ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গুর প্রকোপ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের অভিমত

অকার্যকর মশক নিধন কার্যক্রম ও সচেতনতার অভাব

প্রকাশিত: ১০:১৭, ৩১ আগস্ট ২০১৯

   অকার্যকর মশক নিধন কার্যক্রম ও সচেতনতার অভাব

নিখিল মানখিন ॥ দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির ভয়াবহ রূপ নেয়ার পেছনে অকার্যকর মশক নিধন কার্যক্রম এব্ং ডেঙ্গু বিষয়ে জনসচেতনতার অভাবই অন্যতম প্রধান দুটি কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এদেশে ডেঙ্গু নতুন কোন বিষয় নয়। চলতি বছরের শুরুতেই ডেঙ্গুর প্রকোপের বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছিল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। কিন্তু মশক নিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রমের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ তা আমলে নেয়নি। পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হয়নি। হঠাৎ করে পাল্টে যায় ডেঙ্গুর ধরন ও চিকিৎসা পদ্ধতি। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর বেশিমাত্রায় এডিস মশা প্রজননের অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। সরকারী কর্মসূচীর দিকে তাকিয়ে ভয়াবহ রূপ নেয়ার আগে রাজধানীবাসীরাও এডিস মশা নিধনে সচেতনতামূলক কোন উদ্যোগ নেয়নি। ফলে আক্রমণের অনুকূল পরিবেশ পায় এডিস মশা। ডেঙ্গু ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত গত ১৮ বছরে মোট আক্রান্ত ৫০২২৮ জন। আর এ বছর আগস্ট মাসে ৩০ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৫০৯৭৪ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অনেক দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ এবং অনেক দেশে ডেঙ্গুর জরুরী অবস্থা জারি হওয়ার পরও উদাসীন ছিল বাংলাদেশ। সিটি কর্পোরেশন দু’টির মশক নিধন কার্যক্রম যে অকার্যকর ছিল তা বিদেশ থেকে ওষুধ আনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে দিনের পর দিন প্রজননের অনুকূল পরিবেশ পেয়ে অস্বাভাবিক মাত্রায় বংশবৃদ্ধি ঘটায় এডিস মশা। রাজধানীতে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীর মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে ডেঙ্গু মশার জীবাণু। ডেঙ্গুর বাহক দু’ প্রকার এডিস মশার মধ্যে ‘এডিস এজিপ্টি’ শহরে এবং ‘এডিস এ্যালবোপিকটাস’ গ্রামাঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে। ফলে যারা ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে আক্রান্ত হয়ে গ্রামাঞ্চলে চলে যাচ্ছেন তাদের শরীর থেকে ডেঙ্গুর জীবাণু টেনে নিয়ে গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়াতে পারে এডিস এ্যালবোপিকটাস মশা। এখন পর্যন্ত ঢাকার বাইরে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাই বেশি। স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ( আইইডিসিআর) এর সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডাঃ এ এস এম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকায় আক্রান্তদের অনেকে গ্রামে চলে গেছেন। গ্রামাঞ্চলে ছড়ানোর আরেকটি কারণ হলো, ডেঙ্গু বাহক ‘এডিস এজিপ্টি’ মশা যেমন নাগরিক মশা, শহরের মশা। এ ধরনের মশা শহুরে এলাকায় মানুষের বাড়ি-ঘরে থাকে। ডেঙ্গুর আরেকটি বাহক ‘এডিস এ্যালবোপিকটাস’ থাকে গ্রামাঞ্চলে। এই এডিস এ্যালবোপিকটাস যদি কোন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে কামড় দেয় তাহলে এই মশাটিও ডেঙ্গু ছড়াতে পারে। তাই গ্রামে যারা যাচ্ছে তারা গিয়ে সেখানে যে মশার কামড় খাচ্ছে তাতে ডেঙ্গু ছড়াতে পারে। ফলে গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গুর বিস্তারলাভের সুযোগ রয়ে যাচ্ছে। আর গ্রামাঞ্চলে স্থানীয়ভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলে ডেঙ্গুর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ডাঃ এ এস এম আলমগীর। বিশেষজ্ঞরা আরও অভিযোগ করেন, বছরের পর বছর ধরে ডেঙ্গুর প্রকোপ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকার পরও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতন ছিলেন না সংশ্লিষ্টরা। এডিস মশা নিধনসহ ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম শুধু সরকারের দায়িত্ব -এই চিন্তা মাথায় নিয়ে বসে থাকেন নগরবাসী। নিজেদের বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা এডিস মশামুক্ত রাখার পেছনে তারা কার্যকর দায়িত্ব পালন করেননি। তবে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নেয়ার পর টনক পড়ে নগরবাসীর। সরকারের পাশাপাশি তারা মশক নিধনসহ ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতন হয়ে উঠেন। এ বিষয়ে আইসিডিডিআর’বির জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ড. কামরুন নাহার বলেন, বৃষ্টি হলেই যেখানে-সেখানে পানি জমে। নির্মাণকাজের সাইটে, বাড়িতে ফুলের টব কিংবা ড্রামেও পানি জমে যায়। যেদিকে মশার ওষুধ প্রয়োগকারীদের নজর থাকে না। আর নগরবাসীরাও এ বিষয়ে সচেতন থাকেন না। ফলে নির্বিঘেœ সেসব জায়গায় এডিস মশা বাড়তে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ॥ বাংলাদেশের পাশাপাশি চলতি বছর বিশ্বের অস্ট্রেলিয়া, কম্বোডিয়া, চীন, লাওস, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামসহ শতাধিক দেশ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, উষ্ণায়ন, অতিরিক্ত নগরায়ন এবং পানির উষ্ণতা এডিস মশার দ্রুত বংশবিস্তারের প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, উষ্ণ তাপমাত্রার দেশে ডেঙ্গু প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ডেঙ্গু ভাইরাসের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম। আইসিডিডিআরবি’র জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ড. কামরুন নাহার বলেন, ভেক্টর-বর্ন ডিজিসের বিশেষত্ব হলো মাধ্যম। এ ক্ষেত্রে মাধ্যম হলো এডিস মশা। মানুষের শরীর থেকে রক্ত আহরণের পর এডিস মশা স্বচ্ছ জলাশয়ে ডিম পাড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি। ফলে যে জলাশয়ে এডিস মশা ডিম পাড়ে, সেটিও উত্তপ্ত থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের পরিবেশে এডিস মশার লার্ভা স্বাভাবিকের চেয়েও কম সময়ে পরিপূর্ণ মশার অবয়ব পায়। তিনি বলেন, উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় মশা মানুষের শরীর থেকে বার বার রক্ত নিতে চায়। এর ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। আইসিডিডিআর’বি’র এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশেষ করে কলেরা, ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু জ্বরের মতো মশাবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে বড় ভূমিকা রাখছে জলবায়ু পরিবর্তন। নেচার মাইক্রোবায়োলজির এক গবেষণায় একই ফল পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের কারণে জয়বায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। যার প্রভাবে বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণও বেড়েছে। কখনও খরা, আবার কখনও বা অতিবৃষ্টির ফলে ডেঙ্গু মশার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে প্রকোপ বৃদ্ধি পেলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এ বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা অনেক কম। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার আধিক্য রাজধানীতে ডেঙ্গুর এধরনের প্রকোপ এক ধরনের বাস্তবতা। প্রত্যেক নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে। জ্বর হলে সাধারণ জ্বর মনে না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করাতে হবে। সকল হাসপাতালকেই এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া আছে। জ্বর নিয়ে সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। সচেতন থাকলে আতঙ্কের কিছু নেই। আর ডেঙ্গু প্রতিরোধকল্পে সরকারীভাবে তৈরি জাতীয় গাইড মেনে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য চিকিৎসকদের পরামর্শ দেন মহাপরিচালক। পরিসংখ্যানে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছর জানুয়ারিতে ৩৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৮ জন, মার্চে ১৭ জন, এপ্রিলে ৫৮ জন, মে মাসে ১৯৩ জন, জুনে ১৮৮৪ জন ও জুলাইয়ে ১৬২৫৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর আগস্ট মাসে একদিন বাকি থাকতেই আক্রান্ত হয়েছে ৫০ হাজার ৯৭৪ জন। আর এপ্রিলে ২ জন, জুনে ৫ জন, জুলাইয়ে ২৮ জন এবং আগস্টে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর জানুয়ারি থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে মোট ৬৯,৪৩৫ জন বলে জানিয়েছে কন্ট্রোল রুম। সরকারী পরিসংখ্যানে ডেঙ্গুতে মোট মৃতের সংখ্যা ৫২ হলেও বেসরকারী হিসাবে তা দেড় শতাধিক। আর মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। রাজধানীতে মোট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ৪ শতাধিক হলেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের আইইডিসিআর কন্ট্রোল রুমে ডেঙ্গু তথ্য প্রেরণ করে মাত্র ৪০টি সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। ঢাকার বাইরেও সরকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ ডেঙ্গু তথ্য প্রেরণ করে না। ফলে সারাদেশের মোট ডেঙ্গু রোগী ও মৃতের সংখ্যা অনেক আগেই সমালোচিত হয়ে আসছে। ডেঙ্গুর ধরন পরিবর্তন ॥ জটিল হয়ে গেছে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা। কিছু বুঝে উঠার আগেই লাইফ সাপোর্টে চলে যেতে হচ্ছে অনেক রোগীকে। ডেঙ্গুর স্বাভাবিক উপসর্গ দৃশ্যমান হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছর ডেঙ্গু ধরন বদলে গেছে। ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পরও রোগীর শরীরে থাকা ডেঙ্গু জীবাণুর ধরন বুঝতে সময় লাগছে চিকিৎসকদের। ততক্ষণে রোগীর শরীরে থাকা ডেঙ্গুর জীবাণু দ্রুত আরেক রূপ ধারণ করছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই আঘাত হানছে রোগীর ব্রেন, হার্ট ও লিভারে। ডেঙ্গুর জীবাণু আগের তুলনায় বেশ শক্তিশালী ও প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। জ্বর হওয়ার পর পরই শয্যাশায়ী হয়ে পড়ছে রোগী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যু ঘটছে অনেক রোগীর। এখন জ্বর হলে মানুষ যেমন প্রথমে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার ভয় পায়, তেমনি ডাক্তাররাও তা শনাক্ত করে চিকিৎসা করেন। কিন্তু যার ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে, তা ঠিক কোন টাইপের ডেঙ্গু, তা শনাক্ত করা হচ্ছে না। ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্য ভাইরাসজনিত রোগের মতো ডেঙ্গু রোগের সরাসরি কোন প্রতিষেধক নেই, টিকাও নেই। লক্ষণ ও অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ খান আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশসহ বিশে^র অনেক দেশ আজ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এই রোগ প্রতিরোধে জাতীয় গাইডলাইন তৈরি করেছে সরকার। নানামুখী সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ডেঙ্গুর বিষয়টি এখন মানুষ জানে। তবে এর যে গতি-প্রকৃতিতে পরিবর্তন হচ্ছে সে সম্পর্কে সচেতনতা নেই। অনেক চিকিৎসকেরও এ বিষয়ে ভাল ধারণা নেই। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে সচেতন ও সতর্ক থাকলে এবং জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সময়ক্ষেপণ না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে ডেঙ্গু থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক ও বর্তমানে আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) পরামর্শক অধ্যাপক ডাঃ মাহামুদুর রহমান বলেন, ডেঙ্গুর কারণে মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হলে তা খুবই বিপজ্জনক। অনেক চিকিৎসকের পক্ষে তা দ্রুত বুঝে ওঠা কঠিন। তাই এ বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার। তিনি জানান, চীনে মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত তিন হাজার মানুষের ওপর গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ১১ শতাংশ ডেঙ্গু থেকে মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হয়েছে। এটি আক্রান্তদের মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম। দীর্ঘায়িত হতে পারে ডেঙ্গুর প্রকোপ ॥ ডেঙ্গুর প্রকোপ দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রতি বছর আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়ে থাকে। গত ১৮ বছরের সরকারী পরিসংখ্যানে এই তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। এ বছর জুলাইয়ে শনাক্ত হয়েছে অস্বাভাবিক ডেঙ্গু রোগী। ডেঙ্গুর পিক মৌসুম হিসেবে পরিচিতি আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস। গত ১৮ বছরের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলতি বছরেও এই পিক মৌসুমে ডেঙ্গু রোগী আক্রান্তের পুনরাবৃত্তি ঘটলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে এবং তা নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠিন হয়ে পড়বে। আর একদিন বাকি থাকতেই আগস্ট মাসে ৫০ হাজার ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের চিত্রটি তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় এডিস মশা দ্বারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া, ডেঙ্গুর ধরন পাল্টে যাওয়া, ডেঙ্গু পরীক্ষার উপকরণের সঙ্কট, কার্যকর এডিস মশক নিধন কার্যক্রমের অভাব এবং সারাদেশে ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসার প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব ইত্যাদি কারণসমূহও ডেঙ্গুর প্রকোপ দীর্ঘায়িত হতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিছিন্ন বছরে ডেঙ্গুর পিক মৌসুম হিসেবে পরিচিত আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ১৪৮ জন। আর ওই বছরের জুনে ২৯৫ জন, জুলাইতে ৯৪৬, আগস্টে ১৭৯৬ জন, সেপ্টেম্বরে ৩০৮৭ জন ও অক্টোবরে ২৪০৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। ২০১৭ ও ২০১৬ সালেও আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। এভাবে ২০১৫ সালের মার্চে ২ জন, এপ্রিলে ২ জন, মে মাসে ১ জন, জুনে ১৫ জন, জুল্ইায়ে ১৫৬ জন, আগস্টে ৭২৭ জন, সেপ্টেম্বরে ৯৬৫ জন, অক্টোবরে ৮৮০ জন, নবেম্বরে ২৬০ জন ও ডিসেম্বরে ৯০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। সূত্রটি আরো জানায়, রাজধানীতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৭ জন, মার্চে ৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ১২ জন, জুনে ৫০ জন, জুলাইয়ে ১৭২ জন, আগস্টে ৩৩৯ জন, সেপ্টেম্বরে ৩৮৫ জন এবং অক্টোবরে আক্রান্ত হয় ৫০১ জন। আর ২০১৯ সালে জুনে ১৮৬৩ জন, জুলাইয়ে ১৫ হাজার ৬৪৮ জন এবং আগস্টে ৫০ হাজার জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। আর সামনে পড়ে আছে পুরো সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস। ১৯ বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০০ সালে ৫৫৫১ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৯৩ জন, ২০০১ সালে ২৪৩২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৪৪ জন, ২০০২ সালে ৬২৩২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৫৮ জন, ২০০৩ সালে ৪৮৬ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১০ জন, ২০০৪ সালে ৩৪৩৪ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১৩ জন, ২০০৫ সালে আক্রান্ত ১০৪৮ জন ও মৃত্যু ৪ জন, ২০০৬ সালে আক্রান্ত ২২০০ জন ও মৃত্যু ঘটে ১১ জনের। এভাবে ২০০৭ সালে ৪৬৬ জন, ২০০৮ সালে ১১৫৩ জন, ২০০৯ সালে ৪৭৪ জন এবং ২০১০ সালে ৪০৯ আক্রান্ত হলেও ওই চারটি বছরে কেউ মারা যায়নি। আর ২০১১ সালে ১৩৫৯ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৬ জন, ২০১২ সালে ৬৭১ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১ জন, ২০১৩ সালে ১৭৫৯ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ২ জন, ২০১৪ সালে ৩৭৫ জন আক্রান্ত, ২০১৫ সালে ৩১৬২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৬ জন, ২০১৬ সালে ৬০৬০ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১৪ জন, ২০১৭ সালে আক্রান্ত ২৭৬৯ ও মৃত্যু ৮ জন।
×