ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিজান- টোকাই থেকে কাউন্সিলর ॥ হার মানায় রূপকথাকেও

প্রকাশিত: ১১:১৯, ১৩ অক্টোবর ২০১৯

মিজান- টোকাই থেকে কাউন্সিলর ॥ হার মানায় রূপকথাকেও

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সামান্য টোকাই থেকে ঢাকার কাউন্সিলর হয়ে রীতিমতো রূপকথার গল্পকেও হার মানানো সেই হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানকে সাত দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। তাকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি মানিলন্ডারিং আইনে দায়ের করা মামলায় রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। মিজানের বিরুদ্ধে শ্রীমঙ্গলে অস্ত্র আইনে আরও একটি মামলা দায়ের হয়েছে। মিজানের মাদক নেটওয়ার্ক, টেন্ডার ও চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। টোকাইয়ের পেশা ছেড়ে ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করা শুরু করেন। এরপর আস্তে আস্তে মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাই, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পকেন্দ্রিক গড়ে তোলেন মাদকের বিশাল নেটওয়ার্ক। পাইকারি ও খুচরা মাদক ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হন। মোহাম্মদপুরের কাউন্সিলর হয়ে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। সেইসব অবৈধ টাকায় দেশে-বিদেশে বাড়ি গাড়ি কেনেন। তার অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি ও ব্যবসা থাকার তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হয় পাগলা মিজান। গত ১০ অক্টোবর রাতে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের গুহ রোডের হামিদা আবাসিক গেস্ট হাউসের সামনে থেকে মিজানকে আটক করে র‌্যাব। আটকের সময় তার কাছ থেকে একটি অবৈধ পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগজিন ও নগদ দুই লাখ টাকা পাওয়া যায়। মিজান ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। শুক্রবার ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মিজানকে নিয়ে তার মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোডের ৭/৩ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে বাড়িতে ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক ও এক কোটি টাকার এফডিআর পাওয়া যায়। তাকে নিয়ে লালমাটিয়ার কার্যালয়ে অভিযান চালানো হলেও তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। র‌্যাব-২’র অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, মিজানের শ্রীমঙ্গলে অস্ত্র আইনে একটি এবং ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় মানিলন্ডারিং আইনে একটি মোট দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। সিআইডির পরিদর্শক গিয়াস উদ্দিন শনিবার মিজানকে গ্রেফতার দেখান। এদিনই তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম নিভানা খায়ের জেসির আদালতে হাজির করে দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সামান্য টোকাই থেকে মিজান কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের মোহাম্মদপুর থানার সাধারণ সম্পাদক হয়ে রীতিমতো রূপকথার গল্পকে হার মানিয়েছেন। অভিযানে উদ্ধারকৃত টাকা ও এফডিআরের টাকার প্রকৃত উৎস নিশ্চিত করতে পারেননি মিজান। পনেরো বছর আগে তার ইটভাঁটির ব্যবসা ছিল। কিন্তু সেটি না থাকায় অর্থের প্রকৃত উৎস নিশ্চিত করতে পারেননি মিজান। এছাড়া পালিয়ে যাওয়ার আগে তিনি প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে দুই দিনে ৬৮ লাখ টাকা তোলেন। সেই টাকার কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। মিজানের আমেরিকায় ও অস্ট্রেলিয়ায় একটি করে দুটি বাড়ি আছে। রয়েছে একাধিক দামী গাড়ি। এসব সম্পদের প্রকৃত উৎস নিশ্চিত করতে পারেননি মিজান। দেশ থেকে টাকা পাচার করে তিনি বিদেশে বাড়ি কিনেছেন। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জীবিকার তাগিদে ১৯৭৪ সালে ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় এসে মিরপুরে টোকাইগিরি করতেন। এরপর হোটেল বয় হিসেবে জীবিকা শুরু করেন। এরপর মোহাম্মদপুর এলাকায় গিয়ে ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করা শুরু করেন। সেই সঙ্গে ছিনতাই, খুন-জখম, দখলদারি, চাঁদাবাজি শুরু করেন তিনি। ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি খামারবাড়ি খেজুরবাগান এলাকায় ছিনতাই করতে গেলে পুলিশ ধাওয়া দেয়। ধাওয়া খেয়ে লালমাটিয়ায় মসজিদের পাশে পুকুরে নেমে পড়েন। পুলিশ বার বার নির্দেশ দিলেও তিনি পুকুর থেকে ওঠেননি। কয়েক ঘণ্টা পর কাপড় ছাড়াই উঠে আসেন। এমন কা-জ্ঞানহীন কাজের জন্য পুলিশ তাকে পাগলা আখ্যা দিয়ে ছেড়ে দেয়। এরপর থেকেই তার নাম ছড়িয়ে পড়ে পাগলা মিজান হিসেবে। ১৯৯১ সালে তিনি নতুন করে নাম রেজিস্ট্রেশন করে নিজের নাম রাখেন হাবিবুর রহমান মিজান। ১৯৭৬ সালে ফ্রিডম পার্টির পক্ষ থেকে পাগলা মিজান, শামীম জালালী ওরফে দারোগার ছেলে শামীম, বাবুল ওরফে পিচ্চি বাবুলসহ কয়েকজন লিবিয়া গিয়ে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। শেখ হাসিনার ওপর হামলার সময় মিজান ছিলেন ফ্রিডম পার্টির ধানম-ি-মোহাম্মদপুর জোনের কো-অর্ডিনেটর। ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে আওয়ামী লীগ নেত্রী রেজিয়া বেগমের খাবার লাথি দিয়ে ফেলে দিয়ে প্রথমবার আলোচনায় আসেন। ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ধানম-ির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা চালায় ১০/১২ জনের একটি দল। হামলাকারীরা গুলি চালায় ও বোমা হামলা করে। এ সময় শেখ হাসিনা বাড়ির ভেতর অবস্থান করছিলেন। বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীরা পাল্টা গুলি চালালে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ধানম-ি থানায় একটি মামলা হয়। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ঢাকা মহানগর ও বিভিন্ন থানা কমিটি গঠিত হয়। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের সুপারিশে মিজানকে মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এদিকে ১৯৯৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলার অভিযোগপত্র দেয়। এতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ ফারুক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুর রশিদ ও মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) বজলুল হুদা এবং নাজমুল মাকসুদ মুরাদসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়। অভিযোগপত্রে মিজানুর রহমান ওরফে পাগলা মিজানকে হামলার পরিকল্পনাকারীদের একজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মিজানের ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফাও ছিলেন হামলাকারী দলের সদস্য। মোস্তফা ১৯৯৫ সালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা যান। চলতি বছরের গত ২৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে তুরাগ নদীর পাশে সিলিকন রিয়েল স্টেটের জমি দখলকে কেন্দ্র করে মোহাম্মদপুর এলাকার যুবলীগ নেতা আরিফুল ইসলাম তুহিন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর পাগলা মিজান, আদাবর এলাকার ছাত্রলীগ নেতা রিয়াজ আহম্মেদ ও সাইফুল তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে হামলা চালায়। এ সময় সন্ত্রাসীরা সিলিকন রিয়েল এস্টেটের ছয়কর্মীকে গুলি ও আরও ১৪ জনকে কুপিয়ে জখম করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা জুয়েল নামের এক কর্মীকে গুলি করে আহত করার পর ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে তার লাশ তুরাগ নদীতে ফেলে দেয়। এ ঘটনার পর আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের ডুবুরিরা দুইদিন তল্লাশির পর গত ৩১ অক্টোবর সকালে লাশটি উদ্ধার করে। মিজানের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় ১৯৯৬ সালে ইউনূস হত্যা, ২০১৬ সালে সাভার থানায় জোড়া হত্যা মামলা রয়েছে। সর্বশেষ গত ৫ অক্টোবর সরকারের পাওনা ৩১ কোটি টাকা বকেয়া বিদ্যুত বিল পরিশোধ না করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভকালে পুলিশের সঙ্গে ঢাকার মোহাম্মদপুরের উর্দুভাষী অবাঙালীদের ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের একটি গাড়ি ভাংচুরের পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সংঘর্ষে পুলিশ, পথচারী, বিক্ষোভকারীসহ অন্তত অর্ধশত আহত হয়। বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় টায়ার, ফোম, কাঠসহ বিভিন্ন দোকানের আসবাবপত্রে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ করে। সংঘর্ষে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, মার্কেট ক্যাম্প ছাড়াও হুমায়ুন রোড, তাজমহল রোড, শেরশাহ শুরী রোড, মাদ্রাসা রোড, শাহজাহান রোডসহ আশপাশের এলাকা রীতিমতো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে হয়। দুপুর বারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা নাগাদ পুরো এলাকাজুড়ে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনারও নেপথ্যে ছিল মিজানের বিদ্যুত বাণিজ্য। জেনেভা ক্যাম্প থেকে বিদ্যুত লাইন নিয়ে ক্যাম্প লাগোয়া দুটি বাজারের অন্তত তিন শ’ দোকানে দিয়েছিল মিজান। প্রতিমাসে দোকানগুলো থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিত মিজান। সম্প্রতি দুদকের সহযোগিতায় সেই সব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনা ঘটে। এরপর মিজান আবার ক্যাম্প থেকে বিদ্যুত সংযোগ দিতে চাপ দিচ্ছিল। এতে রাজি না হওয়ার সূত্র ধরেই সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে। এমন ঘটনার নেপথ্য কারিগর হিসেবে নাম আসে কমিশনার মিজান ও এসপিজিআরসির কতিপয় নেতার।
×