ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুফতি শহীদ দুবাইয়ে বসে বাংলাদেশে নাশকতার ছক কষছে

প্রকাশিত: ১০:১৩, ১ নভেম্বর ২০১৯

  মুফতি শহীদ দুবাইয়ে বসে বাংলাদেশে নাশকতার ছক কষছে

শংকর কুমার দে ॥ বিএনপি-জামায়াত জোটের সাবেক এমপি মুফতি শহীদুল ইসলাম দুবাইয়ে বসে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশে নাশকতা-নৈরাজ্যের ছক কষছে। এ তথ্য মিলেছে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে। বাংলাদেশে নাশকতার জন্য জঙ্গী সংগঠন হরকাত-উল-জিহাদের (হুজি) জঙ্গীদের জিহাদী প্রশিক্ষণে ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নাশকতায় মদদ দিতে তাদের সংগঠিত করার তথ্য মিলেছে তার বিরুদ্ধে। দুবাই থেকে দেশে ফেরার পর হুজি নেতা আতিকুল্লাহ ওরফে আসাদুল্লাহ ওরফে জুলফিকার নামের এক জঙ্গী নেতাকে গ্রেফতারের পর জবানবন্দীতে এই তথ্য পায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। সিটিটিসি সূত্র জানায়, ৪ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুটি এনজিওর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সরকার। এই দু’টি এনজিওর মধ্যে একটি মুফতি শহীদের মারকাজুল ইসলাম বা মারকাজ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত আন্তর্জাতিক এনজিও ‘আদ্রা’ ও ‘আল-মারকাজুল ইসলামীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের আর্থিক সহায়তা ও মহাসমাবেশে টি-শার্ট, গেঞ্জি সরবরাহের অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে তাদের শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্প নয়, সারাদেশের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে এই দুটি এনজিওর সব ধরনের ব্যাংক লেনদেন বন্ধ রাখারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের দু’বছর পূর্তি উপলক্ষে তারা মহাসমাবেশ করে উখিয়ার কুতুপালং মধুরছড়া মাঠে। সমাবেশে রোহিঙ্গাদের সাদা টি-শার্ট ও গেঞ্জি সরবরাহ করে আল-মারকাজুল ইসলামী। মুফতি শহীদ দীর্ঘদিন পাকিস্তানে ছিলেন। সে দেশেই পড়াশোনা করেন। পাকিস্তানে পড়াশোনাকালে দুবাইয়ে তার নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল। সে সময় আমিরাতের শেখদের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই সম্পর্কের ভিত্তিতেই দেশে এসে এনজিওর আড়ালে জঙ্গী কার্যক্রম শুরু করেন মুফতি শহীদ। সিটিটিসি সূত্র মতে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর দেশব্যাপী যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির ওপর সন্ত্রাসের যে তা-বলীলা চলে তার নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম ছিল বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নড়াইল-২ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মুফতি শহীদুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে আগে থেকেই হুজিবিকে পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ ছিল। গ্রেফতারের পর জবানবন্দী দেয়া জঙ্গী নেতা আতিকুল্লাহ হুজিবির পুরনো শীর্ষ নেতা। ’৯১ সালে দারুল মা’আরিফ মাদ্রাসায় পড়ার সময় মাওলানা আব্দুস সালাম, মুফতি আব্দুল রউফ, হাফেজ ইয়াহিয়াদের মাধ্যমে হুজিবিতে যোগ দেয়। আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধ করতে গিয়ে তালেবানের শীর্ষ নেতা মোল্লা ওমর ও আল কায়েদার শীর্ষ নেতা নিহত ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গেও সাক্ষাত করে আতিকুল্লাহ। এই আতিকুল্লাহ সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়ার পর তার দেয়া জবানবন্দীতে মুফতি শহীদুল্লাহর দুবাই বসে বাংলাদেশে নাশকতার ছক কষার গুরুত্বপূর্ণ খবর দিয়েছে। সিটিটিসি জানায়, মারকাজ থেকেই উত্থান মুফতি শহীদের। ১৯৮৮ সালে প্রথম আল মারকাজুল ইসলামী বাংলাদেশ নামে এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সংস্থাটি প্রথমে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু এনজিও কার্যক্রমের আড়ালে মুফতি শহীদ হরকাত-উল-জিহাদ জঙ্গীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন প্রভাবশালী এক কওমি আলেম। নব্বই’র শুরুতে মোহাম্মদপুরে মারকাজের কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে বাবর রোড ও শ্যামলীতে সংস্থার নিজস্ব সম্পত্তি রয়েছে। সে সময়ে দেশের বিভিন্ন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির অর্থ-সহযোগিতায় দিনে দিনে পরিসর বাড়ে মারকাজের। এই অর্থায়নে সৌদি আরব, কাতার, দুবাই, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ ছিল। মারকাজের অর্থায়নে পরে দুর্গম অঞ্চলে মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়া গরিব নারীদের বিভিন্ন ট্রেনিংও দেয়া হয় এই এনজিওর তত্ত্বাবধানে। কিন্তু এসবের আড়ালেই হরকাত-উল-জিহাদসহ অন্যান্য জঙ্গী সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে সংগঠনের বিরুদ্ধে। সিটিটিসির এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, আশির দশকের শেষ দিকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসেন মুফতি শহীদ। প্রকাশ্যে রাজনীতিতে নামেন অষ্টম সংসদ নির্বাচনের কিছু আগে। আল মারকাজুল ইসলামীর নামে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সংগৃহীত অর্থে দেশে প্রকাশ্য রাজনীতিতে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। যোগ দেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে। ২০০১ সালে নড়াইল-২ আসন থেকে উপ-নির্বাচনে তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শরিক দল ইসলামী ঐক্যজোটের (অবিভক্ত) এমপি নির্বাচিত হন তিনি। উপ-নির্বাচনের আগে মূল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মুফতি শহীদ পরাজিত হন চার হাজার ভোটের ব্যবধানে। ওই নির্বাচনের পরই আলোচনায় আসেন মুফতি শহীদ। নির্বাচনের পর তিনি প্রয়াত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র আমির মনোনীত হন। মুফতি শহীদ ২০০১ সালের নির্বাচনের কিছুদিন আগে খেলাফত মজলিসে যোগ দেন। ২০০৮ সালেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। এরপর ’১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকলেও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা পেতে চাইলেও নির্বাচন কমিশন তা বাতিল করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের ও জঙ্গী সংগঠন হুজিকে সংগঠিত করতে নাশকতার ছক কষেন দুবাইয়ে বসেই। এ জন্য গোপনে এ বছর দেশে আসেন। আবার গোপনেই দেশত্যাগের পর সম্প্রতি ধরা পড়েন তার বিশ্বস্ত জঙ্গী আতিকুল্লাহ কারণে। আতিকুল্লাহর জবানবন্দীতেই মুফতি শহীদ দুবাই বসে রোহিঙ্গা ও জঙ্গীদের নিয়ে নাশকতা চালানোর চেষ্টার খবর মেলে ।
×