ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভবনের সব পুড়ে ছাই হলেও পাশের ফ্ল্যাটে ন্যূনতম আঁচ লাগেনি

ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাটে আগুন, ষাটোর্ধ মহিলার মৃত্যু নিয়ে রহস্য!

প্রকাশিত: ১০:০৫, ২৭ অক্টোবর ২০১৯

  ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাটে আগুন, ষাটোর্ধ মহিলার মৃত্যু নিয়ে রহস্য!

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকার অভিজাত এলাকা ধানমন্ডির একটি বাড়িতে বড় ধরনের রহস্যজনক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। বাড়িটির দোতলা ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েতউল্লাহর মালিকাধীন। ফ্ল্যাটে লাগা আগুন অবশ্য অন্য কোন ফ্লোরে ছড়ায়নি। এমনকি পাশের ফ্ল্যাটেও আগুনের ন্যূনতম কোন আঁচ লাগেনি। রহস্যজনক সেই আগুনের ধোঁয়ায় সাততলার বাসিন্দা ষাটোর্ধ এক মহিলার রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। আগুনে ফ্ল্যাটের সবকিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শনিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ধানমন্ডি ৬/এ নম্বর সড়কের ঈদগাহ মাঠের পাশে সাউথ ব্রিজ ডেভেলপার কোম্পানির তৈরি করা ৫৫ নম্বর জহির’স সাউথ লেক ভিউ নামের ১৪তলা আলিশান বাড়ির চতুর্থ তলায় বড় ধরনের আগুন লাগে। ঘটনার পরপরই বাড়িটির বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। সন্ধ্যা সাতটায় বাড়ির ম্যানেজার শামীম উদ্দিন জনকণ্ঠকে জানান, বাড়িতে বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়েছে। তবে গ্যাস সংযোগ আপাতত বন্ধ রয়েছে। অগ্নিকান্ডের সময় ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে সাত তলার একটি ফ্ল্যাটের গৃহকর্মী জামিলা কুটির (৬৫) মারা গেছেন। নিহত জামিলার স্বামীর নাম মরহুম সাহেব আলী। বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার কচুয়া গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামালের বাড়ির গৃহকর্মী ছিলেন। আগুনের ধোঁয়ায় মেজবাহ কামালের মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বর্তমানে পান্থপথের বেসরকারী স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অবশ্য তিনি আশঙ্কামুক্ত। অগ্নিকান্ডের সময় ঘটনাস্থল থেকে ফ্ল্যাট মালিকের বড় ছেলে রাফসানকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা। রাফসানকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ভর্তি করা হয়েছিল, তবে চিকিৎসা শেষে তাকে বাড়ি পাঠিয়েছেন চিকিৎসকরা। সরেজমিনে দেখা গেছে, ১৪ তলা বাড়ির নিচে দুটি পার্কিং প্লেস। বসবাসের জন্য মূল বাড়ির দোতলা থেকে শুরু। বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এটি প্রায় সাড়ে তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট। বিশাল ফ্ল্যাটের প্রায় সব কিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তেমন কোন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। স্টিল, তামা ও কাঁসার জিনিসপত্র পর্যন্ত আগুনের তাপে দুমড়েমুচড়ে গেছে। অথচ ফ্ল্যাটের দরজা অনেকটাই অক্ষত। মাত্র পাঁচ ফুট দূরে সামনের ফ্ল্যাটে আগুনের ন্যূনতম কোন আঁচও লাগেনি। বাড়ির গৃহকর্মী শাহিদা (১৪) বলছিল, সে দোকানে গিয়েছিল। বাসার ঢোকার মুহূর্তে বিকটশব্দে কোন কিছু বিস্ফোরিত হওয়ার শব্দ শুনতে পায়। ভয়ে সে আর ভেতরে ঢোকেনি। দেখা গেছে, বিশাল ফ্রিজ প্রতিটি রুমে থাকা এসি পুড়ে দুমড়েমুচড়ে গেছে। বাড়ির অন্য বাসিন্দাদের দাবি, ফ্রিজের কম্প্রেসার বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকান্ডের এত বড় ঘটনা ঘটা প্রায় অসম্ভব। ফ্রিজের কম্প্রেসার বিস্ফোরিত হয়ে এতবড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা কতটুকু যৌক্তিক সে বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার ঘটনাস্থলে কাজ করাদের বরাত দিয়ে জানান, এ বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা কঠিন। ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। তদন্তেই বেরিয়ে আসবে অগ্নিকান্ডের প্রকৃত কারণ। ফ্ল্যাটের ম্যানেজার শামীম হোসেনের সঙ্গে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আচমকা দোতলা থেকে আগুন আগুন বলে চিৎকার শুনে ভবনের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাসিন্দারা যে যার যার মতো সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নিচে নেমে যান। কেউ কেউ ভয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে বাসিন্দাদের আতঙ্কিত না হয়ে নিরাপদে নিচে নামিয়ে আনা হয়। খবর পাঠানো হয় ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশকে। ততক্ষণে একটি বাড়ি থেকে এত মানুষের উদভ্রান্তের মতো নিচে নেমে আসায় আশপাশের এলাকায় উৎসুক মানুষের ভিড় বেড়ে যায়। মুহূর্তেই সেখানে শত শত মানুষ জড়ো হয়। নিচ থেকেই দেখা যাচ্ছিল আগুন। দেখা যায় আগুন দোতলার পশ্চিম দিকের এ-টু নম্বর ফ্ল্যাটে জ্বলছে। ঘটনার পরপরই থানা পুলিশ সেখানে হাজির হয়। সকাল দশটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনে। ফায়ারের উদ্ধারকর্র্মীরা বাসার ভেতরে আটকাপড়া দু জনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। আর গৃহকর্মী আগেই দোকানে যাওয়ায় দুর্ঘটনার কবলে পড়েনি সে। ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দায়িত্বরত কর্মকর্তা লিমা খানম জনকণ্ঠকে বলেন, ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। আর বাসায় আটকাপড়া দুজনকে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারীরা উদ্ধার করে। তারা আশঙ্কামুক্ত। আগুন অন্য কোথাও ছড়ায়নি। এমনকি পাশের ফ্ল্যাটেও আগুনের আঁচ লাগেনি। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। ক্ষয়ক্ষতি ও উদ্ধারের বিষয়েও তদন্ত চলছে। তবে শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ এ ঘটনায় কোন তদন্ত কমিটি গঠিত হয়নি। ধানমন্ডি মডেল থানার ওসি আব্দুল লতিফ বলেন, নিহতের পোস্টমর্টেম করা হচ্ছে। দুপুরে নিহতের লাশ শনাক্ত করেন বাড়ির অষ্টম তলার বাসিন্দা গৃহকর্ত্রী অধ্যাপক ডাঃ আশরাফুন্নেছা। তিনি বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি বিভাগের প্রধান। ঘটনার সময় তিনি বাসার বাইরে ছিলেন। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান তিনি। তার স্বামী অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। এ বিষয়ে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। দোতলায় আগুন লেগে সাত তলায় দম বন্ধ হয়ে নারীর মৃত্যুর ঘটনাটিকে অনেকেই রহস্যজনক বলে মনে করেন। ম্যানেজার শামীম উদ্দিন জানান, ফ্ল্যাট মালিক ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ হেমায়েতউল্লাহ। তিনি পরিবার নিয়ে ফ্ল্যাটেই বসবাস করেন। অবশ্য ঘটনার সময় তারা কেউ বাসায় ছিলেন না। এ বিষয়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলেও কেউ ফোন ধরেনি।
×