ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যবস্থা গ্রহণে অর্থমন্ত্রীর নির্দেশ ;###;শীঘ্রই গঠন করা হবে কমিশন ;###;তৈরি করা হবে নতুন আইন ;###;আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হবে

দুর্বল ব্যাংক মার্জ ॥ ব্যাংকিং খাত ঝুঁকিমুক্ত করার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ১১:১০, ২৯ আগস্ট ২০১৯

দুর্বল ব্যাংক মার্জ ॥ ব্যাংকিং খাত ঝুঁকিমুক্ত করার উদ্যোগ

অপূর্ব কুমার ॥ এবার বাংলাদেশেও শুরু হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে একীভূত (মার্জার) করার প্রক্রিয়া। দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত করে ঝুঁকিমুক্ত করতে চায় সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেট অনুসারে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একীভূত করার বিধান নির্ধারণের জন্য শীঘ্রই একটি কমিশন গঠন করা হবে। উদ্যোগ নেয়া হয়েছে নতুন আইন প্রণয়নের। বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার পরই মন্ত্রী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার যুগ্ম-সচিব সিরাজুন নুর চৌধুরীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল মালয়েশিয়া সফর করেছেন। প্রতিনিধি দল মালয়েশিয়ার ১০টি ব্যাংক মার্জারের অভিজ্ঞতা নিয়ে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। একইসঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মার্জারের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগানো হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর স্ট্যাবিলিটি রিভিউ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করছেন। বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেক্টরে মার্জ করার জোর সুপারিশ রয়েছে তাদের। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোকে মার্জ করার বিকল্প নেই বলে তারা মনে করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থা ও সামগ্রিক পারফরম্যান্স মূল্যায়নে প্রতিবেদন তৈরির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোর তালিকাও করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশে সুনির্দিষ্টভাবে একীভূতকরণ (মার্জার) আইন না থাকায় ব্যাংক কোম্পানি আইনও সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে। তবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মার্জার উচ্চ আদালতের অনুমতি নিয়ে করা হয়েছে। সরকারী ব্যাংকগুলোকে কিভাবে মার্জ বা একীভূত করা হবে সেটি এখনও নির্দিষ্ট নয়। সম্প্রতি চলতি অর্থবছরের বাজেটে আর্থিক খাতের ব্যাপক সংস্কার ও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। সেখানে ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে কমিশন গঠন ও ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত করা, শেয়ারবাজারের জন্য প্রণোদনা, গ্রামাঞ্চলের হাটবাজারগুলোকে অর্থনীতির পাওয়ার হাউস হিসেবে গড়ে তোলা, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, ব্যাংকঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়নসহ আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। অর্থ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, পারফরম্যান্স বিচারে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বছর বছর লোকসান গুনলেও বেসরকারী ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা বাড়ছে। অন্যদিকে বেসরকারী অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। ফলে আমানতকারীরা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। ইতোমধ্যে পিপলস লিজিং নামের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নের (বিলুপ্ত) অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে এরপর আর কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এমন নাজুক অবস্থায় যেতে দিতে চায় না সরকার। এ জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থা মূল্যায়ন করে প্রয়োজনে একটির সঙ্গে আরেকটিকে একীভূত করা হবে। সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনেই ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের প্রস্তাব আসতে পারে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি পৃথক প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে। দেশে সুনির্দিষ্ট কোন আইনী কাঠামো না থাকায় দুর্বল ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বেচ্ছায় একীভূত হতে পারছে না। তাদের দুর্বলতার কারণে গ্রাহকরা আমানতের অর্থ সময়মতো ফেরত না পাওয়ায় পুরো আর্থিক খাতের দুর্নাম হচ্ছে। এই দুর্নাম এড়াতে বা আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা রক্ষায় দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত হতে পারে, সে জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের খসড়া প্রণয়ন করছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। আইনের সংশোধন এমনভাবে করা হবে, যাতে কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থা দুর্বলতার একটি স্তরে নেমে গেলে তারা নিজেরাই অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মার্জ হয়ে উদ্ধারের পথ খুঁজতে পারে। আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদের অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মার্জ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। একাধিক সভা ও সেমিনারে তিনি অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোকে মার্জ করার বিকল্প নেই বলেও উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে বিগত সরকারের শেষ সময়ে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছিলেন দুর্বল ব্যাংকগুলোর তালিকা তৈরি এবং কিভাবে মার্জ বাস্তবায়ন করা হবে সেই দিকনির্দেশনা ঠিক করতে। বিগত সরকারের আমলে তা বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে নতুন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতাসহ বিভিন্ন আলোচনা সভায়ও মার্জ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। জানা গেছে, বিগত সরকারের শেষ সময়ে রাষ্ট্রীয় খাতের বৃহত্তম ব্যাংক সোনালী ব্যাংক বাদে অন্য কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করা যেতে পারে বলে মত প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই সময় একীভূত করার জন্য প্রাথমিকভাবে চারটি ব্যাংকের কথা বলা হয়। এ ব্যাংকগুলো হলোÑ বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক লিমিটেড। বলা হয়, এই ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা মোটেও ভাল নয়। পৃথকভাবে পরিচালিত হওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর লোকসানের পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে বেসিক ব্যাংককে একীভূত করার সুপারিশ করা হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় খাতের কয়েকটি ব্যাংক একীভূত করার একটি সুপারিশ ২০১৭ সালের দিকে একটি কর্মশালা থেকে এসেছিল। বাংলাদেশে মার্জার বা একীভূত করার কোন নীতিমালা বা আইনী কাঠামো না থাকায় সেটি তখন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এটি করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। একীভূত করার একটি আইনী কাঠামো দাঁড় করানোর পর সরকারি ব্যাংক একীভূত করার কাজ করা হতে পারে। এ দিকে ৭২ শতাংশ ব্যাংক কর্মকর্তা মনে করেন বর্তমানে দেশে যে সংখ্যায় ব্যাংক রয়েছে তা কমাতে হবে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল ওই সময়। বিআইবিএমের অধ্যাপক ও পরিচালক মোঃ মহিউদ্দিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষণার জরিপে অংশ নেয়া ব্যাংকারদের মধ্যে ৭২ শতাংশ ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর পক্ষে মত দিলেও ১১ শতাংশ মনে করেন ব্যাংকের বর্তমান সংখ্যা ঠিক আছে। জরিপের এই প্রশ্নে মন্তব্য করতে রাজি হননি ১৭ শতাংশ ব্যাংকার। জরিপে ব্যাংক একীভূত করার বিষয়েও প্রশ্ন রাখা হয় ব্যাংকারদের কাছে। তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো-সুশাসনের অভাব, বোর্ডের গোপন সুবিধা, রাজনৈতিক দুর্বলতা, মানসিকতার পরিবর্তন, পরিচালকদের দুর্বলতা, নেতৃত্ব ও কৌশলগত চ্যালেঞ্জ। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মার্জার ॥ বাংলাদেশে মার্জারের কোন নীতিমালা বা আইন না থাকলেও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে মোট আটবার মার্জারের ঘটনা ঘটেছে। প্রথম মার্জারের ঘটনা ঘটে বেক্সিমকো গ্রুপে। দেশের ইতিহাসে ২০০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বেক্সিমকো গ্রুপের বেক্সিমকো টেক্সটাইল, বেক্সিমকো ডেনিম ও বেক্সিমকো নিটিং এই তিনটি কোম্পানি মিলে বেটেক্স নামে কোম্পানি গঠন করে। পরবর্তীতে একই গ্রুপের বেক্সিমকোর সঙ্গে শাইনপুকুর হোল্ডিং ও বেক্সিমকো ফিসারিজের মার্জার হয় ২০০৮ সালের ৩০ অক্টোবর। একই বছরে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে ত্রিপিটি ইন্ডাস্ট্রিজ নামের কোম্পানি মার্জার হয়। এছাড়া ২০১১ সালের ১ আগস্ট বেক্সিমকো লিমিটেডের সঙ্গে বেটেক্স নামে প্রতিষ্ঠানের মার্জার হয়ে বেক্সিমকো লিমিটেড নামের পরিচিতি পায়। একইবছরের ১ ফেব্রুয়ারি বিএসআরএম স্টিলের বিএসআরএস আয়রন এ্যান্ড স্টিল কোম্পানি লিমিটেডের মার্জার হয়। ২০১১ সালের ২৬ মে কেয়া কসমেটিক লিমিটেডের নামে কোম্পানি সঙ্গে কেয়া ডিটারজেন্টের মার্জ হয়। একই বছরে মুন্নু সিরামিকের সঙ্গে মুন্নু জুটেক্স লিমিটেড মার্জ হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালে সামিট পোর্ট এলায়েন্সের সঙ্গে ওসেন কন্টেনেয়ারের মার্জার হয়। বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মার্জারের ক্ষেত্রে স্টক একচেঞ্জের ওয়েবসাইটে মার্জারের তথ্য প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে কোম্পানিটির বিশেষ সাধারণ সভা আহ্বান করে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নেয়ার পর উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়। আদালতের সম্মতি নিয়েই কোম্পানিটির মার্জার সম্পন্ন হয়। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির সুবিধার কারণেই আদালতের অনুমোদন নিয়ে কোম্পানিগুলো সহজেই মার্জ করা হয়। কিন্তু সরকারী কোম্পানির মার্জ এর আগে না হওয়ায় কিভাবে দুর্বল ব্যাংকের মার্জ করা হয় তা নিশ্চিত নয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
×