ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হান্ডিয়ালের কুঠিতেও সিরাজবিরোধীরা কুমন্ত্রণায় বসত

প্রকাশিত: ১০:২১, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯

 হান্ডিয়ালের কুঠিতেও সিরাজবিরোধীরা কুমন্ত্রণায় বসত

সমুদ্র হক ॥ এলাকার নাম হাঁড়িয়াল। ইংরেজরা ওদের ভাষার মতো নাসিকা ধ্বনিতে উচ্চারণ করত ‘হান্ডিয়াল’। বাঙালীরা শ্বেতপ্রীতি লাভে বলত হান্ডিয়াল। ব্যস, হয়ে গেল হান্ডিয়াল। সেদিনের এই জনপদ আজ সম্প্রীতির বন্ধন। পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার শেষ সীমানা হান্ডিয়াল চলনবিলের দক্ষিণপারকে করেছে সমৃদ্ধ। ইতিহাসের দর্শনীয় নানা স্থাপনা বিলপারের নিভৃত প্রান্তরের প্রাকৃতিক দৃশ্যে মন ছুঁয়ে যায়। বড়াল নদীর তীর ও বিলপারের চাটমোহর নিয়ে আছে একটি গল্প। পঞ্চদশ শতকে এই এলাকায় সোনার মোহর বেচাকেনা হতো। ছিল ডাকাতের উপদ্রব। কারবারিরা ডাকাতের ভয়ে চটের থলিতে মোহর ভরে আনত। পরে চটের থলি আর মোহর একত্রিত হয়ে স্থানীয়দের মুখে নামকরণ হয় চাটমোহর। তবে এর সত্যতার সন্দেহ দূর করে দিয়েছে বাংলাদেশ তথ্য বাতায়ন (জুন ’১৪)। চাটমোহরের অনেক প্রসিদ্ধ স্থাপনার একটি চৌধুরীবাড়ী। এই বাড়ির রয়েছে আরেক পরিচয়। তা হলো : জোড়াসোঁকোর ঠাকুরবাড়ির কবিগুরুর পরিবারের সঙ্গে সাহিত্যের দিকপাল প্রমথ চৌধুরীর পরিবারের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। চাটমোহরে বাঙালী সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অনেক অধ্যায়ের চিহ্নের এক বড় কীর্তি হান্ডিয়াল। চাটমোহরের শেষ সীমানা হান্ডিয়ালের অপরপ্রান্তে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা। তাড়াশ নামটি এসেছে ত্রাস শব্দ থেকে। ব্রিটিশ শাসনামলে ত্রাসের জ্বালায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল অতিষ্ঠ। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বণিকদের আবেদনে হান্ডিয়ালে থানা স্থাপন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৯ সালে থানা সদর চলে যায় হান্ডিয়াল থেকে প্রায় ১৪ কিমি দূরের চাটমোহরে। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে চাটমোহর উপজেলার পরিচিতি পায়। একদার দুর্গম-বন্ধুর পথ চলনিবলের এখন অনেক সড়ক পাকা। চাটমোহর থেকে মান্নাননগর পর্যন্ত বাঁধের ওপর দিয়ে নতুন পাকা সড়ক হয়েছে। সেখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে হান্ডিয়াল। এই হান্ডিয়াল লালন করছে বুড়াপীরের মাজার, শাহীপথ, জগন্নাথের মন্দির, গোপীনাথের মন্দির ও বিগ্রহ মন্দির, দোলমঞ্চ, শেঠের বাংলোসহ নানান স্থাপত্য। বুড়াপীরের মাজারের আরেক পরিচয় বারো আউলিয়ার সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন একজন পীর, যিনি বুড়াপীর নামে পরিচিতি পান। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর মাজারটি সংরক্ষণ করেছে। হান্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দিরের নক্সা স্থাপত্যশৈলীতে সেই যুগেও আধুনিক মাত্রা এনে দেয়। মন্দিরের একাংশের দেয়ালে পোড়ামাটির ফলক (টেরাকোটা) ইতিহাসের কয়েককালের পরিচিতি দিয়েছে। গত শতাব্দীর শেষদিকে জগন্নাথ মন্দিরের পাশেই একই নক্সায় আরেকটি মন্দির নির্মিত হয়েছে। এই মন্দিরের নাম জগন্নাথ মন্দির। কাছাকাছি স্থানে আছে গোপীনাথের মন্দির ও বিগ্রহ। বছরের নির্দিষ্ট তিথিতে গোপীনাথ মন্দিরের বিগ্রহ এক মন্দির থেকে আরেক মন্দিরে রাখা হয়। সারা বছর ওই বিগ্রহ থাকে। হান্ডিয়াল মন্দির ঘিরে ওই এলাকা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে। মন্দিরের কাছের দোল মঞ্চ এবং শাহী পথ তীর্থযাত্রীদের মিলনমেলায় রূপ নিয়েছে। শেঠেরবাংলো কার্যত একটি মন্দির। যে স্থাপনা স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বাসঘাতক সহচর জগৎশেঠ গংকে। কাশিমবাজার কুঠির পর এই বাংলোতেই জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, ঘষেটি বেগম, ইয়ার লতিফ, মীর জাফর আলী খাঁ ইংরেজ বেনিয়া ওয়াটসনের সঙ্গে বৈঠক করতেন। এই হান্ডিয়ালেই তৃতীয় মুঘল স¤্রাট আকবরের রাজত্বকালে প্রশাসনিক কার্যক্রমের সুবিধার্থে একজন সুবেদার ও একজন কাজী নিযুক্ত ছিলেন। শাহী সুবেদারের অধীনে ছিল মুঘলদের ৫ হাজার সেনা, ছিল সেনানিবাস। এরও আগে- পাঠান রাজত্বকালে সে সময়ের প্রমত্তা করতোয়া তীরের এই এলাকা ব্যবসাবাণিজ্যের বড় বন্দর ছিল। এখানে মুর্শিদাবাদ থেকে বজরায় ঢাকায় পৌঁছার আগে কিছুটা সময় হান্ডিয়ালে অবস্থান করতেন মুঘলরা। হান্ডিয়াল বাজারটি ছিল বর্ধিষ্ণু -এর এক দালানে উঠে সব দালানের ছাদে ছাদে ঘুরে আসা যেত। কোম্পানি আমলে উন্নত বন্দর হান্ডিয়ালে গড়ে ওঠে রেশম ও তাঁতের কাপড়ের কেনাকাটার কুঠি। দিনে দিনে ব্যবসার প্রসার ঘটে। এক সময় আরও সম্প্রসারিত হয়ে ভারতবর্ষে ছাড়িয়ে ইংল্যান্ডে পৌঁছে। ভারতবর্ষে যত রেশম উৎপন্ন হতো তার চার-ভাগের তিনভাগই হান্ডিয়াল বাজারে পাওয়া যেত। এই সমৃদ্ধ হান্ডিয়াল থেকেই ব্রিটিশরা রেশম ও তুলা নিয়ে যেত স্বদেশে। চাটমোহর ও সংলগ্ন হান্ডিয়াল এলাকায় বিশাল আয়তনের যে ৫০ দীঘি আছে তা এক অপরূপ নিসর্গ। পূর্ণিমার রাতে এই দীঘির জল মৃদু ঢেউ খেলে প্রকৃতিতে ধ্রুপদী মাত্রা এনে দেয়। মনে হয় ওই দীঘির জলে চাঁদ নাচছে, তারা নাচছে। এমন নিসর্গ অবগাহনের মধ্যেই বাংলাসাহিত্যের নতুন ধারার সব্যসাচী লেখক প্রমথ নাথ চৌধুরী ১৮৬৮ সালে হরিপুর চৌধুরীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রমথ চৌধুরীর সেই বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। দখল হয়ে গেছে অনেক জায়গা। প্রমথ চৌধুরীর ‘ইশ্বরী পাটনী’ গল্পের সেই মন্ত্রশক্তির মন্দিরটিও রক্ষা করা হয়নি। সবকিছু ছাপিয়ে চাটমোহরের হান্ডিয়ালের কিংবদন্তি ঘোষ পরিবার। এরা দই ও মিষ্টির এমন ধারা তৈরি করে যে কলকাতার সাহেব-বাবুরা হান্ডিয়ালের মিষ্টি ছাড়া কিছুই বুঝত না। কথিত আছে- ইংরেজরা এই এলাকার মিষ্টির জন্য ৭শ’ গোয়ালা পালন করত। তাদের কাজ ছিল নানা ধরনের মিষ্টান্ন বানিয়ে কলকাতায় পাঠানো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হান্ডিয়ালকে গুরুত্ব দিয়ে ‘বিশেষ পরগনা’ বানিয়ে ব্যবসাবাণিজ্যসহ প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করে। হান্ডিয়াল পরগনার সীমানা ছিল অনেক বিশাল। একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে যেতে নদী পথেই কয়েক দিন লাগত। অবশ্য ১২৯৪ বঙ্গাব্দের প্রলয়ঙ্করী ভূকম্পনে এই জনপদের অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। যার সাক্ষ্য মেলে এখনও। যে কোন স্থান খুঁজলে উঁকি দেয় ইট-পাথরের টুকরো। দীঘির জলে ডুব দিলেও পায়ে শক্ত কিছুর ছোঁয়া লাগে। চাটমোহরের এই মাটিতেই জন্মেছেন প্রজন্মের জনপ্রিয় নাট্যাভিনেত্রী শাহনাজ খুশি, নাট্যকার অভিনেতা বৃন্দাবন দাস। এরা নাটকে চাটমোহরের বৈচিত্র্যের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে পূর্বসূরির ধারা ধরে রেখেছেন। প্রায় তিন লাখ জনঅধ্যুষিত ৩০৫ দশমিক ৬৩ বর্গকিমির হান্ডিয়াল ও চাটমোহর শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। ১৮ স্কুল, হান্ডিয়াল কলেজসহ সাতটি ডিগ্রী কলেজ, একটি মহিলা কলেজ, একটি টেকনিক্যাল ও বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট, যা চাটমোহরের শিক্ষা বিস্তারকে করেছে আরও সমৃদ্ধি।
×