ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজকাল তরুণরা প্রমিত বাংলা স্বীকার করে না ॥ আনিসুজ্জামান

প্রকাশিত: ১০:০৫, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 আজকাল তরুণরা প্রমিত বাংলা স্বীকার করে না ॥ আনিসুজ্জামান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলায় একটি প্রমিত ভাষা আছে। কিন্তু আজকাল তরুণরা এই প্রমিত ভাষা স্বীকার করে না। তারা মনে করে এই ভাষা ভাগীরথী নদী তীর এলাকার ভাষা। তারা মনে করে এই ভাষা কলকাতার। তাদের এই মনোভাব একদিনে গড়ে ওঠেনি। দেশে নানা ধরনের পরিবর্তনের কারণে তারা এক রকম সচেতনভাবে বাংলা ভাষাকে বিকৃত করে আসছে। সবচেয়ে বেশি বিকৃতি ঘটছে ভারতীয় টেলিভিশনের কারণে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা বাংলা ভাষা শেখার আগেই হিন্দী ভাষা শিখে নিচ্ছে। এফএম রেডিও, বাংলাদেশের টেলিভিশনও ভাষার বিকৃতির ক্ষেত্রে দায়ী। ইংরেজী মাধ্যম নামে একটি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এখানেও ভাষার চরম বিকৃতি ঘটছে। বাংলা ভাষার বিকৃতি বন্ধে এক সময় আমাকে প্রধান করে একটি কমিটি করে দিয়েছিল হাইকোর্ট। ওই কমিটির পক্ষ থেকে একটি রিপোর্ট তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু যে বিচারপতি এই কমিটি করে দিয়েছিলেন-তিনি ততদিনে অবসরে চলে যান। এ কারণে ওই রিপোর্টটি আর আলোর মুখ দেখেনি। রবিবার রাজধানীর বিলিয়া মিলনায়তনে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি আয়োজিত ‘বাংলাভাষার বিকৃতি রোধে জনসচেতনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামন এ কথা বলেন। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে আলোচনায় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভাষা সৈনিক ও আনবিক বিকিরণ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির সভাপতি বিচারপতি এবাদুল হক, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। আলোচনা সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক। মূল বক্তব্যে বলা হয়, ভাষার প্রশ্নে বলতে হলে বলতে হবে ৫০ এর দশকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সবকিছুর মধ্যে একটা জাগরণ তৈরি হয়েছিল। তখন প্রমিত বাংলার একটা চর্চা আমরা লক্ষ্য করেছি। আঞ্চলিক ভাষা থাকলেও নাগরিক জীবনে প্রমিত বাংলাই চর্চা হতো। কিন্তু এই ধারাটি নষ্ট হয়ে যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। তখন রাতারাতি অনেক কিছু নাম নাম বদল করা হয়। বাংলাদেশ বেতারের নাম করা হয় রেডিও, রাষ্ট্রপতিকে করা হয় প্রেসিডেন্ট। বাংলাভাষাকে বিকৃতি করার এই ধারাবাহিকতা এখন চরম আকার ধারণ করেছে। এর আগে ’৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আরও একটি বড় ক্ষতি হয়ে যায়। তখন একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই এক পরাশক্তি নিজেদের সুবিধামতো বিশ্বের দেশে ধর্মীয় মৌলবাদ ছড়িয়ে দেয়। শুধু যে ইসলামে এই মৌলবাদ ছড়ানো হয়েছে তা না। বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যেও মৌলবাদ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তৈরি করেছে বাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়ন। এসব করেই আজ ভাষার ওপর বিভিন্ন ভাষার প্রভাব তীব্র হয়ে পড়েছে। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো নিজ নিজ ধর্মের আদলে ভাষাকে ব্যবহার করছে। কিন্তু ভাষা যে একটা জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় সে বিষয়টি ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো মানছে না। তারা নিজ নিজ ধর্মের আবরণ দিয়ে ভাষাকে বিকৃত করছে। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ’৭৫ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী গড়ে তুলে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। মাদ্রাসার ব্যাপকতায় বাংলা ভাষার মধ্যে আরবির বিরাট একটা প্রভাব পড়েছে। আবার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল করে ভাষাকে আরও বিকৃতি করা হয়েছে। সরকারী নথিপত্র যথাযথভাবে লেখা হচ্ছে না। সরকারী নথি তো রীতিমতো বাংলিশ হয়ে গেছে। প্রচার মাধ্যম বেতার টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে ভাষাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যে ভাষার চরম বিকৃতি ঘটছে। সম্প্রতি সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তো ভাষাকে নিষ্ঠুরভাবে বিকৃতি করা হচ্ছে। বাংলা বানানে ইংরেজী ও হিন্দীর প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়েছে। আমাদের তরুণ সমাজ মনে করেন বাংলা ভাষার তুলনায় ইংরেজী ও হিন্দী বেশি গতিশীল ভাষা। ফলে তাদের কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব দিন দিন কমে যাচ্ছে। পাকিস্তান সময়ে আমরা মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন করেছি। কেন করেছি তার একটা লক্ষ্য ছিল। সেই লক্ষ্য হচ্ছে বাংলা রাষ্ট্র ভাষা হলে চাকরি পাওয়া যাবে। উর্দু হলে চাকরি পেতে বাঙালীদের অনেক কষ্ট হবে। কিন্তু সেই মায়ের ভাষাকে আমরা নিজেরাই গলা টিপে হত্যা করছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বাংলাভাষার প্রকৃতি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে না। দেশের মূল ভাষা হবে বাংলা সেই ভাষাকেই যদি ভালভাবে শিক্ষা না দেয়া হয় তাহলে সাংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রেই আমাদের পিছিয়ে পড়তে হবে। আজকে ভাষাকে যেভাবে বিকৃত করা হচ্ছে এখান থেকে মুক্তি পেতে হলে সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে। কঠোর হাতে বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলা একাডেমির ভূমিকা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় এবং তাদের এগিয়ে আসতে হবে। যতদিন যাচ্ছে বাংলাদেশেই বাংলাভাষা সংকুচিত হচ্ছে। অবস্থা দৃষ্টে আবারও একটি ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। আলোচনা সভায় বক্ততারা বলেন, বাংলাভাষাকে প্রমিত বাংলায় রূপ দিতে ’৫২ চেতনায় ফিরে যেতে হবে। এ জন্য সরকারের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কার্টার সেন্টার প্রতিনিধি দলের সাক্ষাত বাসস জানায়, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সচিবালয়ের তথ্য মন্ত্রণালয়ে রবিবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারী সংস্থা কার্টার সেন্টারের বাংলাদেশ সফররত প্রতিনিধি দল সাক্ষাত করেছে। সাক্ষাতে তারা নারীদের তথ্য অধিকার ও আইনী সহায়তা বৃদ্ধিতে সরকার গৃহীত কার্যক্রমের প্রশংসা করেন। তথ্যমন্ত্রী এ কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতার কথা জানান ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন। বিশ্বে শান্তি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৮২ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থার আইনের শাসন বিভাগের পরিচালক (ডিরেক্টর- রুল অব ল) লরা নিউম্যানের নেতৃত্বে উর্ধতন সহযোগী পরিচালক গ্যাবি সলটেরো, সহযোগী পরিচালক ক্যারি ম্যাকি ও বাংলাদেশে কার্টার সেন্টারের চীফ অব্ পার্টি সুমনা এস মাহমুদ বৈঠকে যোগ দেন।
×