ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১৬৪ ধারায় দুই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর জবানবন্দী

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের কথা স্বীকার করল মাদ্রাসার দুই ছাত্র

প্রকাশিত: ২২:০১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের কথা স্বীকার করল মাদ্রাসার দুই ছাত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা, কুষ্টিয়া, ১৩ ডিসেম্বর ॥ কুষ্টিয়ায় বহুল আলোচিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙ্গার ঘটনায় গ্রেফতার ও পুলিশ রিমান্ডে থাকা চার আসামির মধ্যে দুই শিক্ষার্থী আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। কওমী মাদ্রাসার ওই দুই শিক্ষার্থীকে পাঁচদিন রিমান্ড শেষে জবানবন্দী প্রদানের জন্য রবিবার বিকেলে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দেলোয়ার হোসেনের আদালতে নেয়া হয়। এরা হলেন, কুষ্টিয়া শহরের জুগিয়া মাদারশাহ পশ্চিমপাড়া এলাকার ইবনি মাসউদ (রা.) মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের দুই ছাত্র ও মামলার অন্যতম আসামি সবুজ ইসলাম ওরফে নাহিদ (২০) ও আবু বক্কর ওরফে মিঠন (১৯)। জবানবন্দীতে তারা ভাস্কর্য ভাঙ্গার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থাকার কথা স্বীকার করেছেন। জবানবন্দী শেষে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। এর আগে শনিবার বিকেলে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী প্রদান করে মামলার অপর দুই আসামি একই মাদ্রাসার শিক্ষক আল আমিন (২৭) ও ইফসুফ আলী (২৬)। গত ৮ ডিসেম্বর আসামি দুই ছাত্রকে পাঁচদিন ও দুই শিক্ষককে চারদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। পুলিশ সূত্র জানায়, বেলা দুইটার দিকে দুই মাদ্রাসা শিক্ষার্থী সবুজ ইসলাম ওরফে নাহিদ ও আবু বক্কর ওরফে মিঠনকে পুলিশের কড়া পাহারায় আদালতে নেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি (তদন্ত) নিশি কান্ত সরকার। এরপর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দেলোয়ার হোসেন তার খাসকামরায় প্রথমে সবুজ ইসলাম নাহিদের জবানবন্দী নেন। ঘণ্টাব্যাপী জবানবন্দী শেষে আলাদাভাবে আবু বক্কারের জবানবন্দী নেয়া হয়। বিকেল সাড়ে পাঁচটার পরে জবানবন্দী শেষে পুলিশের কড়া পাহারায় প্রিজনার্স ভ্যানে করে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, জবানবন্দীতে আসামি ওই দুই শিক্ষার্থী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা আদালতে স্বীকার করেছেন। একটি সূত্র জানায়, ‘আদালতে আবু বক্কার ও নাহিদ তাদের জবানবন্দীতে বলেছে, সম্প্রতি দেশে মূর্তি ও ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে নানা বয়ান হচ্ছে। এর মধ্যে মামুনুল হকের বয়ান তাদের কাছে বেশি ভাল লাগে। গত ৩ ডিসেম্বর তারা শহরের কেনাকাটা করতে এসে দেখে পাঁচ রাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বানানো হচ্ছে। পরদিন জুমার নামাজে একটি মসজিদে তারা ভাস্কর্য ও মূর্তি ইসলামে হারাম বলে বয়ানে শুনতে পায়। এরপর তারা দুইজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পাঁচ রাস্তার মোড়ে ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলবে। এরপর তারা রাত ১২টার দিকে রেডি হয়ে দুই রাকাত নামাজ শেষে মাদ্রাসায় মিস্ত্রিদের রেখে যাওয়া দুটি হাতুড়ি নিয়ে রওনা হয়। পথিমধ্যে পুলিশের গাড়ি দেখে তারা মূল সড়ক দিয়ে না এসে ভেতরের সড়ক হয়ে মজমপুর গেটে এসে রেললাইন ধরে হেঁটে থানা মোড় হয়ে পাঁচ রাস্তার মোড়ে আসে। সেখানে মই বেয়ে উপরে উঠে ৭ থেকে ৮ মিনিটের বেশি সময় ধরে কিছু অংশ ভেঙ্গে চলে যায়। মাদ্রাসায় ফেরার পর আবদুল্লাহ নামের এক ছাত্র দেখে ফেলে। তার মাধ্যমে সকলে জেনে যায়। পরে শিক্ষকরা বললে আমরা পালিয়ে বাড়ি চলে যায়’। এর আগে গত শনিবার জবানবন্দীতে শিক্ষক ইউসুফ আলী জানান, তিনি মাদ্রাসা ইবনে মাসউদ কুষ্টিয়াতে হেফজ বিভাগে শিক্ষকতা করেন। ওই বিভাগের ১৭ জন ছাত্র পড়াশোনা করে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের ঘটনায় অভিযুক্ত আবু বকর ও নাহিদ একই বিভাগের শিক্ষার্থী। গত ৫ ডিসেম্বর শনিবার সকাল সাড়ে ৮টায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুরের ঘটনার সঙ্গে তাদের যুক্ত থাকার বিষয়টি তিনি জানতে পারেন। পরে তাদের মাদ্রাসা থেকে নিজ নিজ বাড়িতে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরবর্তী সময়ে পুলিশ ভাংচুরের ঘটনায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজ তাদের দেখালে অভিযুক্ত দুইজনকে চেনা সত্ত্বেও তারা স্বীকার করেননি। অপর শিক্ষক আল আমিনও একইভাবে জবানবন্দী দিয়েছেন। তবে তিনি জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছেন, ওই মাদ্রাসায় সবাই মোবাইলে ওয়াজ শোনে। বিশেষ করে মামুনুল হক, হাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী, খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবীসহ অন্যদের ওয়াজ শুনতে ভাল লাগত। এই মাদ্রাসার শিক্ষকও একইভাবে অভিযুক্ত দুই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে মাদ্রাসা থেকে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। প্রসঙ্গত, কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে পৌরসভার নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য গত ৪ ডিসেম্বর রাত দুইটার দিকে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা ও কালো কোট পরা দুই ঘাতক হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে সেটির ডান হাত, পুরো মুখমণ্ডল ও বাঁ হাতের অংশবিশেষ ভেঙ্গে ফেলে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ভাস্কর্য ভাঙ্গার ঘটনায় জড়িত দু’জনকে শনাক্ত এবং ৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে অভিযান চালিয়ে ইবনি মাসউদ (রা.) মাদ্র্রাসার হেফজ বিভাগের ওই দুই শিক্ষার্থীকে তাদের গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। এদিকে ঘটনায় জড়িত ওই দুই ছাত্রকে মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়ার অভিযোগে পরে একই মাদ্রাসার দুই শিক্ষককেও গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে শিক্ষার্থী আবু বক্কর ওরফে মিঠন কুষ্টিয়া মিরপুর উপজেলার শিংপুর গ্রামের সমশের মৃধার ছেলে। আর সবুজ ইসলাম ওরফে নাহিদ দৌলতপুর উপজেলার গোলাবড়িয়া গ্রামের শামসুল আলমের ছেলে। শিক্ষকদের মধ্যে ইউসুফ আলী পাবনার দিয়াড় বামুন্দি গ্রামের আজিজুল মণ্ডলের ছেলে এবং আল আমিন কুষ্টিয়া মিরপুর উপজেলার ধুবইল গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে।
×