ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

গণতন্ত্রের স্বার্থেই ॥ অনেক কিছু হজম করে যাচ্ছি

প্রকাশিত: ১০:২৯, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯

গণতন্ত্রের স্বার্থেই ॥ অনেক কিছু হজম করে যাচ্ছি

সংসদ রিপোর্টার ॥ অনেক কিছু বলার থাকলেও গণতন্ত্রের স্বার্থে অনেক কিছু হজম করে এগিয়ে যাচ্ছি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের উচ্চ আদালত মার্শাল ল’ দিয়ে জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদের ক্ষমতা দখলকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। এই রায়ের পর এ দু’জনকে (জিয়া ও এরশাদ) আর রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করা যায় না। তবে জেনারেল এরশাদ অমায়িক ছিলেন, মানুষের প্রতি তার দরদ ছিল। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে রবিবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনের প্রথম দিন প্রয়াত বিরোধী দলের নেতা এইচএম এরশাদসহ আনীত শোক প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি আরও বলেন, দোষে- গুণে মানুষ। আমাদেরও অনেক কিছুই বলার আছে। কারণ আমরাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। তারপরও দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, জনগণের উন্নয়নের স্বার্থে অনেক কিছু হজম করে যাচ্ছি। তিনি প্রয়াত বিরোধী দলের নেতা এইচএম এরশাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা এইচএম এরশাদের শাসনামলে কারোর মনে আঘাত থাকলে বা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় আরও অংশ নেন বিরোধী দলের উপনেতা বেগম রওশন এরশাদ, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমাম, কাজী ফিরোজ রশীদ, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, আহসান আদিলুর রহমান, পীর ফজলুর রহমান, সালমা ইসলাম, নাজমা আখতার ও তরিকত ফেডারেশনের মুজিবুল বশর মাইজভা-ারী। আলোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে শোক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিরোধী দলের নেতা যিনি ছিলেন, সেই জেনারেল এরশাদ এক সময় যখন পাকিস্তান থেকে ফিরে আসেন তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাকে সেনাবাহিনীতে যোগদান করান। এক সময় তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান হন। তিনি বলেন, ১৯৮১ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল, সেই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন বিচারপতি সাত্তার। তাকে কিন্তু সেনাপ্রধান হিসেবে সাত্তারকে প্রার্থী করেছিলেন জেনারেল এরশাদ। একটি বিদেশী পত্রিকায় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন বিচারপতি সাত্তার তার প্রার্থী! সেখানেই আমরা আপত্তি তুলেছিলাম। বিচারপতি সাত্তারকে বলেছিলাম, এ ধরনের প্রার্থী হওয়া উচিত নয়। বরং নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে হতে দেন, গণতান্ত্রিক ধারা যেন বজায় থাকে। কিন্তু তারা তা করেনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতে ফলাফল এটাই হয়েছিল যে তখন বেগম খালেদা জিয়া কিন্তু রাজনীতিতে আসেনি। কিন্ত পরবর্তিতে রাজনীতিতে না এলেও হঠাৎ করে বিচারপতি ছাত্তারের বিরুদ্ধে একটা স্টেটমেন্ট দেন। বিচারপতি ছাত্তার ছিল তখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তখন খালেদা জিয়া তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বিদায় দেয়ার জন্য স্টেটমেন্ট দেয়। তিনি বলেন, ১৯৮২ সালে এরশাদ যে ক্ষমতা দখল করেছিল, সেই ক্ষমতা দখলের সুযোগটা কিন্তু খালেদা জিয়াই করে দিয়েছিলেন। করে দিয়েছিল হয়ত এ কারণেই যে, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়াকে শুধু দুটি বাড়িই নয়, নগদ ১০ লাখ টাকাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা জেনারেল এরশাদ দিয়েছিলেন। যে কারণে জিয়া হত্যার ব্যাপারে যে মামলা হয়েছিল চট্টগ্রামে, সে মামলা কিন্তু বিএনপি কখন চালায়নি। তিনি বলেন, বহু বছর পরে ১৯৯৪ সালের দিকে এক সময়ে বা বহু বছর পর এসে জেনারেল এরশাদকে তার স্বামীকে হত্যার জন্য দায়ী করেছেন খালেদা জিয়া। এর পূর্বে কখনও দায়ী করেননি। এগুলো ইতিহাসের একটা অংশ যে, ক্ষমতাটাকে তুলে দেয়া বা সুযোগ করে দেয়া। তবে এর বিরুদ্ধে আমরাই প্রতিবাদ করেছি। কারণ আমরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল প্রতিবাদ করেছিলাম এই জন্যই যে, আমরা চেয়েছিলাম গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। অর্থাৎ এক সামরিক শাসকের ক্ষমতা থেকে আরেক সামরিক শাসকের ক্ষমতা আসুক, এটা কখনও আমাদের জন্য কাম্য ছিল না। সংসদ নেতা বলেন, অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর অনেক ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমাকে চলতে হয়েছে। আমি দেশে ফিরে আসার পরে ধানম-ির ৩২ নম্বরে আমাদের বাড়িতে জেনারেল জিয়াকে আমাকে ঢুকতেই দেয়নি। এটাও বাস্তবতা। তিনি বলেন, প্রথমে মার্শাল ল’ জারি করে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করে। এরপর নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে ক্ষমতা দখল করে নেয়। এই ক্ষমতা দখল প্রথমে জিয়াউর রহমান করে। জাতির পিতাকে হত্যার পর ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। এরপর জেনারেল এরশাদও নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, উচ্চ আদালত জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদের এই ক্ষমতা দখলটাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। উচ্চ আদালত অবৈধ যখন ঘোষণা করেছে, তখন আর এই দুজনের কেউ আর সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে কিন্তু থাকে না। তাদের রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করাও হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী বৈধ নয়, বরং সেটা করা যায় না। কারণ একটা রায়ের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্রের ধারাটা অব্যাহত রাখার ধারা যোগ হয়েছে। জেনারেল এরশাদ অমায়িক ছিলেন এবং মানুষের প্রতি তার দরদ ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর জাতির পিতা সাভার স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তিতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসে। জেনারেল জিয়া কিন্তু নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিলেও কখনও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি। যেটা করেছেন জেনারেল এরশাদ। তিনি আসার পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অসমাপ্ত কাজ বা সাভার স্মৃতিসৌধের অসমাপ্ত কাজ বা মুজিব নগরের স্মৃতিসৌধ সেগুলো তৈরি করেছেন- এতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, কেউ যদি ভাল কাজ করে নিশ্চয়ই আমরা তা বলব। তাছাড়া আর একটি কাজ এরশাদ করেছিলেন। নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে যখন জেনারেল এরশাদের সঙ্গে সংলাপ করি আমাদের ১৪ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে জিয়ার আমলে জারিকৃত মৃত্যুর পরোয়ানা প্রত্যাহারের জন্য এবং তাদের মুক্তি দেয়ার জন্য। তাছাড়া অনেকেই তখন গ্রেফতার হয়ে বন্দী ছিলেন। এরশাদ সকলকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এই মুক্তি দেয়ার মধ্য থেকে তিনি এক একটা পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন। অতীতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই সময় আমি, অনেকবার আমাকে গ্রেফতার করা হয়, কারাবরণ করি। আমাদের একেক সময় গ্রেফতার, কখনও সাবজেলে রাখা হয়, আবার কখনও গৃহবন্দী করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি লালদীঘির ময়দানে আমাদের সভা করতে বাধা দেয়া হয়। সরাসরি গুলি ছোড়া হয়, সেখানে প্রায় ৩০ জনের মতো মানুষ মারা যায়। এগুলো কিন্তু এরশাদের শাসনামলেই হয়েছিল। সংসদ নেতা বলেন, আমরা সব সময় গণতন্ত্র চেয়েছি, যেন গণতন্ত্র অব্যাহত থাকে। যে কারণে অনেক প্রতিকূল অবস্থায়ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলাম ১৯৮৬ সালে, যদি সেই নির্বাচনটা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে হতো, তা হলে হয়ত তাকে এই ধরনের বিতর্কিত হতে হতো না। একটি গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠিত হতো। দল নির্বাচনের পর কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়। কারণ জেনারেল জিয়ার আমলে প্রতি রাতে কারফিউ ছিল। তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালের নির্বাচন যেটা হয় সেটাও বলতে গেলে কোন দল অংশগ্রহণ করেনি। এরপর আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করেছিলেন খালেদা জিয়া, তখনও কিন্তু কোন দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। আন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়া মাত্র দেড়মাসের মধ্যে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। সেটাও জনগণের রুদ্ররোষে। অর্থাৎ জনসমর্থন না থাকলে নির্বাচন নিয়ে যে যত বিতর্কিত হোক, যে কথাই বলুক না কেন, যদি জনসমর্থন না থাকে তবে সে নির্বাচন যদি সত্যিকার ভোট দিয়ে না থাকে তাহলে সেই নির্বাচনে কেউ টিকে থাকতে পারে না। তার প্রমাণ খালেদা জিয়ার ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন। একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও জনগণ ভোট দিয়েছে বলেই বিএনপির আন্দোলনের ডাকে দেশের জনগণ সাড়া দেয়নি। যদি নির্বাচনে জনগণ ভোট দিত, তবে তারা আন্দোলন করে আমাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারত। তাই অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়েই আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি। দেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্য নেতারা যা বলেন ॥ আলোচনায় অংশ নিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে বিরোধী দলের উপনেতা বেগম রওশন এরশাদ ব্যক্তি জীবনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ কোন ভুল-ত্রুটি করলে তার জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, অসম্ভব জনপ্রিয়, বিনয়ী ও জনদরদী নেতা ছিলেন এইচ এম এরশাদ। একজন স্ত্রী পক্ষে স্বামীর শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশগ্রহণ অত্যন্ত কষ্টের, বেদনার। দেশের মানুষকে তিনি অসম্ভব ভালবাসতেন, সত্যিকারের পল্লীবন্ধু ছিলেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমু বলেন, দোষে-গুণে মানুষ। এ মুহূর্তে তাকে (এরশাদ) নিয়ে কোন আলোচনা করতে চাই না। আমরা তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। অপর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, মানুষ মরণশীল, আমাদেরও একদিন চলে যেতে হবে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ’৭৩ সালে দেশে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধু তাকে মেজর থেকে বিগ্রেডিয়ার পর্যন্ত পদোন্নতি দিয়েছেন। তার ক্ষমতা গ্রহণের সময় আমাদের মধ্যে মত-পথের পার্থক্য ছিল। আমরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি (এরশাদ) অত্যন্ত বিনয়ী ও নরম হৃদয়ের সজ্জন মানুষ ছিলেন। প্রত্যেক মানুষের ভুল-ত্রুটি, ব্যর্থতা-সফলতা আছে। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এইচ এম এরশাদ অত্যন্ত মৃদুভাষী নেতা ছিলেন। নিজ জেলা রংপুরের প্রতি তার মমত্ববোধ দেখেছি স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে। বিরোধী দলের নেতা থাকাকালীন সময়েও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ক্ষমতায় থাকতে খুনী জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এইচ এম এরশাদও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পুরস্কৃত করেছেন, ঘৃণিত খুনী কর্নেল ফারুককে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেছিলেন। বিষয়টা আমরা ভুলে যেতে চাই, আজকের দিনে স্মরণ করতে চাই না। তবে শুধু রেকর্ড রাখার জন্য বললাম। জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের ‘অসম্ভব জনপ্রিয় নেতা’ উল্লেখ করে বলেন, ২৭ বছর রাজনীতিতে ছিলেন এইচ এম এরশাদ। গণতন্ত্র রক্ষা ও বিকাশে তিনি কাজ করেছেন। গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়েছেন। তার পুরো শাসনকাল আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথমত, ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সালে সামরিক শাসনে দেশ পরিচালনা করেছেন। দ্বিতীয় ভাগে ১৯৮৬ থেকে ৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতা হস্তান্তর পর্যন্ত। তার শাসনভাগের প্রথম ভাগকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। দ্বিতীয় ভাগের বিষয়ে উচ্চ আদালত নেতিবাচক কোন মন্তব্য করেনি। তার জীবদ্দশায় একটি সংসদ ছাড়া সব সংসদ নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেছেন। তিনি ছিলেন জননন্দিত রাজনীতিবিদ। সকল রাজনীতির সমীকরণে প্রধান নিয়ামকও ছিলেন তিনি। আসলে এইচ এম এরশাদ ছিলেন পল্লী বন্ধু। সাবেক নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, এ পৃথিবীতে একদিন চলে যেতে হবে সবাইকে। সেই পথ ধরেই বিরোধী দলের নেতা এইচ এম এরশাদ চলে গেলেন। জীবদ্দশায় অনেকের নামেই আলোচনা-সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু মৃত্যুর পর কারও সমালোচনা করা অমানবিক। বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, এই সংসদেই দাঁড়িয়ে বিনয়ী সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা করতে পারেননি। কিন্তু রাষ্ট্রপতি হয়ে তিনি টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করেছেন। বিএনপির এমপির অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, তাকে (এরশাদ) কখনই জোর করে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়নি। গণতান্ত্রিক সরকারের বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে রাষ্ট্রপতি থাকাকালে কারোর মনে দুঃখ বা আঘাত পেয়ে থাকলে, তার পক্ষ থেকে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, দেশের মানুষের যে কোন দুঃসময়ে রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন এইচ এম এরশাদ প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে দুর্গত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সবসময় শ্রদ্ধা করতেন তিনি। প্রশাসনিক সংস্কার করে উপজেলা পরিষদ করেছিলেন, জেলা বাড়িয়েছেন। দেশের মানুষ সস্তায় ওষুধ কিনে খাচ্ছেন তা এরশাদের প্রণীত ঔষধ নীতির কারণেই। বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, জন্ম হলেই মৃত্যু অনিবার্য। এইচ এম এরশাদ নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এইচ এম এরশাদ অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও তাকে (্এরশাদ) নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অত্যন্ত কঠিন সময় পার করেছেন। মানুষ হিসেবে জীবনে ভুল-ত্রুটি থাকবেই। মুসলমান হিসেবে তার ভুল-ত্রুটিকে মুছে ফেলার চেষ্টা করব, আল্লাহ যেন তাকে শান্তিতে রাখেন। তরিকত ফেডারেশনের মুজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, দোষে-গুণেই মানুষ। সবারই ভুল হয়। বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস, নাশকতার সময় বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়ে সংবিধান রক্ষায় পরবর্তী সকল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং বিরোধী দলের নেতা হয়েছেন। জীবনের শেষ দিকে এসে তার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি সংসদকে প্রাণবন্ত রেখেছেন। জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, প্রত্যেক মানুষ মরণশীল। এ দুনিয়া ছেড়ে সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে। এইচ এম এরশাদ সৌভাগ্যবান যিনি সেনাপ্রধান ছাড়াও রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় এসে টানা নয়টি বছর সফলভাবে দেশ চালিয়েছেন। কারাগারে থেকেও দুটি নির্বাচনেই পাঁচটি আসনে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। জাপার মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, অসম্ভব জনপ্রিয় নেতা ছিলেন পল্লীবন্ধু এইচ এম এরশাদ। কারাগারে থেকেও পাঁচটি আসনে বিজয়ী হয়েছেন, কখনও নির্বাচনে হারেননি। উপজেলা পরিষদের প্রবর্তক এই নেতাকে জাতি চিরজীবন মনে রাখবেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের রাজনৈতিক শিষ্টাচার সবার জন্য শিক্ষনীয়। জাপার অপর সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের কারিগর হচ্ছেন জাপা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। সারাদেশে উন্নয়ন ঘটিয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন তিনি। তার কৃত্তি অক্ষয় হয়ে থাকবে। দেশ ও জাতির জন্য তার সংস্কার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। জীবনে নির্বাচনে কোনদিন তিনি পরাজিত হননি। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন তিনি। এমনকি ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে উপজেলা পরিষদ প্রবর্তন করেছেন। ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এইচ এরশাদকে ‘ক্যারিশম্যাটিক লিডার’ আখ্যায়িত করে বলেন, পৃথিবীতে এমন কোন রাজনীতিবিদ নেই যিনি এরশাদের মতো এত বিপুল ধাপ অতিক্রম করেছেন। সেনাপ্রধান থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্রের উন্নয়নের জনক ছিলেন তিনি। অনেকে তাকে স্বৈরাচার বললেও মৃত্যুর পর সবাই স্বীকার করেছেন অত্যন্ত উদার, নরম মনের অধিকারী ছিলেন এইচ এম এরশাদ। পীর ফজলুর রহমান বলেন, জীবদ্দশায় সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ কখনও কারোর প্রতি আক্রমণাত্মক বা বিষোদ্গার করে বক্তব্য রাখেন। বরং আজীবন তার বিনয় ও ভদ্রতায় তিনি দেশের মানুষের হৃদয় জয় করে গেছেন। আরও শোক প্রস্তাব গ্রহণ ॥ সংসদে রবিবার আরও যাদের নামে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় তারা হলেন- সাবেক গণপরিষদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম, মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, সাবেক এমএলএ অধ্যক্ষ খালেদা হাবিব, সাবেক এমপি আনোয়ারা বেগম ছাড়াও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, ভারতের সাবেক অর্থ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি, জাতীয় পরিষদ সদস্য ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আ ন ম শফিকুল হক, সুফি সাধক শেখ আবদুল হানিফ, কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর নুরুল ইসলাম, একুশে পদক ও ভারতের পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত সমাজসেবী ষর্ণা ধারা চৌধুরী, ভাষা সংগ্রামী খালেকুল আল আজাদ এবং জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম অধিনায়ক আনোয়ারুল কবির শামীম।
×