ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজ নবান্ন উৎসব

প্রকাশিত: ২২:০৮, ১৬ নভেম্বর ২০২০

আজ নবান্ন উৎসব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ফসলকেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় প্রাচীন ও বর্ণাঢ্য উৎসবের দিনটি চলে এলো। আজ সোমবার ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। হেমন্তের দ্বিতীয় মাস শুরুর দিনে গোটা দেশজুড়েই আয়োজন করা হবে নবান্ন উৎসবের। ফসল ঘরে তোলার আনন্দে মাতবে গ্রামবাংলা। নতুন চালে হবে নবান্ন। চলবে পিঠাপুলির আয়োজন। বাদ যাবে না রাজধানী শহরও। ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আজ বিকেলে নাগরিক নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হবে। লোকায়ত জীবন ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জয়গান করা হবে উৎসব মঞ্চ থেকে। শহুরে প্রলোভন কর্পোরেট সংস্কৃতি আর নিজেকে ভুলে থাকার এই সময়ে আলাদা তাৎপর্যের হয়ে উঠেছে নবান্ন উৎসব। গ্রামের নরম মাটিতে নাড়ি পুঁতে আসা বাঙালী স্মৃতিতে হলেও গ্রামে ফিরে যাবে। শহর, গ্রাম সর্বত্রই লাগবে হাসিরাশি আনন্দের ঢেউ। অবশ্য আরও আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ফসলের হেমন্ত। কার্তিকের প্রথমদিন নতুন ঋতুকে স্বাগত জানানো হয়। এক সময় কার্তিককে বিদেয় করা সহজ ছিল না। মরা কার্তিকে এসে কৃষকের গোলা শূন্য হয়ে যেত। খাবারের অভাব দেখা দিত। সবাই তখন তাকিয়ে থাকত অগ্রহায়ণের পানে। তবে যতদিন গেছে ততই বদলে গেছে হিসেব-নিকেষ। কার্তিক আর আগের মতো নেই। এ মাসেও পাওয়া যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ ধান। বস্তুত শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে এখন মোটামুটি সারাবছরই ব্যস্ত থাকেন কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। আয় রোজগারও ভাল। কার্তিক মাসে রিষ্পপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে আগাম আমন ধান কাটার উৎসব। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে ফসল কাটা ও মারাইয়ের কাজ চলছে পুরোদমে। বরগুনা, রংপুর, নীলফামারীসহ কয়েকটি জেলার কৃষক ব্যস্ত সময় পার করছেন এখন। কৃষকরা বাড়তি লোক নিয়ে ফসলের মাঠে যাচ্ছেন। দিনভর চলছে ধান কাটা। তারপর ফসল কাঁধে বাড়ি ফিরছেন। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমান কৃষাণি। ধান মাড়াই, শুকিয়ে ঘরে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খুশি মনেই অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে তাদের। তবে মূল অপেক্ষা ছিল অগ্রহায়ণের। অগ্রহায়ণ মানেই আমন ধান কাটার মাস। ফলন ও উৎপাদনে বোরোর চেয়ে আমন পিছিয়ে থাকলেও, প্রতিবছর এর উৎপাদন বাড়ছে। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, গতবছর আমনের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৪০ লক্ষ টন, যা মোট উৎপাদনের ৩০ শতাংশ। এবারও বাম্পার ফলন হয়েছে বলেই জানা যাচ্ছে। আজকের নবান্ন উৎসব তাই জমে ওঠবে বলেই আশা। নবান্ন মানে নতুন অন্ন। নতুন চালের রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। হাজার-হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা যখন চালু হয়েছিল, অনুমান করা হয়, তখন থেকেই নবান্ন উৎসব উদ্যাপন হয়ে আসছে। ঘরে ফসল তোলার আনন্দে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো। ফসল কাটার আগে কৃষকরা বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখতেন। বাকি ধান থেকে চাল করে সে চালে পায়েস করা হতে। এ ছাড়াও নবান্ন উৎসবের দিন গৃহস্থ বাড়িতে নানা পদ রান্না হতো। শাক, ভর্তা, ভাজিসহ কুড়ি থেকে চল্লিশ পদের তরকারি রান্না করা হতো কোন কোন বাড়িতে। যতদূর তথ্য, হাজার-হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা চালু হবার পর থেকেই নবান্ন উৎসব পালন হয়ে আসছে। তখন থেকেই ঘরে ফসল তোলার আনন্দে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। লোককবির ভাষায় : আইলো অঘ্রাণ খুশিতে নাচে প্রাণ/ চাষী কাচিতে দিলো শান/ কাচি হাতে কচ কচা কচ কাটে চাষী পাকা ধান...। নতুন এই ধান ঘরে তোলার পর আয়োজন করা হয় নবান্ন উৎসবের। সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, নবান্ন উৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় কিছু আনুষ্ঠানিকতাও যোগ হয়। হিন্দুরা নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করেন। পার্বণ বিধি অনুযায়ী হয় শ্রদ্ধানুষ্ঠান। শাস্ত্রমতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়। কে চায় অমন পাপ করতে! অমুসলিম রীতিতে, নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে। আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন। নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা বিশেষ লৌকিক প্রথা। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে ‘কাকবলী’। অতীতে পৌষসংক্রান্তির দিনও গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল। কাকবলীর আগে আরও তিনটি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার নিয়ম রয়েছে। সেগুলো হচ্ছেÑ লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ ও বীরবাশ। বীরবাশের প্রথা মূলত বরিশাল অঞ্চলের। এর নিয়মানুযায়ী, বাড়ির উঠানের মাঝখানে একটি গর্ত করা হয়। তার চারপাশে পিটুলী দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। এরপর গর্তে জ্যান্ত কই মাছ ও দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোঁতা হয়। সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে বাঁধা হয় ধানের ছড়া। নবান্ন উৎসবে কাকবলী, লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ হয়ে গেলে সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন। এর আগে কেউ কিছু মুখে নেন না। অবশ্য এখন অনেক কিছুই বদলে গেছে। সনাতন মাড়াই প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। যন্ত্রযুগে প্রবেশ করেছে গ্রাম। কৃষি ছাড়াও আয়ের অনেক উৎস সৃষ্টি হয়েছে। চাকরির সুযোগ বেড়েছে। সম্প্রসারিত হয়েছে ব্যবসা। অল্পে বেশি মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। শুধু তাই ধানের জমির দিকে আর তাকিয়ে থাকতে হয় না। আর নাগরিক জীবনে নতুন ধান বা চালের তেমন কোন অস্তিত্বই নেই। নেই বললেই চলে। তদুপরি এবার সময়টা বৈরি। মাঠে ফসল ভাল হলেও, করোনার বাধায় সবকিছু কেমন থমকে আছে। সারাদেশেই কমবেশি ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রমণ ব্যাধি। এ অবস্থায় নবান্ন উৎসবের কী হবে? এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, ফসল ভাল হওয়ায় মনের শক্তি ধরে রেখেছেন তারা। ধান কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নতুন ধান ঘরে তোলা উপলক্ষে এবারও ঘরে ঘরে নানা পদ রান্না করা হবে। থাকবে পিঠাপুলি পায়েসের আয়োজন। নেমন্তও বাদ যাবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাজধানী শহর ঢাকায়ও শিকড়সন্ধানী মানুষ চিরায়ত ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করবে। নবান্ন উৎসবের আনন্দঘন ছবিটা বেশি দৃশ্যমান হয় রাজধানী শহরেই। গত প্রায় ২০ বছর ধরে এখানে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়ে আসছে। অগ্রহায়ণের প্রথম দিন চারুকলার বকুলতলায় অত্যন্ত বর্ণাঢ্য এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। নাগরিক সমাজ বিপুল আগ্রহ নিয়ে উৎসবে যোগ দেয়। কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জীবন ও অর্থনীতির প্রতি নিজেদের চির দুর্বলতার কথা জানান দেন তারা। অন্যান্য বছর নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয় চারুকলার বকুলতলায়। এবার করোনাকাল চলায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। একই কারণে বন্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। তাই নবান্ন উৎসব আয়োজন করা হবে শিল্পকলা একাডেমির খোলা প্রাঙ্গণে। আয়োজকরা জানান, এবার শিল্পকলা একাডেমির কফিহাউস চত্ব¡রে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। লোক চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে এ মঞ্চ সাজানো হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে গ্রামীণ নানা অনুষঙ্গ। সঙ্গীত নৃত্য ও কবিতার ভাষায় ফসলকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে ফুটিয়ে তোলা হবে। জয়গান করা হবে কৃষকের। নাগরিক জীবনে ভুলতে বসা লোকসংস্কৃতি নতুন করে প্রাণ পাবে নবান্ন উৎসবের মঞ্চে। বিকেল ৫টায় শুরু হয়ে উৎসব রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে বলে জানান আয়োজকরা। নানা পরিবেশনা ছাড়াও উৎসবে থাকবে পিঠাপুলির ব্যবস্থা। আয়োজন সম্পর্কে নবান্ন উৎসব উদ্যাপন পরিষদের সহ-সভাপতি মানজার চৌধুরী সুইট বলেন, করোনা যে বড় বাধা হয়ে আছে তা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু কতদিন আর থেমে থাকা যায়? জীবনের নিজস্ব ছন্দ আছে। সেই ছন্দ শক্তি সাহস ফিরে পেতেই এবার নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। প্রতিবারের মতো এবারও উৎসব মঞ্চ থেকে লোক সংস্কৃতির বন্দনা করা হবে। শেকড়ে ফেরার আকুতি জানাবে নাগরিক সমাজ। পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নাঈম হাসান সুজা বলেন, করোনার সঙ্গে লড়েই জীবনকে এগিয়ে নিতে হবে। দীর্ঘ সময় ঘরে বসে থেকে মানুষের মন মরে যাচ্ছে। নবান্ন উৎসবের মাধ্যমে আমরা সেই মনকে কিছুটা হলেও জাগানোর চেষ্টা করব। তাছাড়া আজকের প্রজন্ম আমাদের মৌলিক সংস্কৃতি ও ফসলকেন্দ্রিক উৎসবগুলো সম্পর্কে জানে না। জানানোর দায় থেকে এবারও নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। সবাইকে এ উৎসবে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানান তিনি।
×