ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণখেলাপীদের বিশেষ সুবিধা

তিন মাসের দু’মাস পার আদেশ নির্দেশে

প্রকাশিত: ১১:০৫, ৮ আগস্ট ২০১৯

তিন মাসের দু’মাস পার আদেশ নির্দেশে

রহিম শেখ ॥ ঋণখেলাপীদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পুনঃতফসিল নীতিমালার যে সার্কুলার জারি করেছিল, সেটা অবশেষে কার্যকর হচ্ছে। সার্কুলার অনুযায়ী, খেলাপীরা ঋণ পরিশোধে ১০ বছর সময় পাবেন। তবে নতুন করে কোন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন না কোন গ্রাহক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা নিতে হলে ১৬ আগস্টের মধ্যে খেলাপীদের আবেদন করতে হবে। কিন্তু উচ্চ আদালতের আদেশ ও নির্দেশে ৩ মাসের মধ্যে মাঝখানে চলে গেছে ২ মাস। সময় না বাড়ালে অর্ধেক ঋণখেলাপীও সময়মতো আবেদন করতে পারবেন না। এর মধ্যে আইনী জটিলতার কারণে অনেক গ্রাহক জানেনই না বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ সুবিধা কার্যকরের সময়সীমা শেষ হচ্ছে কবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পাওয়া গেলে সময় বাড়ানো হবে। অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, সময় বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। জানা গেছে, দেশে গ্যাস-বিদ্যুত পরিস্থিতির উন্নতি হলেও পর্যাপ্ত সরবরাহ না হওয়ায় অনেক শিল্পই রুগ্ণ হয়ে যাচ্ছে। কোন কোন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপী হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এ দায় উদ্যোক্তাকে বহন করতে হচ্ছে। প্রকারান্তরে, ইচ্ছেকৃত খেলাপীরা ব্যাংকের সঙ্গে যোগসাজশে নানা সুবিধা নিচ্ছে। এ অবস্থায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভাল-মন্দ গ্রাহক যাছাইয়ের কাজ শুরু করেছে। যারা যৌক্তিক কারণে খেলাপী হয়েছেন তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদানের অংশ হিসেবে গত ১৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট ও ৯ শতাংশ সরল সুদে ১০ বছরের জন্য ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিয়ে খেলাপী ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ নীতিমালা জারি করা হয়। এতে পুনঃতফসিলের সুবিধা নিতে ৯০ দিনের মধ্যে আবেদন করার সময় নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু ইতোমধ্যে ২ মাস পার হয়ে গেছে উচ্চ আদালত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক আদেশ নির্দেশের ফলে। গত ১৬ মে খেলাপীদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সার্কুলার জারি করে তার ওপর সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন স্থিতাবস্থা জারি করেন ২১ মে। সময়টা বেঁধে দেয়া হয় এক মাস। মাঝে দুই বার বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চ আদালতের আদেশ পরিপালনের জন্য নির্দেশনামূলক সার্কুলার জারি করে। এরপর ২৪ মে ওই প্রজ্ঞাপনের কার্যকারিতার ওপর স্থিতাবস্থার আদেশ আরও দুই মাসের জন্য বৃদ্ধি করে হাইকোর্ট ডিবিশন। এ আদেশ স্থগিত চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় আপীল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন জানায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২ জুলাই চেম্বার বিচারপতি মোঃ নুরুজ্জামান এ স্থগিতাদেশ জারি করেন। এ যাত্রায় স্থগিতাদেশ ৮ জুলাই পর্যন্ত ধার্য করা হয়। এরপর ৮ জুলাই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের এক নির্দেশনায় বলা হয়, যেসব ঋণখেলাপী মাত্র দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়েই ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধা নেবেন, তারা কোন ব্যাংক থেকে আর ঋণ নিতে পারবেন না। এবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রজ্ঞাপনের ওপর হাইকোর্ট ডিভিশন ২ মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। এরপর ১১ জুলাই নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়, বিআরপিডি সার্কুলার নং-৫, ১৬ মে ২০১৯ পরিপালন করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনার ফলে আগামী দুই মাস ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা নিতে পারবেন ঋণখেলাপীরা। তবে এই দুই মাস নতুন করে কোন ঋণ পাবেন না তারা। যে দুই মাসের কথা বলা হয়েছে তা ঠিক কবে শেষ হবে স্পষ্ট করে বলা হয়নি নতুন সার্কুলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা নিতে হলে আগামী ১৬ আগস্টের মধ্যে খেলাপীদের আবেদন করতে হবে। কিন্তু ক’দিন বাদেই ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে ৯ দিনের সরকারী ছুটি থাকবে। এর মধ্যে কোন আবেদনই পড়বে না। ভুক্তভোগী একাধিক ঋণখেলাপী গ্রাহক জনকণ্ঠকে বলেন, উচ্চ আদালতের আদেশ ও নির্দেশে তিন মাসের মধ্যে মাঝখানে চলে গেছে ২ মাস সময়। সময় না বাড়ালে সময়মতো আবেদন করতে পারবেন না গ্রাহকরা। অনেক গ্রাহকই জানালেন, আইনী জটিলতার কারণে তারা অনেকে জানেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ সুবিধা কার্যকরের সময়সীমা শেষ হচ্ছে কবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এস এম মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পাওয়া গেলে সময় বাড়ানো হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে যারা ঋণখেলাপী হয়েছেন তাদের বিষয়টি দীর্ঘদিন ছিল উপেক্ষিত। দেরি হলেও যৌক্তিক ঋণখেলাপীদের বিষয়টি আমরা অনুধাবন করেছি। তাদের জন্য প্রণোদনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যাতে করে ওসব প্রতিষ্ঠান চাঙ্গা হয়ে আবার উৎপাদনে যেতে পারে এবং অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে খেলাপী ঋণের পরিমাণ যেমন কমবে, তেমনি কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে। আইনী জটিলতায় সময়ক্ষেপণের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সময় বাড়ানোর বিষয়টি আমরা অব্যশই বিবেচনা করব। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ সুবিধা ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে আগামী ১০ বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাবেন খেলাপীরা। প্রথম এক বছর কোন টাকা পরিশোধ করতে হবে না। পুনঃতফসিলকৃত ঋণের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বা ব্যাংকের কস্ট ফান্ডের সঙ্গে ৩ শতাংশ যোগ করে। মূলত, খেলাপী ঋণের সুদ ব্যাংক আয় দেখাতে পারে না। পৃথক হিসাবে রাখতে হয়। সার্কুলারে এ বিষয়ে বলা হয়, পৃথক হিসাবে রাখা সব সুদ মাফ করে দেয়া হবে। এ সুবিধা নেয়ার পর নিয়মিত অর্থ পরিশোধ না করলেও তাদের খেলাপী করা যাবে না। সার্কুলারের তথ্য অনুযায়ী, ৯টি মাসিক কিস্তির ৩টি এবং ত্রৈমাসিক ৩ কিস্তির একটি পরিশোধ না করলেও গ্রাহককে খেলাপী করা যাবে না। তবে ৯টি মাসিক কিস্তির মধ্যে ৬টি ও ত্রৈমাসিক কিস্তির ২টি পরিশোধ না করলে পুনঃতফসিল সুবিধা বাতিল করা হবে। সার্কুলারের নির্দেশনা অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে যারা ঋণখেলাপী তাদের এককালীন এক্সিট সুবিধা দেয়া হবে। এক্ষেত্রে তাদের খেলাপী ঋণের হিসাব হবে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের এককালীন হিসাবায়ন ভিত্তিতে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের পর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যত খেলাপী ঋণ আছে তার হিসাব করা হবে। কোন ঋণখেলাপী যদি মনে করেন, এককালীন ঋণ পরিশোধ করে খেলাপীর তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবেন, তাহলে সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে সার্কুলারে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, এককালীন এক্সিট সুবিধা ও পুনঃতফসিল সুবিধা কার্যকরের ৯০ দিনের মধ্যে ব্যাংক ও গ্রাহকের মামলা স্থগিত করতে হবে। পরবর্তী সময়ে গ্রাহক কোন শর্ত ভঙ্গ করলে সুবিধা বাতিল করে মামলা পুনরায় চালু হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে ৩১ ডিসেম্বর সময়ে মন্দ ঋণগ্রহীতার অনুকূলে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে পুনঃতফসিল বা এক্সিট সুবিধা দেয়া যাবে। এক্ষেত্রে খেলাপী ঋণ এককালীন এক্সিট করতে হলে এই সার্কুলারের আওতায় ঋণগ্রহীতার আবেদন পাওয়ার তারিখ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেবে। তবে যেসব ক্ষেত্রে বিশেষ নিরীক্ষার প্রয়োজন হবে, সেসব ক্ষেত্রে নিরীক্ষা প্রতিবেদন পাওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সুবিধা পাবে যেসব খাত ॥ ট্রেডিং খাত (গম, খাদ্যদ্রব্য, ভোজ্যতেল ও রিফাইনারি), জাহাজ শিল্প (শিপ ব্রেকিং ও শিপ বিল্ডিং), লৌহ ও ইস্পাত শিল্প। অন্যান্য খাতের ব্যাংক কর্তৃক বিশেষ নিরীক্ষার মাধ্যমে চিহ্নিত প্রকৃত ব্যবসায়ী, যাদের ঋণ নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে মন্দমান শ্রেণিকৃত হয়েছে। এছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংকের অকৃষি খাতের আমদানি-রফতানিতে সম্পৃক্ত রয়েছে শিল্পঋণও।
×