শরীফুল ইসলাম ॥ কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে ত্রিমুখী অবস্থানে বিএনপি। দলের কিছু নেতা তাঁকে জামিন দিয়ে উন্নত চিকিৎসার দাবি জানিয়ে আসছেন। আর কিছু নেতা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে চান। আবার পারিবারিক অবস্থানে থেকে যারা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন স্বজনরা চাচ্ছেন, যে কোনভাবেই হোক খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে। এ জন্য তারা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন। সূত্র মতে, দলের সব নেতাই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন এবং যে কোন সময় যে কোন কিছু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে তাঁর সুচিকিৎসা দাবি করার পাশাপাশি কারাবন্দী থাকা অবস্থায় কিছু হলে সরকার দায়ী থাকবে বলে হুমকি দিয়ে আসছেন। কিন্তু কেউই প্রকাশ্যে খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তির কথা বলছেন না। এমনকি বিএনপি পন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাব নেতারাও খালেদা জিয়াকে ধীরে ধীরে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করলেও প্যারোলে মুক্তির কথা বলছেন না। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে চাইলে তাঁর প্যারোলে মুক্তি চাইতে হবে। দলের কোন কোন নেতা ও খালেদা জিয়ার স্বজনদের প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে আগ্রহ থাকলেও লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাজি না থাকায় দলের অন্য নেতারাও এ বিষয়ে কিছু বলছেন না।
একদিকে বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার স্বজনরা বলছেন, কারাগারে সুচিকিৎসার অভাবে তাঁর জীবন সঙ্কটাপন্ন, যে কোন সময় কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে- খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অবস্থার উন্নতিও হয়েছে। আর অভিজ্ঞ মহল মনে করছে, বিএনপি নেতা এবং খালেদা জিয়ার স্বজনরা যদি মনে করেন তাঁর শারীরিক অবস্থা সত্যিই সঙ্কটজনক তাহলে তাদের উচিত আগে তাঁর জীবন বাঁচানো। আর আইনী প্রক্রিয়ায় তার যেহেতু জামিন হচ্ছে না তাই বিএনপি বা খালেদা জিয়ার স্বজনদের উচিত প্যারোলে মুক্তি চাওয়া। কিন্তু তারা একদিকে খালেদা জিয়ার জীবন সঙ্কটাপন্ন বললেও তাঁর প্যারোল চাচ্ছেন না। তাহলে বিএনপি বা খালেদা জিয়ার স্বজনরা কি চাচ্ছেন না তিনি বেঁচে থাকুন, নাকি এটা নিয়ে রাজনীতি করতে চাচ্ছে তারা। যদি রাজনীতি না করতে চান তাহলে যেভাবে তাঁকে ভাল রাখা যায় তাই তো করতে হবে বিএনপি বা খালেদা জিয়ার স্বজনদের।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যে মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাবন্দী রাখা হয়েছে সে মামলায় তিনি জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন। গুরুতর অসুস্থ খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। তাই আমরা চাই অবিলম্বে তাঁকে জামিন দেয়া হোক। তিনি জামিন পেলে আমরা তাঁর উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চাই। তবে আমরা প্যারোল চাইব না। কারণ, সরকারের উচিত মানবিক দিক বিবেচনা করে তাঁকে জামিন দিয়ে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেয়া।
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, আমরা আইনী প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা এখন খুবই খারাপ। তাই আমরা আশা করছি তাঁকে জামিন দিয়ে উন্নত চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে। তবে আমরা প্যারোল চাইব না, আমরা চাই জামিন যোগ্য মামলায় তাঁকে জামিন দেয়া হোক।
সূত্র জানায়, বিএনপির কিছু নেতা ও খালেদা জিয়ার স্বজনদের সিগন্যাল পেয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপ চেয়েছিলেন দলীয় এমপিরা। এমপি জিএম সিরাজ বলেছিলেন- বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা ৭ এমপি সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বলতে চাই, আপনি নিজে একবার দেখে যান আমাদের দলের চেয়ারপার্সন ও তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। আমরা নিশ্চিত আপনি যদি নিজে এসে দেখে যান আপনার মানবিকবোধ জাগ্রত হবে, আপনার মায়া হবে। তাই আপনার কাছে আমাদের সবিনয় অনুরোধ আপনি আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। আমাদের নেত্রী রাজনৈতিক বন্দী। আমরা বিশ্বাস করি, তাঁর জামিনে মুক্তির জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া তাঁর মুক্তি হবে না। তিনি তো বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসা পাচ্ছেন না। তাই বিদেশে চিকিৎসার প্রয়োজন হলে যাবেন। সে সময় খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়টি আদালতের ব্যাপার বলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন। তখন জিএম সিরাজ বলেছিলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া কি ম্যাডামের মুক্তি হবে? এর পর বিএনপি দলীয় এমপিদের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা জোরদার করে। কিন্তু তারেক রহমান ও দলের কিছু সিনিয়র নেতার বাগড়ার কারণে সমঝোতার পথ থেমে যায়।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে গিয়ে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত শেষে তাঁর স্বজনরা অভিযোগ করেন, তাঁকে সুচিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। তাই তাঁকে তারা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে চান। এ সময় খালেদা জিয়ার মেজবোন সেলিমা ইসলামের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান, তাঁকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে প্যারোলে মুক্তি চান কিনা। এ সময় তিনি প্যারোলের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আমরা চাই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে পাঠাতে, সরকার আমাদের এ সুযোগ করে দেবেন সেটাই আমরা আশা করছি। সেলিমা ইসলাম বলেন, খালেদা জিয়ার শরীর খুবই খারাপ। তাঁর পা বেঁকে গেছে। চলতে পারছে না, শুয়ে থাকতেও তার কষ্ট হচ্ছে। তিনি উঠতে পারেন না, বসতে পারেন না, নিজের হাতে তুলেও খেতে পারেন না, কিছুই করতে পারেন না তিনি। তাই আমরা উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠাতে চাই। খালেদা জিয়া বিদেশে যেতে চান কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। আমরাই বিদেশী পাঠাতে চাচ্ছি। কারণ এখানে যে চিকিৎসা দিচ্ছে এতে কিছুই হচ্ছে না। বরং দিনের পর দিন খারাপ হচ্ছে। তাই উনারা যদি জামিন দেন তাহলে খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে পারবেন।
এ ছাড়া সম্প্রতি দলীয় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন। আমরা তার জামিনে মুক্তি চাইলেও তিনি যাতে জামিন পেয়ে বের হতে না পারেন সরকার সেই চেষ্টা করছে। সরকারই তার জামিন আটকে দিয়েছে। অবিলম্বে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে তিনি বলেন, জামিনে মুক্তি পেলে চিকিৎসা কোথায় করাবেন সে সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই নেবেন। তবে খালেদা জিয়ার জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন। তার সুস্থ অবস্থায় আর ফিরে না আসার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। নিজের খাবার নিজে খেতে পারছেন না। হাঁটতে পারেন না। যে হাসপাতালে তিনি রয়েছেন সেখানে তাকে সঠিক চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। আমি বার বার বলেছি, খালেদা জিয়ার জামিন তাঁর অধিকার। তিনি জামিন পেতে পারেন। কিন্তু তাঁকে জামিন দেয়া হচ্ছে না।
ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি পুরোপুরি আদালতের ওপর নির্ভর করছে-সরকারের পক্ষ থেকে এমনটা বলা হলেও সরকার পুরোপুরি খালেদা জিয়ার জামিন আটকে দিয়েছে এবং তিনি যাতে কখনই বের হতে না পারেন তারা সে চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা শুধু খারাপই নয়, তার অবস্থা এখন অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন। তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করতে চাইছে সরকার। তিনি বলেন, একই রকম মামলায় সবার জামিন হলেও খালেদা জিয়ার জামিন আটকে দেয়া হচ্ছে। তাকে কারাগারে রেখেই মেরে ফেলতে চাইছে সরকার। অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ধীরে ধীরে মৃত্যু হোক, সরকার তাই চায়। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ শারীরিক অসুস্থতার কারণে জামিন পেলেও আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাগারে অসুস্থ হলেও তাঁকে জামিনে দেয়া হচ্ছে না। খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তারাও তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারটা তুলে ধরেছেন। এটা তাদের পরিবারের বক্তব্য। খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে দলীয় বক্তব্য হচ্ছে, আমরা বার বার যেটা বলে আসছি, তিনি জামিন পেলে তাঁর পছন্দমতো তিনি যেখানে ইচ্ছা চিকিৎসা করাবেন। এটা তাঁর অধিকার। তাঁর যে অসুখ যদি যথাযথ চিকিৎসা না হয়, তাহলে এটা আরও খারাপের দিকে যাবে। ওখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। এই কথাটা আমরা বহুবার বলেছি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি যদি খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে চায় তাহলে প্যারোলে মুক্তি চাচ্ছে না কেন? তাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হলে তো প্যারোলে মুক্তি চাইতে হবে।
এদিকে বিএনপির একটি বড় অংশ আন্দোলন করেই খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা বললেও বাস্তবে আন্দোলনও করছে না দলীয় নেতাকর্মীদের অনীহার কারণে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্নও করা হচ্ছে, কেন বিএনপি আন্দোলনে যাচ্ছে না। দলের তৃণমূল পর্যায় থেকেও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে সম্প্রতি দলীয় এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আমরা কিছুই করতে পারিনি। আরেক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার অভিযোগ করেনÑখালেদা জিয়াকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে এক শোচনীয় পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বন্দী হওয়ার অনেক আগে থেকেই খালেদা জিয়া নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। কারাবন্দী হওয়ার পর গুরুতর অসুস্থতার কারণে এখন স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া করতে পারছেন না। তিনি এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
আমরা অবিলম্বে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই। ক্রমান্বয়ে তিনি ঘাড়, মেরুদ- ও নানাবিধ সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। এ মতাবস্থায় অভিজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে তার চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু কারাগারে তার সুচিকিৎসা হচ্ছে না। এ জন্য তাকে বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি করার দাবি জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির সেলিমা রহমান বলেন, খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ, তিনি হাঁটাচলা করতে পারছেন না। আমরা বার বার বলেছি তাঁকে বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। আশা করব তাঁকে জামিনে মুক্তি দিয়ে সুচিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ দেয়া হবে।