ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন দেখেও দেখছে না

ফসলি জমিতে সোলার প্লান্ট, মামলা দিয়ে কৃষকদের হয়রানি করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ১১:১০, ৬ নভেম্বর ২০১৯

ফসলি জমিতে সোলার প্লান্ট, মামলা দিয়ে কৃষকদের হয়রানি করা হচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ ॥ ময়মনসিংহে আবাদি কৃষি জমি বিনষ্ট করে চলছে সোলার পাওয়ার প্লান্ট প্রকল্প স্থাপনের কাজ। অভিযোগ উঠেছে, প্রকল্পের জমি নিতে চাঁদাবাজিসহ কৃষকদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। ফলে প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছে না নিরীহ কৃষক। এমতাবস্থায় ইচ্ছেমতো কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে মাটি ফেলে জমি জবরদখল করে নিচ্ছে প্রভাবশালী সোলার পাওয়ার প্লান্ট কর্তৃপক্ষের ভাড়া করা স্থানীয় গু-া-মাস্তান বাহিনী। বিএনপিপন্থী স্থানীয় আমিরুল ইসলাম লিটন ও তার সহযোগী বাহিনী এই জুলুম চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জমি দখল বাণিজ্যে ইতোমধ্যে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনেছেন এই আমিরুল। এক সময়কার নিঃস্ব আমিরুল এখন চলাফেরা করেন দামী গাড়িতে। গড়েছেন অগাধ সম্পদের পাহাড়। স্থানীয় প্রশাসনও নাকি আমিরুলের কথায় চলে! ফলে এসব জুলুম অবিচারের প্রতিকার চেয়ে আবেদনের পরও স্থানীয় প্রশাসনের কোন সহায়তা মিলছে না। সবকিছু দেখে শুনে চুপ প্রশাসন! এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ এলাকার নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। ময়মনসিংহ-৩ গৌরীপুর আসনের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন আহমেদ এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, স্থানীয় প্রশাসনের মদদে সোলার পাওয়ার প্লান্ট কর্তৃপক্ষের নিয়োগ করা একটি প্রভাবশালী গু-া-মাস্তান সিন্ডিকেট এলাকার নিরীহ কৃষকদের ফসলি জমিতে মাটি ফেলে জবরদখল করে নিচ্ছে। এই ক্ষেত্রে কোন ক্ষতিপূরণ কিংবা জমির মূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে না। এত বড় একটি প্রকল্পে এই ধরনের জুলুম ও অবিচার গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন এই সংসদ সদস্য। স্থানীয় ভাংনামারি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মফিজুন নূর খোকা জনকণ্ঠকে জানান, প্রকল্পের জন্য জমি জবর দখলের পর টাকা পরিশোধ করা হয়নি এরকম ২৩ একর জমির মালিকের আবেদন তার পরিষদে জমা পড়েছে। বিষয়টি প্রকল্পের চেয়ারম্যানকে একাধিকবার অবহিত করার পরও কোন সাড়া না মেলায় হতাশ এই ইউপি চেয়ারম্যান। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, গৌরীপুর উপজেলার ভাংনামারি মৌজায় পুরনো ব্রহ্মপুত্র পাড়ে সরকারের খাস খতিয়ানের ১৫ একরসহ ১৭৪ একর জমিতে চলছে এইচডিএফসি সিন পাওয়ার লিমিটেড নামে ‘সুতিয়াখালি ৫০ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্লান্ট’ স্থাপনের কাজ। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের ব্যক্তি মালিকানার যৌথ বিনিয়োগে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে গত ২০১৬ সালে শুরু হওয়া এই কাজ চলতি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে এই সোলার পাওয়ার প্লান্টের উৎপাদিত বিদ্যুত যোগ হবে জাতীয় গ্রীডে-এমনটাই জানিয়েছেন প্রকল্পের চেয়ারম্যান। চায়না ফুজিয়ান ইয়োংফা পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড প্রকল্পের কাজ তদারকিসহ প্রযুক্তি সহায়তা দিচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের জমিতে মাটি ভরাটের কাজ, রাস্তার উন্নয়ন, সীমানা প্রাচীরের জন্য কাঁটা তারের বেড়া তৈরি, ভৌত অবকাঠামোসহ সোলার প্যানেল বসানোর বেসমেন্ট তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী বছরের গোড়াতে উৎপাদনে যেতে এখন কাজ চলছে ঝড়োগতিতে। যদিও স্থানীয়দের সাঙ্গ জমি নিয়ে বিরোধের এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি। উল্টো স্থানীয়দের সঙ্গে পাওনা নিয়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের মতবিরোধ চরমে উঠেছে। উদ্ভব ঘটেছে একাধিক মামলা মোকাদ্দমার। জমির মালিকানার মামলা নিয়ে প্রকল্প স্থাপনের কাজ যে কোন সময় ঝুলে যাওয়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও প্রকল্পের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন শফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, স্থানীয়দের সঙ্গে বসে জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হবে। কিন্তু প্রকল্পের চেয়ারম্যানের এই ধরনের কথায় আস্থা নেই স্থানীয়দের। ফলে ন্যায্য পাওনাসহ মালিকানা থেকে বঞ্চিত অর্ধশত কৃষক ইতোমধ্যে জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন কর্মসূচীর কথা ভাবছেন। ময়মনসিংহ সদরের সুতিয়াখালি গ্রামের কৃষক আজিজুর রহমান (৫২)। আরওআর, এসএ ও বিআরএস রেকর্ডমূলে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ৯২ শতাংশ জমির মালিক তিনি। বাংলা ১৪২৬ হালসন নাগাদ এই জমির ভূমি উন্নয়নকরও পরিশোধ আছে তার। ‘সুতিয়াখালি ৫০ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্লান্ট’ বেসরকারী প্রকল্পের জন্য আজিজুর রহমানের পুরো ৯২ শতাংশ ফসলি কৃষি জমি জবরদখল করা হয়েছে। এজন্য কোন ক্ষতিপূরণ পাননি বলে অভিযোগ আজিজুর রহমানের। ইতোমধ্যে মাটি ফেলে তার ফসলি জমি ভরাটসহ জবরদখল করা হয়েছে। নানা মহলে ধর্ণা দিয়েও কোন প্রতিকার পাননি তিনি। ফলে অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছেন তিনি। এরকম জুলুমের যারা প্রতিবাদ করেছেন তাদের চাঁদাবাজিসহ মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পুলিশ দিয়ে হয়রানিতে ফেলে জবরদখল করে নেয়া হয়েছে আবাদি জমি। অভিযোগ প্রভাবশালী পাওয়ার প্লান্ট কর্তৃপক্ষের স্থানীয় প্রতিনিধি আমিরুল ইসলাম লিটন ও তার সহযোগী গু-া-মাস্তানরা প্রশাসনের মদদে এই জুলুম করছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মী সুতিয়াখালি গ্রামের মোর্শেদ আলী এরকম একজন ভুক্তভোগী। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সিএস নিলামের ৩৪ একর জমি প্রকল্পে দিতে ন্যায্যমূল্য দাবি করার জের ধরে ১০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি ও মারামারির ঘটনায় ৩টি হয়রানিমূলক মামলায় জড়িয়ে দেয়া হয় মোর্শেদকে। চাঁদাবাজির মামলায় টানা ২৯ দিন হাজতবাস করে জামিনে ছাড়া পান তিনি। জমির মালিকানা নিয়ে আদালতে মামলা করায় এখন আছেন চরম হুমকিতে। এক ধরনেই জুলুমের শিকার সুতিয়াখালি গ্রামের কৃষক জামাল উদ্দিন, আবুল কাশেম, বাবুল মিয়া, হাবুল মিয়া, গোলাম মোস্তফা, গোলাম মাওলা, মোর্শেদ আলী, আব্দুর রেজ্জাক, আনোয়ারা বেগম, লাভলী আক্তার, রুমেলা, রবিলা, আব্দুর বারেক, মশিউর রহমান, লিটন হোসেন, দীন ইসলাম, কাশিয়ার চর গ্রামের জয়নাল আবেদীন, ভাঙনামারী গ্রামের আমছর আলীসহ বয়রা ও চকছত্রপুর গ্রামের অনেকে। স্থানীয়দের দাবি সোলার প্রকল্পে অন্তত ২শ’ পরিবারের জমি পড়েছে। এর মধ্যে অন্তত অর্ধ শত পরিবারের সদস্যরা কোন ক্ষতিপূরণ কিংবা জমির মূল্য পায়নি। ‘প্রকল্পের জন্য ২০ শতাংশ উঠতি আমন জমিতে জোরপূর্বক মাটি ফেলে ভরাট করা হয়েছে। বাকি ৬০ শতাংশ আমন জমিতে দেয়া হয়েছে কাটা তারের বেড়া’। কীভাবে এই জমি উদ্ধার করবেন কিংবা বেহাত হওয়া এই জমির মূল্য পাবেন জানা নেই সুতিয়াখালি গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম এর। এ নিয়ে চরম পেরেশান তিনি। অথচ ১৯৯০ সালে সাফ কলামূলে কেনা এই জমির ভূমি উন্নয়ন কর হালসন নাগাদ পরিশোধ করা আছে তার। ১৯৯০ সালের পর থেকে জমির ভোগদখলও ছিল তার। ভাংনামারি গ্রামের আমছর আলী সিএস ও এসএ রেকর্ডে ১২ একর জমির মালিক। বিআরএস রেকর্ড খাস খতিয়ান হওয়ায় আমছর আলীর ভোগ দখলে থাকার পরও এই জমিসহ ১৫ একর জমি সরকারের পক্ষে ময়মনসিংহের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস প্রকল্প চেয়ারম্যানের নামে রেজিস্ট্রি করে দেন। ময়মনসিংহের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) এএইচএম লোকমান জনকণ্ঠকে জানান, ৩০ বছর নদী সিকস্তি থাকলে ওই জমি খাস খতিয়ানভুক্ত হবে। তবে এজন্য এডি লাইন করে হাত নক্সার ডিম্যারগেশন থাকতে হবে এবং ভূমি উন্নয়নকর বন্ধ রাখার বিধান রয়েছে। অথচ ভাংনামারি মৌজার ১৫ একর খাস জমির ক্ষেত্রে এটি মানা হয়নি। ফলে তৎকালীন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই জমি প্রকল্পের চেয়ারম্যানের নামে রেজিস্ট্রি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। এদিকে সব অভিযোগ অস্বীকার করে পাওয়ার প্লান্ট কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি আমিরুল ইসলাম লিটন জানিয়েছেন, তার কোন বাহিনী নেই। তিনি নিজে কোন মামলার বাদী নন। কোম্পানির পক্ষে জমি কেনা কাটায় তিনি এলাকাবাসীকে সহায়তা করছেন মাত্র।
×