ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এ পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন ৮ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী ফেরার অপেক্ষায় আরও সাড়ে ৫ লাখ কর্মী ফেরা ঠেকাতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সরকারের

অভিবাসন খাতেই বেশি ক্ষতি ॥ করোনায় দেশে দেশে সঙ্কট

প্রকাশিত: ২২:৫২, ৩০ আগস্ট ২০২০

অভিবাসন খাতেই বেশি ক্ষতি ॥ করোনায় দেশে দেশে সঙ্কট

ফিরোজ মান্না ॥ বিশ্বের করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে অভিবাসন খাত। কাজ হারিয়ে ইতোমধ্যে দেশে ফিরেছেন ৮ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী। ফেরার অপেক্ষায় আরও সাড়ে পাঁচ লাখ কর্মী। সরকার অবশ্য বলছে, আর যাতে বৈধ কর্মীর দেশে ফিরে আসতে না হয় সেজন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে করোনা পরিস্থিতিতে প্রবাসে বাংলাদেশী কর্মীরা বহুমাত্রিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। কাজ নেই বলে তাদের পেটে খাবারও নেই। এক আধ বেলা খেয়ে তারা বিদেশের মাটিতে পড়ে আছেন, কবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে সেই আশায়। দিন যত যাচ্ছে করোনা পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। এরপরও তারা আশা ছাড়েননি। তাদের আশা আবার কারখানা খুলবে-কাজে যোগ দেবেন। দীর্ঘদিনের কষ্ট ভুলে গিয়ে কাজ করবেন। সেই সুদিন সহজেই দেখা দিচ্ছে না প্রবাসীদের কপালে। বাংলাদেশে করোনা শুরু হওয়ার আগেই বিভিন্ন দেশ থেকে সাড়ে ৭ লাখ কর্মী ফিরে এসেছেন। এর মধ্যে দুই লাখ কর্মী ছুটিতে এসে আটকে গেছেন। কিছু সংখ্যক কর্মী ফিরে যেতে পেরেছেন। অনেকে ফেরার চেষ্টা করছেন। বেশিরভাগ কর্মীর আর ফেরত যাওয়ার সুযোগ নেই। দেশে করোনা দেখা দেয়ার পর ফিরেছেন ৮৫ হাজার কর্মী। এদের বেশিরভাগই অবশ্য অবৈধ বা জেলে বন্দী ছিলেন। কুয়েত ও সৌদি আরব থেকে ফেরার অপেক্ষায় ৫ লাখ কর্মী। এই হিসাব প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের। বেসরকারী সংস্থাগুলোর হিসেবে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। দেশে করোনা সংক্রমণের আগে বিভিন্ন দেশ থেকে দেড় থেকে দুই লাখের বেশি কর্মী দেশে ছুটিতে এসেছিলেন। তাদের ছুটি শেষ। এখন তারা কর্মস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। খুব অল্প সংখ্যক কর্মী ফিরতে পেরেছেন। বাকিরা ফ্লাইট ও টিকেট সঙ্কটে যেতেও পারছেন না। এ কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের কর্মস্থলে যাওয়া। বাংলাদেশের কর্মীদের যাতে দেশে ফিরতে না হয় সেজন্য যৌথভাবে চেষ্টা করছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জনকণ্ঠকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অবৈধ কর্মীদের ফেরত পাঠাবে। এটা আমরা মেনে নিয়েছি। তবে বৈধ কর্মীদের তারা দেশে ফেরত পাঠাবে না। কুয়েত কোন অবৈধ কর্মী রাখবে না। মানবপাচার ও অর্থপাচারের অভিযোগ কুয়েত সরকার ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট-সিআইডি বাংলাদেশের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপলুকে গ্রেফতার করেছে। এই সংসদ সদস্যের মাধ্যমে যারা কুয়েতে গেছেন, কুয়েত সরকার তাদের ‘শর্টআউট’ করেছে। পাপলুর মাধ্যমে যাওয়া কোন কর্মীকে তাদের দেশে রাখবে না। তারা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের বের করে দেবে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেই কয়েক লাখ অবৈধ কর্মী রয়েছেন। তাদের সবাইকেই দেশে ফেরত আসতে হবে। ওই সব দেশে যারা জেলে আছেন তাদেরও ফেরত পাঠাবে। কুয়েত নতুন করে কোন কর্মী নেবে না। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইতালিতে আমাদের প্রচুর কর্মী রয়েছেন। এদের একটি অংশ বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে সম্প্রতি বিক্ষোভ করেছে। এই অংশটি দালাল গোষ্ঠী। এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের লোকজনও ছিল। দালালদের কোন আদর্শ নেই। নিজেদের স্বার্থে সব এক হয়ে বিক্ষোভ করেছে। পরে আমরা জেনেছি ইতালি সরকার দালাল গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এখন ইতালি যেতে হলে ইন্টারভিউ দিয়ে যেতে হবে। আমাদের প্রতিটি শ্রমবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে কোন বৈধ কর্মী দেশে ফেরত না আসেন। আমরা করোনাকালে ১২টি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছি। বিদেশে আমাদের কর্মীদের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে। এখন পর্যন্ত আমরা কূটনৈতিকভাবে অনেকটাই সফল হয়েছি। অনেক দেশের সরকারকে আমরা বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। আশা করা যাচ্ছে খুব বেশি কর্মী দেশে ফেরত আসবেন না। যাদের কোন কাগজপত্র কিছুই নেই তাদের দেশে ফিরতে হবে। আর যারা জেলে আছেন তাদেরও দেশে ফেরত পাঠাবে সংশ্লিষ্ট দেশ। মন্ত্রী বলেন, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান, স্বরাষ্ট্র, বিমান মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন প্রতিনিধি, পাসপোর্ট অফিসসহ সংশ্লিষ্ট সব দফতর এই বৈঠকে উপস্থিত ছিল। করোনাকালে প্রবাসী কর্মীদের দেড় লাখের বেশি পাসপোর্ট দেয়া হয়েছে। আমরা বসে নেই এ বিষয় নিয়ে কাজ করছি। আমাদের দূতাবাস ও মিশনগুলো নির্দেশ দেয়া আছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, বিদেশে আমাদের এক কোটির বেশি কর্মী চাকরি নিয়ে গেছেন। তারা দেশের জন্য অনেক বড় অবদান রাখছেন। এই সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। আমরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু বেশ কয়েকটি দেশ থেকে দূতাবাস, হাইকমিশন ও আমাদের দলীয় কর্মীদের নানা অভিযোগ পেয়েছি। ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশে দূতাবাস ও হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। বিদেশে বৈধ কর্মীদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো সব ধরনের সহযোগিতা করছে। যেসব কোম্পানি সহযোগিতা দিচ্ছে না আমরা সেই সব দেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জুম মিটিং করে সমস্যা তুলে ধরে যাচ্ছি। এতে অনেক ভাল কাজ হচ্ছে। কিছু দেশে তো করোনা আক্রান্তদের সরকারীভাবে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সিঙ্গাপুর তো কর্মীদের তাদের দেশের মানুষের মতো করে দেখছে। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে সমস্যা হচ্ছে। সেগুলোও দেখা হচ্ছে। কর্মীরা যাতে কোন ধরনের কষ্টে না থাকে সে বিষয়ে আমরা সব সময় দায়িত্বশীল জায়গা থেকে কাজ করছি। এক কোটির বেশি কর্মীদের তো সহযোগিতা করা সম্ভব হবে না। তবুও আমরা অনেক দেশে প্রাথমিকভাবে আর্থিক সাহায্য পাঠিয়েছি। এতে অনেক কর্মী উপকৃত হয়েছেন। তবে আমরা সব কর্মীর খোঁজ খবর রাখার চেষ্টা করছি। যাতে তারা করোনাকাল অতিক্রম করে আবার কাজে যোগ দিতে পারেন এমন চেষ্টা করা হচ্ছে সরকার টু সরকার। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি। বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটি ২৬ লাখ বাংলদেশী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গেছেন। এই প্রবাসীরা সব মিলিয়ে দুই লাখ ১৭ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি প্রবাসী আয় দেশে পাঠিয়েছেন। তবে করোনার কারণে পুরো অভিবাসন খাতটা সঙ্কটে পড়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের ৭৫ শতাংশই আছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। শুধু সৌদি আরবেই আছেন ২৬ লাখ বাংলাদেশী কর্মী। আরব আমিরাতে আছেন ১৫ লাখের বেশি কর্মী। এছাড়া কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইনে গড়ে তিন থেকে চার লাখ করে বাংলাদেশী কর্মী আছেন। একে তো করোনা তার ওপর জ্বালানি তেলের দাম একেবারেই কমে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে নানা সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এদিকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় থাকা বাংলাদেশীরাও একইভাবে নানা সঙ্কটে পড়েছেন। সম্প্রতি আইওএম’র এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ৭০ শতাংশ বিদেশ ফেরত বাংলাদেশী জীবিকা সঙ্কটে পড়েছেন। গত ১২ আগস্ট তারা এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের ১২ জেলায় বিদেশ ফেরত অভিবাসীদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০’র ফেব্রুয়ারি থেকে জুন এর মধ্যে বিদেশ ফেরতদের প্রায় ৭০ শতাংশ জীবিকাহীন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ‘র‌্যাপিড এ্যাসেসমেন্ট অব নিডস এ্যান্ড ভালনারেবিলিটিস অব ইন্টার্নাল এ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিটার্ন মাইগ্র্যান্টস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ও প্রতিবেদনের ফল তুলে ধরেছে। প্রতিবেদন মতে, ফেরত আসা অভিবাসীরা জীবিকা, আর্থিক সঙ্কট (উপার্জনের অভাব এবং বর্ধিত ঋণ) এবং স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়সহ পুনরেকত্রীকরণে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। একেকজন অভিবাসী কর্মী গড়ে তার পরিবারের তিনজন সদস্যকে সহায়তা হয়। সেক্ষেত্রে, অপরিকল্পিত ও বৃহৎ সংখ্যক জীবিকাহীন অভিবাসী কর্মীদের ফেরত আসার ফলে সারাদেশে রেমিটেন্স নির্ভর জনগোষ্ঠীর ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আইওএম বাংলাদেশের ন্যাশনাল কমিউনিকেশন অফিসার শরিফুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে মোট এক হাজার ৪৮৬ জন বিদেশফেরত অভিবাসীর ওপর পরিচালিত জরিপের ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে আইওএম। ২০২০ সালের মে এবং জুলাই মাসে দেশের ১২টি উচ্চ অভিবাসনপ্রবণ জেলায় এই জরিপ পরিচালনা করা হয়, যার মধ্যে সাতটি জেলায় ভারতের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। কোভিড-১৯’র প্রভাবে অভিবাসী কর্মীদের সুনির্দিষ্টভাবে বিপদাপন্নতা তৈরি হয়েছে। কোভিড-১৯’র কারণে উপার্জন ব্যবস্থা, সামাজিক সেবা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সহায়তার নেটওয়ার্কের অভাবে হাজারো অভিবাসী কর্মী প্রবাসে যে দেশে কাজ করছিলেন সেখান থেকে বাংলাদেশে তাদের জেলায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। মোট ৬৪ শতাংশ আন্তর্জাতিক অভিবাসী কোভিড-১৯’র প্রাদুর্ভাবে তাদের কর্মস্থল দেশে তথ্য এবং স্বাস্থ্যসেবা পেতে তাদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মোট ২৯ শতাংশ বলেছেন, যে দেশে তারা ছিলেন সেই দেশ ত্যাগ করতে বলায় তারা বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন। ২৩ শতাংশ জানান, তারা কোভিড-১৯ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন এবং পরিবারের কাছে ফেরত আসতে চেয়েছেন। তদুপরি, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ২৬ শতাংশ জানান, তাদের পরিবার তাদের ফেরত আসতে বলায় তারা ফিরে এসেছেন। নয় শতাংশ জানান, তাদের বলা হয়েছে সীমন্ত বন্ধ করে দেয়া হবে এবং আটকে পড়ার ভয়ে তারা ফেরত এসেছেন। সাক্ষাতকার প্রদানের সময় মোট ৫৫ শতাংশ জানান, তাদের ওপর বর্ধিত শোধ না করা ঋণের বোঝা রয়েছে। তাদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ পরিবার ও বন্ধুর কাছে ঋণগ্রস্ত, ৪৪ শতাংশ ক্ষুদ্র ঋণপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান (এমএফআই), স্বনির্ভর দল এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণগ্রস্ত। ১৫ শতাংশ পাওনাদারদের কাছে ঋণগ্রস্ত। পরিবার এবং বন্ধুদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণকারীদের ৮৬ শতাংশ বিনা সুদে ঋণ নিয়েছেন, অন্যদিকে এমএফআই, এনজিও এবং বেসরকারী ব্যাংকসমূহ থেকে গৃহীত ৬৫ শতাংশকে ঋণের জন্য সুদ বহন করতে হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। মহাজন বা সুদে টাকা ধার দেনা এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে নেয়া ঋণের ক্ষেত্রে ৬২ শতাংশ ঋণগ্রহীতাকে সুদ গুনতে হচ্ছে ৫০ থেকে ১৫০ শতাংশ। আইওএম বাংলাদেশের মিশন প্রধান গিওরগি গিগাওরি প্রতিবেদন নিয়ে বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারীর সময় সবচেয়ে বিপদাপন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছেন অভিবাসী কর্মীরা। বৈশ্বিক চলাচলের ওপর আরোপিত নতুন নিষেধাজ্ঞা ও কোভিড-১৯ মহামারী সৃষ্ট মন্দার ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের অভিবাসী কর্মীদের রেমিটেন্স নির্ভর জনগোষ্ঠীর ওপর। বাংলাদেশে জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক হিসেবে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন বিষয়ক গবেষণায় অবদান রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই গবেষণা বিদেশফেরত অভিবাসীদের টেকসই পুনরেকত্রীকরণে প্রমাণ-ভিত্তিক কৌশল তৈরিতে সরকারী প্রচেষ্টাকে সাহায্য করবে। এই মহামারী চলাকালীন, গবেষণা বিপদাপন্ন অভিবাসীদের সহায়তা এবং সুরক্ষায় প্রতিক্রিয়াশীল, অভিবাসী- কে›িন্দ্রক পদ্ধতির বিকাশে সাহায্য করবে। অভিবাসীদের তাদের সম্প্রদায়ে পুনরায় সংহত করার জন্য আমাদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত। এমন সঙ্কটের কারণ কী? জানতে চাইলে বিএমইটি বলছে, বাংলাদেশের যত লোক বিদেশে যায়, তাদের মধ্যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা পেশাদার লোকের সংখ্যা মাত্র দুই শতাংশ। এরা মাস গেলে বেতন পান, ফলে খুব দুশ্চিন্তা করতে হয় না। বাকি যারা আছেন তারা অদক্ষ বা আধাদক্ষ। তাদের বেতন হয় কাজের ওপর। নির্মাণকর্মী, পরিচ্ছন্ন কর্মী বা ছোটখাটো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তারা। করোনা ও লকডাউনের কারণে কাজ বন্ধ থাকায় তারা আছেন চরম সঙ্কটে। এছাড়া যারা ছোটবড় ব্যবসাবাণিজ্য করতেন, তাদেরও ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়েছে। আর যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই তাদের সঙ্কট আরও চরম আকার ধারণ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক লাখ বাংলাদেশী আছেন যারা তথাকথিত ফ্রি ভিসায় গিয়েছেন। তাদের কাগজে কলমে মালিক থাকলেও বাস্তবে নেই। ফ্রি ভিসায় যাওয়া এক কর্মী লকডাউন শুরুর পর সৌদি আরব থেকে প্রবাসী হেল্পলাইনে ফোন করে বলছিলেন, তার মতো অনেকের এখন কোন কাজ নেই। সামনে তাদের কী হবে জানেন না। মালয়েশিয়া থেকে অনেকেই বলেছেন, করোনার সময় তারা সবসময় পুলিশ আতঙ্কে রয়েছেন। অবশ্য সম্প্রতি মালয়েশিয়া শতকরা ২০ ভাগ কর্মীদের কাজে যোগ দেয়ার অনুমতি দিয়েছে। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রবাসীরা নানা সঙ্কটে পড়েছেন। কাজ নেই-খাবার নেই। এক আধ বেলা খেয়ে দেশে দেশে বাংলাদেশের কর্মীরা বসবাস করছেন। করোনাকালে ৮৫ হাজার কর্মী বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে ফিরেছেন। এ অবস্থায় তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কয়েক দিন আগে যখন তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, বারবার বলছিলেন কীভাবে পরিবার নিয়ে সামনের দিনগুলোতে চলবেন সেই দুশ্চিন্তায় আছেন। দেশে আটকে পড়া বাংলাদেশীরা যেখানে ফের বিদেশে যাওয়ার চিন্তায় মগ্ন, তখন বিদেশে থাকা প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশী আছেন বহুমাত্রিক সঙ্কটে। বাংলাদেশের প্রবাসী আয় আহরণের শীর্ষ ১৫টি উৎস দেশ হলো সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার, ইতালি, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া ও জর্দান। বিশ্বব্যাংক বলছে, চলতি বছরে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় ২২ শতাংশ কমে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারিতে ১৬৩ কোটি মার্কিন ডলার ও ফেব্রুয়ারিতে ১৪৫ কোটি ডলার এসেছে। তবে করোনার কারণে ব্যাপকভাবে লকডাউন শুরু হওয়ায় মার্চে সেটি কমে হয় ১২৮ কোটি ডলার, যা আগের বছরের মার্চের চেয়ে ১২ শতাংশ কম আর এপ্রিলে প্রবাসীরা ১০৯ কোটি ডলার পাঠান যা যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক কম। অবশ্য ঈদের কারণে মে মাসে প্রবাসী আয় কিছুটা বেড়েছিল। মে মাসে প্রবাসী আয় আসে ১৫০ কোটি ডলার। তবে জুন মাসেই ১৮৩ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে যা কোন মাসে সর্বোচ্চ। হঠাৎ করে এই প্রবাসী আয় বাড়ার কারণ, অনেকেই তাদের সব সঞ্চয় দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। বিদেশে কর্মী পাঠানোর সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)-র মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, ৮৬ হাজার ৪২৫ জন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার সবকিছু চূড়ান্ত ছিল। করোনার কারণে তারা যেতে পারেননি। এখন তারা সবসময় তাড়া দিচ্ছে। অন্যদিকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লগ্নি আটকা পড়েছে এজেন্সিগুলোর। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এই খাতের সবার বিপদ হবে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে তেমনটাও বলা যাচ্ছে না। বিশেষ করে তেলের দাম অস্বাভাবিকভাব কমে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি সঙ্কটে পড়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সেখান থেকে অনেক লোক কাজ হারিয়ে ফিরতে পারেন এমন আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে। সৌদি আরবের ইংরেজি দৈনিক সৌদি গেজেটে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, মহামারীর কারণে এ বছরই দেশটিতে ১২ লাখ বিদেশী কর্মী চাকরি হারাবেন। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস ঢাকায় পাঠানো এক চিঠিতে বলেছে, আগামী তিন বছরে দশ লাখ লোক বাংলাদেশী চাকরি হারাতে পারেন। কোভিড-১৯ শুধু প্রবাসীদের জীবিকাতেই নয়, আঘাত করেছে জীবনেও। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও বিভিন্ন দূতাবাসের দুদিন আগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে বিদেশে ইতোমধ্যেই এক হাজার ৩৮০ জন প্রবাসী বাংলাদেশী মারা গেছেন। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের ছয় দেশেই ৭৫৩ বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে। শুধু সৌদি আরবেই মারা গেছেন ৫২১ জন বাংলাদেশী। এছাড়া প্রায় ৭০ হাজার বাংলাদেশী বিভিন্ন দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
×