ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘গুজবে কান না দিয়ে সচেতন হোন’

প্রকাশিত: ১১:০৬, ২৩ এপ্রিল ২০২০

‘গুজবে কান না দিয়ে সচেতন হোন’

রুমেল খান ॥ ‘ভারতে গোমূত্র পান এবং বাংলাদেশে থানকুনি পাতা খেলে করোনা হবে না ... এগুলো গুজব। একেবারেই কুসংস্কার। আমি তো পাতা খাইনি, আমার গোষ্ঠীর কাউকেও খেতে দেইনি! আমাদের পাশের কিছু গ্রামে গুজব ছড়িয়েছে নারকেল গাছের গোড়ায় পানি ঢাললে করোনা হবে না। কি হাস্যকর! আসলে সচেতন হওয়াটাই বেশি দরকার গুজবে কান না দিয়ে।’ কথাগুলো যার, আগামী ১৮ জুন তার বয়স হবে ১৭। শৈশব থেকেই তার স্বপ্ন ছিল ফুটবলার হওয়ার। শুরুতে প্রতিবেশী আর স্বজনদের বাঁকা কথা শুনতে হয়েছে অনেক। সেসব উপেক্ষা করে ফুটবল খেলে কুড়িয়েছেন সুনাম। হয়েছেন তারকা। নিজের অদম্য চেষ্টায় নজর কেড়েছেন ফুটবলপ্রেমীদের। বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের রক্ষণভাগের এক অতন্দ্র প্রহরী আঁখি খাতুনের কথাই বলছি। করোনা ক্রান্তিকালে দেশের সব খেলাধুলা বন্ধ। ফলে ঘরে বসে বেকার হয়ে পড়েছেন আঁখি। মহিলা ফুটবল লীগ যেদিন বন্ধ হয় (১৮ মার্চ), সেদিনই গ্রামের বাড়িতে (সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের পাড়গোলা) চলে আসেন তিনি। লীগে বসুন্ধরা কিংসের হয়ে খেলার সময় আঁখিকে বেশ মোটা মনে হয়েছিল। কারণটা ছিল এসএসসি পরীক্ষার (বিকেএসপির শিক্ষার্থী) কারণে মাস খানেক ফুটবল থেকে দূরে থাকা। এখন তো খেলাই বন্ধ। তাহলে ওজন কি আগের মতোই আছে? ‘না, চার কেজি কমে এখন আমার ওজন ৬০ কেজি। এটাই আমার স্ট্যান্ডার্ড ওয়েট।’ জনকণ্ঠকে জানান বাইরের দেশের লীগে খেলা, সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়া এবং বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখা আঁখি। আরও যোগ করেন, ‘জাতীয় দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন স্যার দু-তিন দিন পর পরই ফোন দিয়ে খোঁজ-খবর নেন। জানতে চান ফিটনেস ধরে রাখতে কি করছি। প্রতিদিন ফজর নামাজরে পড়ে বাড়ির সামনের রাস্তায় বাবা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে ১০ মিনিট ধরে জগিং করি। এরপর বাসায় এসে কোর (এক ধরনের ব্যায়াম) করি। ভাইয়া মাঝে মাঝে আমাকে বল দিয়ে প্র্যাকটিস করায়।’ প্রথমবারের মতো মহিলা লীগ খেলতে বেশ রোমাঞ্চিত ছিলেন জাতীয় সব বয়সভিত্তিক দলে খেলে ১১ গোলের অধিকারী আঁখি। তবে জমে ওঠার সময়টাতেই করোনার প্রাদুর্ভাবে লীগ বন্ধ হয়ে যায়। ফুটবল থেকে দূরে থাকায় বেশ হতাশ ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির অধিকারী এবং জাতীয় দল ও বসুন্ধরা কিংসের হয়ে ১৮ নম্বর জার্সির মালকিন আঁখি। একমাত্র জগিং করতে যাওয়া বাদে বাড়ির বাইরে বেরই হন না সেন্টার ব্যাক আঁখি। ঘরে থাকার সময় দিনে ৮-৯ বার করে সাবান দিয়ে হাত ধোন। অবসর কাটে মাকে রান্নাবান্নার কাজে সাহায্য করে, লুডু খেলে ও গল্পের বই পড়ে। প্রবাস ফেরত বাংলাদেশীরাই করোনার বিস্তারের জন্য দায়ী বলে মনে করেন আঁখি। ‘হোম কোয়ারেন্টাইন মানায় তারা একদমই সচেতন ছিল না। তাছাড়া ১০ দিনের সরকারী ছুটি পেয়ে যারা পাগলের মতো গ্রামের বাড়ি ও বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে গিয়েছিল, তারাও কম দায়ী নয়।’ দেশ এখন অঘোষিত লকডাউনে। এতে খাদ্যসঙ্কটে পড়েছেন গরিব ও নি¤œ আয়ের মানুষরা। তাদের বাঁচানো প্রসঙ্গে আঁখির ভাষ্য, ‘সরকার তো সাহায্য করছেই। তবে তাদের এই সাহায্য যাদের মাধ্যমে পৌঁছায় সেই জনপ্রতিনিধিরাই আবার চাল-তেল চুরি করে তা আত্মসাৎ করছেন। এতে অসহায়রা বঞ্চিত হচ্ছেন। এমন হলে তো সমস্যাা। মধ্যবিত্তরাও অনেক সমস্যায় আছে। কারণ তারা লজ্জায় কারও কাছে কিছু চাইতে পারে না।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে সাবিনা খাতুন ও জেরার্ড পিকের ভক্ত আঁখি বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হলেই রোগী মারা যাবে, এমনটা নয়। কিন্তু চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সবারই আছে। কাজেই ডাক্তারদের মানসিকতার উন্নতি ঘটিয়ে রোগীকে সেবা দিতে হবে।’ সর্বশেষে আঁখি জনকণ্ঠের পাঠকদের উদ্দেশে বলেন, ‘সরকারী নিদের্শনা মেনে চলুন। ঘরে থাকুন।’ বাবা সাবেক তাঁতী আক্তার হোসেন। মা গৃহিণী নাছিমা বেগম। বড় ভাই নাজমুল ইসলাম। ছোট্ট টিনের ঘরে বসতি আঁখির পরিবারের। প্রায়ই অসুস্থ থাকেন বাবা। সংসার চালাতে হয় আঁখিকেই। ফুটবল খেলে যে ১৬-১৭ লাখ টাকা আয় করেছেন, তা দিয়ে ব্যাংকে এফডিআর করেছেন। তাই দিয়েই চলে সংসার। ২০১৭ সাফ অ-১৫ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় গোল্ডেন বুটজয়ী আঁখির পরিবারকে ৫ শতক জায়গা বরাদ্দ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু আজও সেই প্রতিশ্রুতি জমি পাননি আঁখির পরিবার। আঁখির হতাশা, ‘এ নিয়ে সিরাজগঞ্জের এমপি হাসিবুর রহমানকে জানিয়েছি। তিনি কেবল আশ্বাস দিয়েই যাচ্ছেন।’ আঁখির উত্থান ২০১৪ সালে, বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল থেকে (পাড়গোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়)। ২০১৫ সালে জাতীয় দলের ক্যাম্পে (অ-১৪) ডাক আসে। এরপর প্রতিটি বয়সভিত্তিক দলে খেলেন। খেলেছেন সিনিয়র জাতীয় দলেও।
×