ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, বিভ্রান্তি

রেড জোন চিহ্নিত করার কাজ শেষ হয়নি

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ১৭ জুন ২০২০

রেড জোন চিহ্নিত করার কাজ শেষ হয়নি

নিখিল মানখিন ॥ জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যকর করতে প্রস্তুতি শেষ হয়নি। প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতাই স্পষ্ট হচ্ছে। দেখা দিয়েছে নানা বিভ্রান্তি। লকডাউন নিয়ে তাদের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ও বক্তব্যে হতাশাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেই মাইকিংসহ নানা উপায়ে রেড জোনের এলাকার নাম এবং সেসব এলাকায় লকডাউন কার্যকর করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীকে জানিয়ে দেয়া হবে। এদিকে জোনভিত্তিক লকডাউন নিয়ে বিভ্রান্তি নিরসনে মঙ্গলবার সরকারী এক তথ্য বিবরণীতে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রেড জোন ঘোষণা বা রেড জোন পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই যখন প্রয়োজন তা করা হবে এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়ন করবে। জোনভিত্তিক লকডাউন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। রেড জোনের এলাকাসমূহের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি এবং লকডাউন বাস্তবায়নকারীর সঙ্গে সম্পৃক্ত কমিটি, বিভাগ ও প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কাউকে তালিকা জানানো হবে না বলে জানিয়েছে জোনভিত্তিক তালিকা তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদফতর। আর প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষই লকডাউন এলাকার নাম এবং কখন, কিভাবে কার্যকর হবে তা এলাকাবাসীকে জানিয়ে দেবে। অন্যদিকে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত রেড জোনের এলাকাসমূহের একটি অনুমোদনহীন তালিকা দেখে নগরবাসীর মধ্যে এলাকা ত্যাগ করার হিড়িক পড়ে গেছে। আর লকডাউন কার্যকর করতে পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও নক্সা সংগ্রহসহ সমন্বয় সভা শুরু করেছে ঢাকা সিটির লকডাউন বাস্তবায়নকারী দুই সিটি কর্পোরেশন। আর সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক আদেশে বলা হয়, নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিবেচনায় লাল (উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ) ও হলুদ (মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ) এলাকায় সাধারণ ছুটি থাকবে। আবার বিকেলে ছুটি থাকবে শুধু লাল এলাকায় বলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এভাবে লকডাউন বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও কমিটির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব বেশ দৃশ্যমান। বিভ্রান্তি দূরীকরণে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রেস বিজ্ঞপ্তি ॥ জোনভিত্তিক লকডাউন কেন্দ্রিক সৃষ্ট নানা বিভ্রান্তি দূর করতে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। রেড জোন ঘোষণা বা রেড জোন পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া বলে দাবি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই যখন প্রয়োজন তা করা হবে এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়ন করবে। এই বিষয়ে সকলের বিভ্রান্তি নিরসন হওয়া প্রয়োজন। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই যখন প্রয়োজন তখন রেড জোন ঘোষণা করা হবে এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়ন করবে । কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপ অব্যাহতভাবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে এলাকা-ভিত্তিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে এবং অধিকতর বাস্তবমুখী সংজ্ঞা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই অনুযায়ী ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংজ্ঞানুযায়ী যেখানে যখন প্রয়োজন তখন রেড জোন ঘোষণা করা হবে। নাগরিক সাধারণের জীবন-জীবিকা নির্বাহের বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার কর্তৃক সারাদেশে ঘোষিত ৬৬ দিন সাধারণ ছুটির পর গত ৩১ মে থেকে সীমিত পরিসরে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু করা হয়। কিন্তু, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিমাণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ (২০১৮ সালের ৬১ নং আইন)-এর সংশ্লিষ্ট ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকারের অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ১০ জুন ২০২০ কতিপয় নির্দেশাবলী জারি করে। এই নির্দেশাবলীর উদ্দেশ্য কোভিড-১৯ রোগের চলমান ঝুঁকি বিবেচনায় বাংলাদেশের যে কোন ছোট বা বড় এলাকাকে লাল, হলুদ বা সবুজ জোন হিসেবে চিহ্নিত করা এবং তা বাস্তবায়ন করা। জোন ঘোষণার ক্ষমতা আইনানুযায়ী সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জনের নিকট অপর্ণ করা হয় এবং বলা হয় তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সিভিল প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা ও সশস্ত্রবাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় জোনিং কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবেন। প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, জোন সুনির্দিষ্টভাবে সংশ্লিষ্ট এলাকার কোন অংশে কার্যকর হবে এবং এর পরিধি কি হবে তা স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ও কোভিড-১৯ সংক্রান্ত স্থানীয় কমিটিগুলোকে নির্ধারণ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত কৌশল বা গাইড তৈরি করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলোর মধ্যে বিতরণ করেছে। এ ছাড়া জোনের সংজ্ঞা ও বাস্তবায়ন কৌশল সময়ে সময়ে পর্যালোচনা করে পরামর্শ দেয়ার জন্য একটি কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। নির্দেশে বলা হয়েছিল স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জোনিং সিস্টেমের হালনাগাদ সংজ্ঞা ও বাস্তবায়ন কৌশল অনুযায়ী অব্যাহতভাবে স্থানীয় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবে এবং জোনিং সিস্টেম চালু করতে হলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মতামত সাপেক্ষে তা বাস্তবায়ন করবে। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, নির্দেশাবলীতে প্রাথমিকভাবে ৩টি জেলায় (গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী) এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের রাজাবাজার (পূর্ব রাজাবাজার) এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ওয়ারীতে পরীক্ষামূলকভাবে জোনিং সিস্টেম বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। ইতোমধ্যে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং নরসিংদী জেলার নির্বাচিত এলাকায় এবং ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারে পরীক্ষামূলক জোনিং সিস্টেম চালু করা হয়েছে। ঢাকার ওয়ারিতে জোনিং সিস্টেম চালুর জন্য সুনির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিতকরণের কাজ চলছে। এই পরীক্ষামূলক জোনিং সিস্টেমের অভিজ্ঞতা দেশের অন্যান্য এলাকায় জোনিং সিস্টেম চালু বা পরিবর্তনের বিষয়ে সহায়ক হবে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও সিটি কর্পোরেশনও বর্ণিত কৌশল ও গাইড অনুসারে স্থানীয় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে। সেই অনুযায়ী তারা প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নপূর্বক স্বাস্থ্য অধিদফতরের মতামত অনুযায়ী জোনিং সিস্টেম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে। লকডাউন কার্যকর করার বিলম্ব নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ও করোনা সংক্রান্ত মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক মোঃ হাবিবুর রহমান খান জনকণ্ঠকে জানান, লকডাউন বাস্তবায়ন করার সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও কমিটি জড়িত রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ইতোমধ্যে লকডাউন চলছে। এবার হয়তো লকডাউন এলাকার সংখ্যা একটু বেশি হতে পারে। লকডাউন বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও কমিটিসমূহের মধ্যে চূড়ান্ত সমন্বয় ঘটানোর আলাপ আলোচনা চলছে। সকলের সিদ্ধান্ত এক জায়গায় এলেই লকডাউন কার্যকর শুরু হবে। এটি আসলে লকডাউনের চলমান প্রক্রিয়া। লকডাউনে নতুন এলাকার নাম যুক্ত হবে, আবার লকডাউনমুক্ত হবে অনেক এলাকা। এভাবে চলতে থাকবে জোনভিত্তিক লকডাউন বলে জানান মোঃ হাবিবুর রহমান। সিটি কর্পোরেশনের প্রস্তুতি ॥ এলাকাভিত্তিক বিস্তারিত নক্সা বা ডিমার্কেশন না পেলে লকডাউন কার্যকর করা ‘সম্ভব নয়’ বলে জানিয়েছে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে এলাকাভিত্তিক বিস্তারিত ডিমার্কেশন চাওয়া হয়েছে। ডিমার্কেশন বা নক্সা পেলে সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে লকডাউন কার্যকর করা যাবে। দুই সিটি কর্পোরেশনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সিটি কর্পোরেশন বলছে, তারা এলাকাগুলোর নাম পেলেও লকডাউন কার্যকর করার জন্য অফিসিয়ালি মাদার প্রতিষ্ঠান (নিয়ন্ত্রক মন্ত্রণালয়) থেকে কোন নির্দেশ পায়নি। যে কারণে বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। এ বিষয়ে ডিএনসিসি মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম বলেন, আমাকে যত দ্রুত সম্ভব জোন ও এলাকাভিত্তিক ডিমার্কেশন করে দিতে হবে। যদি সম্ভব হয়, কোন বাড়িতে, সম্ভব না হলে কোন লেনে, তার পরে হচ্ছে কোন মহল্লায়, কোন ওয়ার্ডে এটা আমাকে নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। তাহলে আমরা এলাকাগুলোকে সুনির্দিষ্ট করে নিতে পারব। কারণ আমাদের যেসব এলাকার নাম দেয়া হয়েছে, সেটা কিন্তু অনেক বিরাট এলাকা। ম্যাপিং না করে দিলে এটা কার্যকর করা সম্ভব না। আমরা চাচ্ছি এলাকাকে যত কম্বাইন্ড করে দেয়া যাবে, তত আমাদের ম্যানেজ করতে সুবিধা হবে। মেয়র আরও বলেন, আমি আগেও বলেছি ম্যাপিং চলে এলে আমরা কাজ শুরু করব। আমরা ২৮টি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) রেডি করেছি। ডিমার্কেশন পেলে সর্বনিম্ন ৪৮ ঘণ্টা ও সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আমরা লকডাউন করতে পারব। সেই প্রস্তুতি আমরা নিয়ে রেখেছি। আমাদের আগে জানাতে হবে, কোন এলাকার কতটুকু লকডাউন হবে। তিনি আরও বলেন, পূর্ব রাজাবাজারে আমরা পরীক্ষামূলক লকডাউন করেছিলাম। এখন পর্যন্ত সেখানে সুন্দরভাবে লকডাউন কার্যকর রয়েছে। সেখানে অনেক অনেক চ্যালেঞ্জ চলে এসেছে। তাছাড়া রেড জোন এলাকার মানুষ সরকারী ছুটির আওতায় থাকবে। সেখানে অনেকেই আছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাদেরও এই ছুটির আওতায় আসতে হবে। আমাদের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। কারণ জীবন এবং জীবিকাকে নিয়েই করোনাকে ম্যানেজ করতে হবে। আমাদের স্থানীয় কাউন্সিলর, রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করতে হবে। স্বেচ্ছাসেবকও জোগাড় করতে হবে। সে বিষয়ে অলরেডি আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। অপরদিকে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মোঃ এমদাদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আমরা তো একটি সরকারী সংস্থা। আমাদের নির্দেশ দিতে হবে যে তুমি তোমার এই এলাকা লকডাউন করো। তাহলেই আমরা সেটা বাস্তবায়ন করব। কিন্তু এই নির্দেশ তো কেউ আমাদের দেয়নি। এটা আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অফিসিয়ালি নির্দেশ দিতে হবে। এখন পর্যন্ত লকডাউনের বিষয়ে অফিসিয়ালি কোন নির্দেশনা আসেনি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একটা কমিটি করা হয়েছে। সেখানে আমাদের মেয়রকে রাখা হয়েছে। কিন্তু কমিটির নিচে কারও স্বাক্ষর নেই। এভাবে তো হতে পারে না। ইমদাদুল হক বলেন, লকডাউনের তালিকায় মোহাম্মদপুর রয়েছে। এখন এই এলাকাতো অনেক বড়। আমাদের ডেমরা এলাকা রাখা হয়েছে। সেখানে চারটির মতো ওয়ার্ড রয়েছে। এখন ম্যাপিংয়ে সব ওয়ার্ড পড়ে কিনা, সেটাও জানার বিষয় আছে। আমরা বলেছি, এলাকাগুলোকে সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। তা না হলে, কীভাবে লকডাউনে যাব? আমরা এলাকাভিত্তিক ডিমার্কেশন চেয়েছি। এটা এটুআই (একসেস টু ইনফরমেশন) করছে। লকডাউন কিভাবে হবে ॥ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লকডাউনের বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। লকডাউন কার্যকর করার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও শেষ হয়নি। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, করোনা প্রতিরোধে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। লকডাউন বিষয়ে সরকারের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা কাজ করছে। সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক আদেশে বলা হয়, নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিবেচনায় লাল (উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ) ও হলুদ (মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ) এলাকায় সাধারণ ছুটি থাকবে। বিকেলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বলা হয়, ছুটি থাকবে শুধু লাল এলাকায়। বর্তমানের লকডাউন উদ্যোগ ছাড়া সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারের আর কোন কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। তবে এ ক্ষেত্রে যে তথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের দেয়া মতামত পুরোপুরি না মেনেই কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। লকডাউন নিয়ে কথা হলেও বাস্তবায়ন নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। এখনও এলাকা চিহ্নিত করার কাজ চলছে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, যেসব এলাকায় জনসংখ্যার অনুপাতে সংক্রমিত মানুষ বেশি, সেসব এলাকায় ঝুঁকিও বেশি। প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ৬০ জন সংক্রমিত থাকলে সেই এলাকাকে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ ক্ষেত্রে দুটি প্রশ্ন তুলেছেন। প্রথমত ঢাকা শহরে কোন এলাকায় কত মানুষ বাস করে, তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারী কোন দফতরে নেই। পরিসংখ্যান ব্যুরো যে তথ্য দেয়, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। প্রতিটি এলাকায় ভোটারের সংখ্যা থাকে, বাস্তবে ভোটারের চেয়ে মানুষ বেশি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা শহরের প্রতিটি এলাকা ধরে জনসংখ্যার এই হিসাব এখনও বের করেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর বা কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপ। কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপ মূলত জোর দিয়েছে শনাক্তকৃত মানুষের সংখ্যার ওপর। এই তথ্যের প্রধান সূত্র আইইডিসিআর। স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রতিদিন অন্যান্য পরিসংখ্যানের সঙ্গে করোনায় নতুন ও মোট আক্রান্তের তথ্য প্রকাশ করে। আইইডিসিআরও তাদের ওয়েবসাইটে আক্রান্তের তথ্য প্রকাশ করে। আইইডিসিআর ঢাকা শহরের তথ্য বিস্তারিত দেয়ার পাশাপাশি আট বিভাগের প্রতিটি জেলার তথ্য দেয়। সেই তথ্যে ত্রুটি আছে। তথ্যের ত্রুটি নিয়ে দুই মাস আগেও একাধিক গণমাধ্যম প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু বিষয়টি আমলে নেয়নি আইইডিসিআর। এ বিষয়ে অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, নমুনা সংগ্রহের সময় সঠিকভাবে ঠিকানা না নেয়ার কারণে তথ্যে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে সেই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সঠিক পরিকল্পনামাফিক কাজ না করলে এলাকাবাসীই লকডাউনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে-এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে কার্যকর উদ্যোগ না নেয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখনও যদি করি, করব বলে সময় নষ্ট করি, তা হলে ঘোর অন্ধকার বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করে আছে। যেভাবে নির্ধারিত হবে রেড জোন ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হলো ঢাকা মহানগরীর যেসব এলাকায় প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ৬০ জন বা তার বেশি মানুষের শরীরে করোনা শনাক্ত হবে, ওই এলাকাকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বা লাল এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। আর ঢাকার বাইরে কোন এলাকায় যদি প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ১০ জন বা তার বেশি করোনা রোগী থাকে, তাহলে সেটি লাল এলাকা হবে। আর ঢাকায় প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ৩ থেকে ৫৯ জন আক্রান্ত হলে সেটি হবে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বা হলুদ এলাকা। ঢাকার বাইরে লাখে ৩ থেকে ৯ জন রোগী থাকলে হলুদ এলাকা হবে। আর কোন সংক্রমণ নেই বা এক লাখ মানুষের মধ্যে তিনজনের কম আক্রান্ত থাকলে সেই এলাকাটিকে নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বা সবুজ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। রেড জোনের পুরো এলাকা লকডাউন হবে না ॥ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এবারের ভিন্নমাত্রার লকডাউন বাস্তবায়নের কাজটি হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের অধীনে। সিটি কর্পোরেশনগুলো স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে। এই লকডাউন বাস্তবায়নের কাজে যুক্ত আছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, সীমিত এলাকা নিয়ে লকডাউনের চেষ্টা হচ্ছে। কারণ এই পরিস্থিতিতে মোকাবেলার জন্য সামর্থ্যও একটি বিষয়। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও বলেছেন, রেড জোন চিহ্নিত কোন বড় এলাকায় নিয়ে লকডাউন হবে না। একটি এলাকার সংক্রমণ বেশি থাকা অংশটিকে লকডাউন করা হবে। এটি পর্যায়ক্রমে হবে বলে জানান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে জোনভিত্তিক (রেড, ইয়েলো এবং সবুজ) লকডাউন শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী সরকার রেড, ইয়েলো ও গ্রীন-এই তিনটি জোনে চিহ্নিত করবে। বেশি আক্রান্ত এলাকাকে রেড, অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত এলাকাকে ইয়েলো ও একেবারে কম আক্রান্ত বা আক্রান্তমুক্ত এলাকাকে গ্রীন জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। রেড জোনকে লকডাউন করা হবে, ইয়েলো জোনে যেন আর সংক্রমণ না বাড়ে সেই পদক্ষেপ নেয়া হবে। সতর্কতা থাকবে গ্রীন জোনেও। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্রম অবনতির মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর গত ১ জুন সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা সভায় বসেন। ওই সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী করোনা সংক্রমণের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন এলাকাকে রেড, ইয়েলো ও গ্রীন জোনে ভাগ করার কথা জানান।
×