ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদে রাজধানীতে শত কোটি টাকার মাদক বিক্রির টার্গেট

প্রকাশিত: ১০:২৩, ১১ আগস্ট ২০১৯

 ঈদে রাজধানীতে শত কোটি টাকার মাদক বিক্রির টার্গেট

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ঈদ সামনে রেখে রাজধানীতে শত কোটি টাকা মাদকের কেনাবেচার টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছে মাদক কারবারিরা। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারির পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত অভিযানের মধ্যেও থামছে না মাদক বেচাকেনা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সংঘবদ্ধ মাদক কারবারিরা নিত্যনতুন কৌশলে দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে মরণ নেশা ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক সংগ্রহ করে রাজধানীতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে মোবাইলের মাধ্যমে কিশোর অপরাধীরা রাজধানীর ৫০ থানা এলাকায় কম-বেশি স্পটে মাদকের কেনাবেচা করছে। আসন্ন কোরবানির ঈদ টার্গেট করে ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে ওরা। ইতোমধ্যেই ঈদ ছুটিতে মাদকের চাহিদা বাড়ায় বাজার চাঙ্গা রাখতে নানা কৌশলে বাড়ানো হচ্ছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের মজুদ। সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে কয়েক মাদক ব্যবসায়ী নিহতের পরই মাদক সরবরাহ ও বেচাকেনার কৌশল পাল্টেছে মাদক কারবারিরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, দেশ ও সমাজ থেকে মাদক নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা তৎপর রয়েছে। গত ১০ দিনে খোদ রাজধানীতেই অভিযান চালিয়ে বিপুল সংখ্যক মাদকদ্রব্যসহ প্রায় ৮শ’ মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঈদ এলেই দেশে মাদকসেবীদের কাছে এর চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। মাদকের বড় আস্তানা কাওরানবাজার রেললাইন বস্তি, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, মিরপুরের বিহারী ক্যাম্প ও কামরাঙ্গীরচর শতাধিক স্পটসহ রাজধানীর ৫০ থানা এলাকায় কম-বেশি স্পটে মাদকের কেনাবেচার হাট বসে। প্রতিদিন সেখানে ভিড় করছে মাদকসেবীরা। বিশেষ করে কিশোর অপরাধীরা মাদক কেনাবেচায় এগিয়ে রয়েছে। কিশোর গ্যাংগুলোর মধ্যে উত্তরা থেকে গ্রেফতার ‘ফার্স্ট হিটলার বস’ (এফএইচবি) নামের কিশোর গ্যাং ও মোহাম্মদপুর এলাকায় ‘লাড়া দে’ ও ‘লেভেল হাই’ কিশোর গ্যাং অন্যতম। এমনকি কামরাঙ্গীরচরে পূর্ব রসুলপুর ও পশ্চিম রসুলপুর ফাইভ স্টার, কাল গ্যাং , বাইটা গ্যাং রয়েছে। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন থানা এলাকায় এ রকম কিশোর গ্যাং কালচার কিশোর অপরাধীরা মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন ছোটখাটো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক কারবারিরা প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা থেকে দু’পারের টানা পার্টির মাধ্যমে ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য সংগ্রহ করে নানা কৌশলে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্পটে পৌঁছে দিচ্ছে। ঈদের আগেই ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের দামও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ইয়াবার ধরন ও আকার বুঝে বড় সাড়ে ৩শ’ টাকা, ছোট ২শ’ ৫০ টাকা, গাঁজার পুড়িয়া ছোট সর্বনিম্ন ১শ’ টাকা, শ্রেণীভেদে হেরোইনের পুরিয়া ২ থেকে ৫শ’ টাকা, ক্যান বিয়ার সাড়ে ৩শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা, ফেনসিডিল ৪শ’ থেকে ৬শ’ টাকা দরে পাইকারি হিসেবে কেনাবেচা হচ্ছে বলে জানান মাদকসেবী ও বিক্রেতারা। অধিকাংশ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঝামেলা এড়াতে শিশু-কিশোর ও নারীদের দিয়ে এসব মাদকদ্রব্য বহন ও বেচাকেনা করা হচ্ছে। এদিকে ডিএমপি জানায়, রাজধানীতে বিশেষভাবে গ্যাস সিলিন্ডারে লুক্কায়িত বিপুল পরিমাণ গাঁজাসহ দুই মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) একটি দল। গ্র্রেফতারকৃতরা হচ্ছে মোঃ মহিবুর রহমান (৩০) ও মোঃ কামরান মিয়া (২৬)। গত ৩১ জুলাই দুপুর সাড়ে ১২টায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন সাতরাস্তা মোড়ের ফ্লাইওভারের পূর্বপাশে আকিজ সিএনজি পাম্প এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় ৩টি গ্যাস সিলিন্ডারে বিশেষভাবে লুক্কায়িত ৬০ কেজি গাঁজা ও গাঁজা বহনের কাজে ব্যবহৃত ১টি পিকআপ গাড়ি উদ্ধার করা হয়। এ সংক্রান্তে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলা রুজু হয়েছে। ডিএমপির গণমাধ্যম শাখা জানায়, গত ৩১ জুলাই থেকে গতকাল শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানে থানা ও গোয়েন্দা পুলিশের পৃথক টিমের অভিযানে গত ৮ দিনে ৭৫৯ মাদক কারবারি গ্রেফতার হয়েছে। এ সময় তাদের হেফাজত থেকে ৪৫ হাজার ৬,৯৪ পিস ইয়াবা এবং বিপুল পরিমাণ গাঁজা-হেরোইনসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় এ পর্যন্ত ৫১১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আসামিদের আদালতে পাঠানো হলেও অপরাধের ধরন দেখে আদালত অনককেই জামিন দিচ্ছে আবার অনেককেই কারাগারে পাঠাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে এখনও প্রকাশ্যেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও নির্বিঘেœ মাদক ব্যবসা পরিচালনা করছেন কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী পাচু গ্রুপের পাচু, পাপিয়া, রাহি, জুম্মান, নুরা, তানভীর, পাপিয়া ও শামীমের স্ত্রী রানী। নারী মাদক ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রধান শাহিনা আক্তার সাথী। তার গ্রুপে রয়েছে মোহাম্মদ পুল কসাইয়ের স্ত্রী সিমা, সুলতানের স্ত্রী নার্গিস, আসগরের স্ত্রী সয়রা, আলী নেওয়াজের স্ত্রী গান্নী, মৃত মনির বেগের মেয়ে কালী রানী, জামিলের স্ত্রী বেচনী, মোস্তাকিমের স্ত্রী সকিনা, মৃত সাকিলের স্ত্রী কুলসুম ও মহিউদ্দিনের মেয়ে রেশমা। গাঁজা বিক্রির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে শামীমের স্ত্রী রানী ও মুন্না। কিশোর গ্রুপের মধ্যে মোহাম্মদ পুল কসাইয়ের ছেলে ফরিদ, আরিফ, আসিফ, আলী নেওয়াজের ছেলে সাগর ও সালমান, মৃত মনির বেগের ছেলে মুন্না। বিক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে পাখি, আসলাম, টেরু সেলিম বাবা, ছোট আরশাদ, মাসসা রাজু, সামসের, নাঈম, আরমান ও ছে মু-ী; ঢাকাইয়া নাদিম, নাসির, কালু, তেলী জাহিদ, সনু, টিপু তাহেরী; রাজিয়া গ্রুপের রাজিয়া ইভা, ফয়সল, কুরবান, ইমরান, মোন, ফরিদা, ছোট সাকিল, নবাব, ওয়াসিম, রানী, কুরবান, অপু, টিপু, মানিয়া, রানা, জাহিদ, জাবেদ ও বারেক। নিয়ন্ত্রক বা শেল্টার গ্রুপে আছে এস কে গোলাম রাব্বানী, সামদানী, নাসিম, মামুন, পটল মাহমুদ, শান্তি গ্রুপের শানু, আনোয়ার, রসুল, আজম, আ-ে আলমগীর, নাঈম, আফতাব, নওশাদ, ইমরান, চুয়া ওরফে চোরা সেলিম, হানিফসহ ৪ শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী। সূত্রগুলো জানায়, রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর পূর্ব রসুলপুর ১ নং গলির হিরু সর্দারের বাড়ির নিচে নাসির ইয়াবা, মরহুম মাসুদ উকিলের বাড়িতে (কেয়ারটেকার কনার মা) কিশোর অপরাধী রাজিবের কালা গ্যাং। গত ১ অক্টোবর রাতে স্থানীয়রা এসব স্পট থানা পুলিশকে জানায়। পরে থানার এসআই মান্না ১ নং গলির মরহুম মাসুদ উকিলের বাড়ি থেকে ১২ কিশোর মাদক কারবারি ও সেবীকে আটক করে। এর কয়েক ঘণ্টা পর এসব কিশোর মাদক কারবারি ছাড়া পেয়ে যায়। পুনরায় ওই স্পটে মাদক জমজমাট কারবার শুরু করে। সূত্র জানায় মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, রামপুরা, বাড্ডা, গুলশান, বারিধারা, উত্তরা, তুরাগ,শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, সবুজবাগ, কমলাপুর, কদমতলী, গাবতলী, কাওরানবাজার, তেজগাঁও, মহাখালীর সাততলা বস্তি, শাহবাগ, বুয়েট চত্বর, ঢাবির চারুকলা, টিএসসি চত্বর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ফুলবাড়িয়া, বঙ্গবাজার, চাঁনখারপুল, আনন্দবাজার, ফুলার রোড, ঢাকেশ্বরী মন্দির, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, মতিঝিল, শাহ আলী, শেরেবাংলা নগর, হাজারীবাগ, গে-ারিয়াসহ গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশন রোড, নিমতলী, এরশাদনগরসহ বিভিন্ন মাদক স্পটে এখনও ইয়াবার বড় বড় চালান প্রবেশ করছে। আইনশৃঙ্ঘলা বাহিনীর গ্রেফতার ও ঝামেলা এড়াতে কঠোর গোপনীয়তায় বিকাশ লেনদেনে মুঠোফোনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থানে কেবল পরিচিত লোকজনের কাছে ইয়াবা-গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। তবে এসব স্পটের মাদক বিক্রেতাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে।
×