ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জলাবদ্ধতায় অচল হয়ে পড়ে নগর জীবন

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ২২ জুলাই ২০২০

জলাবদ্ধতায় অচল হয়ে পড়ে নগর জীবন

শাহীন রহমান ॥ গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণে বলতে গেলে অচল হয়ে পড়ে রাজধানী। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হওয়ার কারণে প্রতিদিনই মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে রাজধানীর বহু এলাকায় কোমর পর্যন্ত পানি জমে যাচ্ছে। ফলে প্রচ- যানজট ও জলাবদ্ধতার কারণে স্থবির হয়ে পড়ছে রাজধানী। মানুষের ভোগান্তির যেন শেষ নেই। নগরীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও নিচু এলাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি সময়ে অল্প অতি বৃষ্টিতে ঢাকা ও চারপাশে নদীগুলোর পানির উচ্চতা বেড়ে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। কিন্তু এই জলাবদ্ধতার হাত থেকে কবে রেহাই পাবে নগরবাসী, এই প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর বলা হয়ে থাকে সরকার জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে। আগামী বছর থেকে রাজধানীতে আর জলাবদ্ধতার সমস্যা থাকবে না। কিন্তু কথা দিয়ে কথা রেখেছে এখন পর্যন্ত এই নজির নেই। বর্ষা এলেই রাজধানীবাসীর জলাবদ্ধতার চিরদিনের দুর্ভোগ নিরসনের যেন কেউ নেই। সামান্য বৃষ্টিতেই রাজধানী ঢাকা ডুবতে বসে। এর আগে ২০১৭ সালে এ বিষয়ে দুই মেয়র, ওয়াসার এমডি, এমনকি মন্ত্রী পর্যন্ত এক অনুষ্ঠানে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে একসঙ্গে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন। কথা দিয়েছেন দুর্দশা লাঘবের। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। যতই কথা দিন তারা জলাবদ্ধতা নিরসনে এখন পর্যন্ত কেউই কথা রাখেননি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রতিবছর বর্ষা এলেই জলাবদ্ধতার কারণে রাজধানীর যানজট দুঃসহ আকার ধারণ করে। জলাবদ্ধতা আর যানজটের কবলে পড়ে রাজধানীবাসীকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তারা বলেছেন সংস্কারের অভাবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ফলপ্রসূ হচ্ছে না। উড়াল সড়ক নির্মাণের মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি নতুন নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ, অপর্যাপ্ত পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরগতি এবং সমন্বয়হীনতাই দুর্ভোগের জন্য প্রধানত দায়ী। বেদখল হয়ে যাওয়া ৫৩টি খালও এই জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। এছাড়া ইতোমধ্যে রাজধানীর চারপাশ বন্যায় আক্রান্ত। ফলে বৃষ্টির পানি সহজেই নিষ্কাশন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে। জলাবদ্ধতার পেছনে দায় কার ॥ কিন্তু এই জলাবদ্ধতার পেছনে আসল দায় কার? এর ইতিহাস অনেক লম্বা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন জলাবদ্ধতার জন্য একক কোন প্রতিষ্ঠান দায়ী নয়। এর পেছনে যেমন দায় রয়েছে ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশনের, তেমনি এর দায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপরও বর্তায়। এসব প্রতিষ্ঠান তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে না পারায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা আর ভোগান্তি যেন আরও বেড়ে চলেছে। তারা বলছেন, ঢাকা নগরীতে নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার নামে ওয়াসা যে সব পাইপ ও বক্স কালভার্ট বসিয়েছে সেগুলোই এখন স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তবে এই জলাবদ্ধতার বিস্তার, স্থায়িত্ব ও ভোগান্তির জন্য লোকজন ঢাকা ওয়াসা এবং সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করলেও এর জন্য মূলত দায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড। কারণ আইন ও সরকারী রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী নগরীর নিষ্কাশনের দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা নগরীর ভেতরের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য বেশ কতগুলো বড় ধরনের নিষ্কাশন পাম্প হাউস পরিচালনা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এছাড়াও ঢাকা নগরীর পশ্চিম পাশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রকল্পটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের এবং পূর্ব পাশে প্রস্তাবিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রকল্পটিও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনেই রয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০০০ এবং এর পূর্ববর্তী ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ ৫৯ অনুযায়ী সারাদেশের নদী ও নদী অববাহিকা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশন, সেচ ও খরা প্রতিরোধের লক্ষে জলাধার, ব্যারেজ, বাঁধ, রেগুলেটর বা অন্য যে কোন অবকাঠামো নির্মাণ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওপর ন্যস্ত রয়েছে। নদী, পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল বলেন, ঢাকা নগরীর জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে তার কাজ করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা বা রাজউকের এই ক্ষমতাও নেই, আইনও নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড খালের খাসজমিগুলো উদ্ধার করে এলাকাভিত্তিক নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত করবে এবং ডিজাইন ও পরিকল্পনা অনুযায়ী সেগুলো খনন করবে। তারা প্রয়োজনে নতুন জমি হুকুম দখল করে ব্যাংকক নগরীর মতো খোলা নিষ্কাশন খাল নির্মাণ করবে। তিনি বলেন, ঢাকা নগরীর ৪৪টি নিষ্কাশন খাল দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। সিএস ম্যাপে এসব খাল খাসজমি হিসেবে দেখানো হয়েছে। এগুলো মোটেও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি নয়। কিন্তু দলিল জালকারীদের মদদে দুর্বৃত্তরা আরএস ম্যাপে সে সব ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে নিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা এসব দেখেও দেখেননি। ফলে সারা নগরী নিষ্কাশন খালহীন জনাকীর্ণ বস্তিতে পরিণত হয়েছে। এর ওপরই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বসিয়েছে চূড়ান্ত আঘাত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানী ঢাকায় আগে প্রাকৃতিক খালগুলো ছিল ৩০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত চওড়া। দুর্বৃত্তরা দু’পাশের জায়গা দখল করেছে ২০ থেকে ৮০ ফুট পর্যন্ত। ১০ থেকে ২০ ফুট অবশিষ্ট খালগুলোতে ওয়াসা পাইপ ও বক্স কালভার্ট বসিয়ে ওপরে সড়ক বা ফুটপাথ নির্মাণ করেছে। কিন্তু বক্স কালভার্টগুলোর অধিকাংশই ফেলে দেয়া ইট পাথর, বালি, পলিথিন ও আবর্জনায় পরিপূর্ণ। এগুলোর দেখার বা পরিষ্কার করার কেউ নেই। এগুলোরই ফাঁক দিয়ে পয়োবর্জ্যের প্রবাহ খাল ও নদীতে গিয়ে পড়ে। বৃষ্টি হলে পানি টানতে পারে না। সৃষ্টি হচ্ছে প্রচ- জলাবদ্ধতা। তাদের মতে রাজউকের (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) দায়িত্ব হচ্ছে ঢাকা নগরীকে পরিকল্পনা মাফিক গড়ে তোলা। এই সংস্থা তা না করে এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছে। ২০০৫ সালে ঢাকা মহানগরীর জন্য একটি ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) করার কাজ হাতে নেয়। বুড়িগঙ্গা ও আশপাশের নদীগুলো সারা নগরীর উন্নয়ন পরিকল্পনা আরএস ম্যাপের ভিত্তিতে করা হয়। যার ফলে নদী, খাল ও জলাভূমির বিশাল দখলিকৃত খাসজমি ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে হালাল হয়ে যায়। এছাড়াও ভূমি দস্যুদের স্বার্থে ঢাকা নগরীর পূর্ব পার্শ্বের জলাভূমি এলাকাকে ভরাট করে শহর এলাকা করা হয়। বালু নদী তীরবর্তী গ্রামকে কেটে জলাভূমি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। যদিও পরিকল্পনাটি পরে সমালোচনায় পড়ে অকার্যকর হয়ে গেছে। কিন্তু এতে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। ঢাকা নগরীর উন্নয়নে এখন আর কোন নিয়ম শৃঙ্খলা বা পরিকল্পনা নেই। কয়েক দিনের টানা বর্ষণের ভোগান্তি বাড়ছে ॥ প্রকৃতিতে এখন চলছে শ্রাবণ মাস। বাংলা প্রবাদে শ্রাবণের মেঘ নামে আলাদা বচন চালু রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। অর্থাৎ এই মাস এলে প্রকৃতিতে শুরু হয় বৃষ্টির ধারা। গত কয়েক বছর শ্রাবণে বৃষ্টিপাত দেখা না গেলেও এবার শ্রাবণ তার আসল চেহারায় ফিরেছে। গত কয়েক দিন ধরেই সারাদেশে শুরু হয়েছে ভারি বর্ষণ। আর রাজধানীতে সামান্য বৃষ্টিতেই দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। ফলে বেড়ে যাচ্ছে ভোগান্তি।
×