপি কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলামের নির্দেশে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বিট পুলিশিং বাস্তবায়ন শুরু করেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, বিট পুলিশিং পদ্ধতি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রয়োগ করে বেশ সুফল পাওয়া গেছে। জঙ্গী তৎপরতা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, মাদক ব্যবসা, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা, ইভটিজিং ও বাল্য বিয়ের মতো কাজগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এতে ওইসব এলাকায় পুলিশ সাধারণ মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। সেই ধারণা থেকেই বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে জনতার কাছে যেতে চায় পুলিশ। জনগণের সেবা বাড়াতে বিট পুলিশিংকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে প্রায় সাত থেকে সাড়ে সাত হাজার সাব ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তার প্রয়োজন হতে পারে। প্রত্যেকটি ইউনিয়ন পরিষদ ক্যাম্পাসে বিট পুলিশের একটি কার্যালয় থাকবে। যার দায়িত্বে থাকবেন সাব ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। সেজন্য বিট পুলিশিং পরিচালনায় স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) বা স্থায়ী কার্যপ্রণালী তৈরির কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদের অনুমোদন ও নির্দেশনা পাওয়া গেলেই এসওপি তৈরি করে কাজ শুরু করে দেয়া হবে বলে জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, বিট পুলিশের মূল কাজ হবে অপরাধীদের তথ্য সংগ্রহ করে থানা পুলিশকে সহায়তা করা। এলাকায় অপরাধী কারা, কী ধরনের অপরাধ হচ্ছে এবং জামিনে বেরিয়ে এসে অপরাধীরা আবার একই অপরাধ করে কিনা, মাদক ব্যবসায়ী কিংবা জঙ্গীদের অপতৎরতাসহ নানামুখী অপরাধের দিকেও লক্ষ্য রেখে সেসব তথ্য থানাকে অবহিত করতে হবে বিট পুলিশকে। এছাড়া কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থাও এর মাধ্যমে শক্তিশালী করা সম্ভব হবে। গোয়েন্দা ইউনিটগুলোর পাশাপাশি অপরাধীর তথ্য সংগ্রহে বিট পুলিশিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিট পুলিশিং কী ॥ বিট পুলিশিং হচ্ছে একটি থানার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ। কাজের সুবিধার্থে ছোট ছোট এলাকায় ভাগ করে ২০১০ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) বিট পুলিশিং ব্যবস্থা চালু করে। বর্তমানে ডিএমপিতে পুলিশের তিন শতাধিক বিট রয়েছে। একজন সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) কিংবা এ্যাসিসটেন্ট সাব ইন্সপেক্টরের (এএসআই) নেতৃত্বে তিন থেকে পাঁচজন কনস্টেবল দেয়া হয় প্রতি বিটে। সরবরাহ করা হয় ক্রাইম নোট বুক। ক্রাইম নোট বুকের মাধ্যমে নিয়মিত প্রতিবেদন নেবেন উর্ধতন কর্মকর্তারা। বিট পুলিশিং হলো কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কিছু নির্দিষ্টসংখ্যক বা বিশেষ পুলিশ সদস্যদের স্থায়ীভাবে দায়িত্ব পালন করা। আমাদের শহর এলাকাগুলোকে কয়েকটি বিটে ভাগ করে প্রত্যেকটি বিটের দায়িত্ব ওই স্থানে অবস্থিত পুলিশ ফাঁড়ির ওপর ন্যস্ত করা হয়। এ ধারণাটি এসেছে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের কার্যপদ্ধতি থেকে। জাপানের কোবান পদ্ধতিতেও প্রতিটি কোবান বা পুলিশ বক্সের অধীন একটি নির্দিষ্ট এলাকা রয়েছে। এসব এলাকায় কিছু পুলিশ অফিসার উর্ধতন কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে নিজস্ব বিবেচনা শক্তি প্রয়োগ করে সেই এলাকায় পুলিশিং করে থাকেন। এক্ষেত্রে তিনি তার নির্ধারিত এলাকায় অপরাধ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এলাকাবাসীর নিকট গৃহ-ডাক্তারের মতোই কাজ করেন। কোবান, বিট বা কমিউনিটি পুলিশিং অফিসার এলাকার মানুষের কাছে তাদের নিজেদের পুলিশ অফিসার বলেই প্রতীয়মান হবে। তিনি এলাকাবাসীদের সঙ্গে স্থানীয় সুখ-দুঃখের অংশীদার হবেন। তিনি এলাকায় কেবল আইন প্রয়োগ বা শৃঙ্খলা রক্ষা নয়, এলাকার সকল সমস্যা সমাধানের নিয়ামক শক্তি বা প্রভাবক হিসেবে কাজ করবেন। দেওয়ানি, ফৌজদারি, সামাজিক, পারিবারিক এমনকি রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও একজন কমিউনিটি/বিট পুলিশিং অফিসারকে এগিয়ে আসতে হবে এবং জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, সারাদেশের মধ্যে অনেক প্রত্যন্ত এলাকা রয়েছে যেখান থেকে মানুষ চাইলেই দ্রুত থানা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না। কোথাও কোথাও ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয় থানা পর্যন্ত যেতে। আইনশৃঙ্খলাজনিত বড় ধরনের কোন সমস্যার সৃষ্টি না হলে পুলিশও সেসব দূরবর্তী এলাকায় টহলে যেতে চান না। ফলে জনগণের সঙ্গে পুলিশের দূরুত্ব তৈরি হয়। সৃষ্টি হয় অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা ও ভুল বোঝাবুঝির। আর পুলিশের অনিয়মিত উপস্থিতির সুযোগে অপরাধীরাও সক্রিয় হয়ে ওঠে। গ্রাম্য টাউট-বাটপারদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে ইউনিয়ন পর্যায়ে বিট পুলিশিং ব্যবস্থা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে এসব অপরাধ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
×