ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রন্থমেলা প্রতিদিন

ছিমছাম পরিবেশ জমজমাট পাঠকের অপেক্ষা

প্রকাশিত: ১১:০৮, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ছিমছাম পরিবেশ জমজমাট পাঠকের অপেক্ষা

মনোয়ার হোসেন ॥ মিলিয়ে গেছে দুপুরের চিকচিকে রোদ্দুর। নেমেছে শীতমাখা বিকেল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলার প্যাভিলিয়ন পাঠক সমাবেশে তেমন ভিড় নেই। প্রায় ফাঁকা বই বিতানে প্রবেশ করলেন ফারহানা রহমান নামের এক বইপ্রেমী। হাতে তুলে নিলেন ‘নির্বাচিত উক্তি : শেখ হাসিনা’ শিরোনামের বইটি। পাতা উল্টে গভীর মনোযোগে পড়তে শুরু করলেন বইয়ের প্রথম উক্তিটি। সেই উক্তির লাইনগুলো এ রকম- ... জাতির পিতাও শিল্পী ছিলেন। তবে ক্ষেত্র রং-তুলির জগতে ছিল না। তিনি ছিলেন রাজনীতির নান্দনিক শিল্পী। বাঙালীর মানসে তিনি শুধু স্বাধীনতার বীজমন্ত্র এঁকে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম উক্তিটি পড়া শেষ হতেই গ্রন্থানুরাগী কিনে নিলেন চমৎকার প্রচ্ছদ ও বিন্যাসের বইটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উক্তিসমূহের সংকলিত বইটির সম্পাদনা করেছেন মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। দেশে-বিদেশে শেখ হাসিনা প্রদত্ত ভাষণ, বিবৃতি এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধের চুম্বক অংশ নিয়ে সাজানো হয়েছে গ্রন্থটি। বই বিতানটির বিক্রয়কর্মী সাগর মল্লিক জানালেন, মেলার শুরুর দিকে তেমন পাঠক না এলেও যারা আসছেন তাদের অনেকেই সংগ্রহ করছেন বইটি। মঙ্গলবার ছিল হাঁটি হাঁটি পা ফেলে চলা অমর একুশে গ্রন্থমেলার তৃতীয় দিন। এখনও সেই অর্থে পাঠকের পদচারণায় মুখর হয়নি মেলা। ছিমছাম ভাব থাকলেও অল্পস্বল্প পাঠকের আগমনে এগোচ্ছে মেলা। হাতে গোনা কিছু স্টল বা প্যাভিলিয়নের সামনে পাঠক চোখে পড়লেও অধিকাংশই পাঠকশূন্য। অধিকাংশ স্টলে এখনও মিলছে না প্রকাশনা সংস্থাগুলোর ক্যাটালগ। তেমনিভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেলায় না এসে রয়ে গেছে ছাপাখানায়। উল্টোদিকে এবার বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে ৮ লাখ বর্গফুটের বিস্তৃত পরিসরের মেলায় তথ্যকেন্দ্র থাকলেও নেই স্টলের নির্দেশনা। ফলে পাঠকদের নির্দিষ্ট স্টল খুঁজে পেতে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। দুপুরবেলায় মেলার উদ্যান অংশে কথা হয় রুবাইয়াত রহমানের সঙ্গে। হাতে কিছু বইয়ের ব্যাগ নিয়ে ঘোরা এই পাঠক বললেন, মেলার এই সময়টা বেশ ফাঁকা থাকে। ফলে স্টলে ভিড় কম থাকায় সময় নিয়ে দেখে বই কেনা যায়। যেহেতু বই কিনতে আসি মেলায় প্রথম দিকেই চলে এলাম। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প, সৈয়দ শামসুল হকের জলেশ্বরী সমগ্র কিনলাম। আরও কিছু বই কিনব। তবে এবার মেলার পরিসর বাড়লেও কোন নির্দেশনা নেই। ফলে বিশাল প্রান্তরজুড়ে সজ্জিত মেলায় নির্দিষ্ট স্টলটি খুঁজে পেতে ঝামেলা হচ্ছে। মেলার সার্বিক অবস্থা নিয়ে ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশের প্রকাশক আদিত্য অন্তর বলেন, এখনও সেই অর্থে পাঠকের আগমন ঘটেনি বইমেলায়। ঢিলেঢালাভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্য বছর শুরুর দিকেই ব্যাপক পাঠক সমাগম না ঘটলেও এবারের মতো এতটা খরা যায়নি। তাছাড়া বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাণিজ্যমেলার সময় বাড়ানোর প্রভাবটিও পড়েছে বইমেলায়। আশা করছি আগামী শুক্রবার থেকে জমে উঠবে মেলা। নালন্দা প্রকাশনীর প্রকাশক রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল বলেন, শুরুতেই বইমেলা জমে না। তাই বলে কোন বছরই প্রথমদিকে পাঠকের সংখ্যা এতটা কম থাকে না। পাঠক না থাকায় বইয়ের বিকিকিনিও নগণ্য। নতুন বইয়ের খবর : বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী মেলার তৃতীয় দিনে নতুন বই এসেছে ৮১টি। এর মধ্যে উপন্যাসগ্রন্থ এসেছে ১৮টি। গল্পগ্রন্থ ৪টি, প্রবন্ধ ৩টি, কাব্যগ্রন্থ ১৯টি, ছড়ার বই ১টি, শিশুসাহিত্য ৩টি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই ৭টি, নাট্যবিষয়ক ১টি, বিজ্ঞানবিষয়ক ২টি, ইতিহাসবিষয়ক ১টি, রাজনীতিবিষয়ক ১টি, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক ৭টি, রম্যবিষয়ক ৩টি, অনুবাদ ২, সায়েন্সফিকশন ২ এবং অন্যান্য বিষয়ের বই বেরিয়েছে ৬টি। গ্রন্থগুলোরমধ্যে রয়েছে পাঞ্জেরী থেকে এসেছে আলম তালুকদারের শিশুতোষ গ্রন্থ ‘রূপকথার আজবকথা’, মারুফ রসূলের উপন্যাস ‘কাক্সিক্ষত খসড়া’। বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়েছে হারুন-অর-রশিদের ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব কী ও কেন’। আগামী থেকে বেরিয়েছে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বই ‘গান্ধীর দর্শন ও শেখ মুজিবের রাজনীতি’ ও রফিকুল ইসলামের ‘মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র’। অবসর থেকে এসেছে ইমরান কায়েসের উপন্যাস ‘জন্মান্তর’। অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে এসেছে মোশতাক আহমেদের উপন্যাস ‘লাল ডায়েরি’। অন্যপ্রকাশ থেকে বেরিয়েছে হক ফারুক আহমেদের কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘ দরিয়ার মাঝি’, সাদাত হোসাইনের উপন্যাস ‘মেঘের দিন’ ও সুমন্ত আসলামের উপন্যাস ‘যদি কখনো’। অনন্যা থেকে বেরিয়েছে মুনতাসীর মামুনের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই ‘বঙ্গবন্ধুর জীবন-জেল থেকে জেলেÑ১৯৫০-১৯৫৫’ ও শামসুর রাহমানের ‘উপন্যাসসমগ্র’। বিভাস থেকে এসেছে নির্মলেন্দু গুণের বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বই ‘মুজিবসমগ্র’। কথাপ্রকাশ এনেছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘একই সূত্রে গাঁথা’। মেলামঞ্চে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বইয়ের আলোচনা : মঙ্গলবার বাংলা একাডেমি আঙ্গিনায় বইমেলার মূলমঞ্চে অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ রচিত ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব : কী ও কেন’ বই বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় । মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী। আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক এম অহিদুজ্জামান ও সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু। লেখকের বক্তব্য প্রদান করেন অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ। সভাপতিত্ব করেন কবি কামাল চৌধুরী। প্রাবন্ধিক বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঐতিহাসিক পটভূমিতে বঙ্গবন্ধুর ‘প্রথম বিপ্লব’ অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি, ‘বাংলাদেশ বিপ্লব’ হিসেবে সর্বদাই বিবেচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং বাংলাদেশের প্রতি অনুগত, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-আদর্শ বিশ্বাসী সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি জাতীয় দল গঠন করে। বঙ্গবন্ধুর এ উদ্যোগ রাজনৈতিক বিপ্লবের দ্বিতীয় ধরন। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রধান লক্ষ্যই তৎকালীন বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। ব্যাপক ও বিস্তৃত কর্মসূচীর সার-সংক্ষেপের কারণে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব : কী ও কেন গ্রন্থটি ব্যাপক প্রচার ও পাঠ কাম্য। গ্রন্থের লেখক হারুন-অর-রশিদ বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর জীবন ও আদর্শ বিষয়ক অনেক গ্রন্থ লেখা হলেও তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লব নিয়ে গবেষণাধর্মী ও বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ নেই। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের গুরুত্বকে তুলে ধরাই এই গ্রন্থের মূল প্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শকে বুঝতে হলে দ্বিতীয় বিপ্লবের পটভূমি ও এর দার্শনিক রূপ উপলব্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। আলোচকবৃন্দ বলেন, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব : কী ও কেন গ্রন্থে তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী ও প্রেক্ষাপট বস্তুনিষ্ঠভাবে উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী তার সারা জীবনের রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শ থেকে উৎসারিত যার মূলে ছিল সাম্য ও সাধারণ মানুষের মুক্তির চিন্তা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সব কর্মসূচীই মূলত ধাবিত হয়েছে দ্বিতীয় বিপ্লবের দিকে যার একুশ শতকীয় রূপ আমরা দেখতে পাই ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর ধারণার মধ্যে। আমাদের কাজ হবে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচীকে ব্যাপকভাবে সামনে নিয়ে আসা এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সাম্যের আদর্শনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সভাপতির বক্তব্যে কামাল চৌধুরী বলেন, তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন তুলে ধরার যে দায়িত্ব আমাদের রয়েছে তা কেবল আবেগ দিয়েই সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন গবেষণা ও অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক জীবনের পর্যালোচনা। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব : কী ও কেন এ জাতীয় গ্রন্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সাংস্কৃতিক পরিবেশনা পর্বে কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি কাজী রোজী, কবি সানাউল হক খান, দিলারা হাফিজ ও কবি আসাদ মান্নান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী বেলায়েত হোসেন, গোলাম সারোয়ার, ঝর্ণা সরকার। সঙ্গীত পরিবেশন করেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, লিলি ইসলাম, সারোয়ার হোসেন বাবু ও জয়ন্ত আচার্য। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন সুবীর চন্দ্র ঘোষ (তবলা), গাজী আবদুল হাকিম (বাঁশি), ইফতেখার হোসেন সোহেল (কী-বোর্ড) এবং নাজমুল আলম খান (মন্দিরা)। লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কথাশিল্পী হাবিব আনিসুর রহমান, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, লেখক অঞ্জন আচার্য ও শিশুসাহিত্যিক পলাশ মাহবুব। আজকের মেলা : বুধবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার চতুর্থ দিন। মেলা চলবে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে অজয় দাশগুপ্ত রচিত বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন কৌশল ও হরতাল শীর্ষক আলোচনা। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সুভাষ সিংহ রায়। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন নূহ-উল-আলম লেনিন ও আবু সাঈদ খান। সভাপতিত্ব করবেন রামেন্দু মজুমদার। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, আবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
×