ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বন অধিদফতরের ওয়েবিনারে পরিবেশমন্ত্রী

দেশ থেকে ৯৯ শতাংশ শকুন বিলুপ্ত, আছে মাত্র ২৬০টি

প্রকাশিত: ২৩:৫৭, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

দেশ থেকে ৯৯ শতাংশ শকুন বিলুপ্ত, আছে মাত্র ২৬০টি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এক সময় অবাধ বিচরণ থাকলেও বর্তমানে দেশ থেকে প্রায় ৯৯ শতাংশ শকুনের বিলুপ্তি ঘটেছে। দেশে মাত্র ২৬০টি শকুন রয়েছে। এ অবস্থায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সরকার শকুনের সংখ্যা বাড়াতে কাজ করছে বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন। তিনি বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণে প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী শকুনের অবদান অনস্বীকার্য। দিন দিন এই উপকারী পাখিটি হারিয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্তপ্রায় শকুনকে বাঁচাতে গণসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকার শকুন সংরক্ষণে বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। শনিবার ‘আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস ২০২০’ উপলক্ষে বন অধিদফতর আয়োজিত ওয়েবিনারে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। শকুন সংরক্ষণে সরকারের বিভিন্ন কর্মকা-ের উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ২০১০ সালে দেশব্যাপী শকুনের জন্য ক্ষতিকারক ওষুধ ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশব্যাপী শকুনের খাদ্য প্রাণীর চিকিৎসায় কিটোটিফেনও নিষিদ্ধকরণ বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। তিনি জানান, ২০১৩ সালে ‘বাংলাদেশ জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সময় দেশে শকুনের অভয়ারণ্য থাকলেও বর্তমানে প্রজাতিটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। মাত্র তিন দশকে দেশের প্রায় সব শকুনের বিলুপ্তির কারণ হিসেবে তারা গরু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের প্রতিক্রিয়াকে সামনে এনেছেন। শকুন সাধারণ মৃত গরুর মাংস ভক্ষণ করেই বেঁচে থাকত। গ্রামীণ এলাকায় বটবৃক্ষের ডালে শকুনের বসবাস ছিল। তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাওয়াকে অনেকে শকুনের বিলুপ্তির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া দেশে, গবাদিপশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ‘ডাইক্লোফেনাক’ নামের ব্যথানাশকের প্রভাবে শকুন মারা যাচ্ছে। এ কারণে ডাইক্লোফেনাক ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ডাইক্লোফেনাকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে শকুন বিলুপ্তির মুখে। একই বিষক্রিয়া দেখা গেছে, কিটোপ্রোফেনের বেলায়ও। মৃত পশুর মাংস শকুনের কোন ক্ষতি করে না; কিন্তু ডাইক্লোফেনাক ব্যবহার করা হয়েছে এমন মৃত পশুর মাংস খেলে কিডনি নষ্ট হয়ে ২/৩ দিনের মধ্যে শকুনের মৃত্যু ঘটে। এ কারণে গত তিন দশকে (২০১০) উপমহাদেশে ৭৫% শকুন মারা গেছে। ১৯৮০’র দশকে সার্কভুক্ত দেশে প্রায় চার কোটি শকুনের অস্তিত্ব ছিল, অথচ এই সংখ্যা এখন কমে মাত্র ৪০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিনের গবেষক ড. লিন্ডসে ওক তাঁর এক গবেষণায় প্রমাণ করেন,পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাকের ব্যবহারই শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। ভারতে প্রতিবছর ৩০ শতাংশ শকুন মারা যাওয়ার কারণও ডাইক্লোফেনাক। অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে মন্ত্রী আরও বলেন, ২০১৪ সালে দেশের দুটি অঞ্চলকে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৬ সালে ১০ বছর মেয়াদী (২০১৬-২০২৫) বাংলাদেশ শকুন সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের শকুন রক্ষার জন্য দীর্ঘমেয়াদী কাঠামো হিসেবে কাজ করছে। পরিবেশমন্ত্রী আরও বলেন, শকুনের আবাসস্থলের দীর্ঘমেয়াদী পর্যবেক্ষণ ও শকুনের নিরাপদ এলাকার ব্যবস্থাপনার জন্য স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে শকুন সংরক্ষণ দল গঠন করা হয়েছে। সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দলগুলোর সহায়তায় মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কর্মসূচী পালন করা হচ্ছে। ২০১৫ সালে শকুনের প্রজননকালীন বাড়তি খাবারের চাহিদা মেটানোর জন্য হবিগঞ্জের বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ও সুন্দরবনে দুটি ফিডিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৬ সালে অসুস্থ, আহত শকুন উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দিনাজপুরের সিংড়ায় একটি শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৯৩টি হিমালয়ান গ্রিফন প্রজাতির শকুন উদ্ধার, পরিচর্যার পর পুনরায় প্রকৃতিতে অবমুক্ত করা হয়েছে। ২০১৭ ও ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ৭ম ও ৮ম আঞ্চলিক পরিচালনা কমিটির সভায় শকুন সংরক্ষণে বিভিন্ন কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার শকুন সংরক্ষণের জন্য একটি মাইলফলক। সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে ২০১৪ সালে শকুনের প্রজনন সফলতা ছিল ৪৪ শতাংশ, যা ২০২০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৫৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক বলে আমি মনে করি। আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনলাইন ওয়েবিনারে বন অধিদফতরের প্রধান বন সংরক্ষক মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার, এমপি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসান এনডিসি ও অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ড. মোঃ বিল্লাল হোসেন, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু, বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে আন্তর্জাতিক পাখি গবেষক ড. এনাম উল হক বক্তব্য রাখেন।
×