ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিতে নতুন স্বপ্ন, দ্বিগুণ ফলনের আশা

প্রকাশিত: ১১:১০, ৪ আগস্ট ২০১৯

কৃষিতে নতুন স্বপ্ন, দ্বিগুণ ফলনের আশা

মামুন-অর-রশিদ ॥ মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, টেকসই কৃষি ব্যবস্থা ও ফসল উৎপাদনে এখন নতুন দিগন্ত উন্মোচনের পথ দেখাচ্ছে বায়োচার। জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্রমবর্ধমান কৃষি সম্প্রসারণে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তায় বায়োচার প্রযুক্তির ব্যবহারে নতুন আশায় স্বপ্ন বুনছেন কৃষকরাও। গবেষকরা বলছেন, বায়োচার ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি, পানির ধারণ-ক্ষমতা ও সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। বায়োচার মাটিতে গাছের খাদ্য উপাদানগুলোকে ধরে রাখে, মাটিতে লবণাক্ততা ও খরার প্রভাব এবং মাটির অম্লত্ব¡ দূর করে। মাটিকে সংশোধন করে বায়োচার মাটিতে অবস্থানকারী ছোট-ছোট অণুজীবকেও সক্রিয় করে তোলে। কৃষিতে এটি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বলেও মত দিয়েছেন গবেষকরা। সম্প্রতি রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে ‘টেকসই খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষিতে বায়োচার প্রযুক্তির ব্যবহার ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা আইসিসিও এবং কার্ক-ইন একটাই’র আর্থিক সহায়তায় সিসিডিবির বায়োচার প্রকল্পের উদ্যোগে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, বংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ মাসুদুজ্জামান মাসুদ। প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, দেশের খাদ্য নিারপত্তায় উর্বর মাটির গুরুত্ব অপরিসীম। খাদ্য উৎপাদনকারী প্রায় প্রতিটি উদ্ভিদই মাটিতে জন্মে থাকে। উর্বর মাটির ফসল উৎপাদন ক্ষমতা বেশি থাকে যা মানুষ ও পশুপাখির খাদ্যের জোগান দিতে থাকে। সেমিনারে বলা হয়, সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে কৃষি বিজ্ঞানেরও ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছে। বায়োচার তার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। ক্ষুদ্র অংশ হওয়া সত্ত্বেও বায়োচার কৃষিজ পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সমান ভূমিকা পালন করছে। বায়োচার ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি, পানির ধারণ-ক্ষমতা ও সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। পরিবেশবান্ধব এই বায়োচার পদ্ধতি ব্যবহারে জমির ফলনও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। বায়োচার ব্যবহারে রাসায়নিক সার ও পানি সেচ কম দিতে হয়, ফলে কৃষকের খরচ কমে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য মাটিতে বায়োচার ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও আবাদি জমিতে পরিবেশবান্ধব বায়োচার পদ্ধতি ব্যবহার করে ধানের চারা রোপণ করা হচ্ছে। বায়োচার আলু, সবজি চাষেও ব্যবহার করা হচ্ছে এ অঞ্চলে। এর ফলে ভাল ফল পাচ্ছেন কৃষকরা। সিসিডিবির চেয়ারম্যান ড. হেরোল্ড সওগত বাড়ৈ’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক দেব দুলাল ঢালী। বিশেষ অতিথি ছিলেন রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামছুল হক, রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মনজুরুল হক, অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (উদ্যান) আব্দুল ওয়াদুদ, অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য সংরক্ষণ) ড. বিমল কুমার প্রামাণিক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের প্রফেসর ড. তৌফিক ইকবাল। বায়োচার নিয়ে ড. তৌফিক ইকবালও তার গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন। সেমিনারে রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও কৃষকরাও অংশ নেন। সেমিনারে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন সিসিডিবির সমন্বয়কারী মি. সমীরন বিশ্বাস। সেমিনারে উপস্থাপিত গবেষণায় দেখা যায়, যে সব মাটির জৈব পদার্থ ১ শতাংশের কম আছে সে সব মাটিতে অনুমোদিত রাসায়নিক সার প্রয়োগের পরেও ভাল ফলন পাওয়া যায় না। ফলশ্রুতিতে কৃষকরা বেশি ফলনের আশায় অতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেন। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, ফসলের সংরক্ষণ ক্ষমতা কমে, পরিবেশের ক্ষতি সাধন হয় এবং মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়। এ অবস্থায় বায়োচার (কৃষিবান্ধব চুলা থেকে উৎপাদিত) মাটি থেকে হারিয়ে যাওয়া জৈব শক্তি পুনরায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম। বায়োচার হচ্ছে এক ধরনের কয়লা। এটি মাটিতে ব্যবহার করলে মাটির জৈব উপাদান বৃদ্ধি পায়, লবণাক্ততা হ্রাস করে, পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে, সারের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়, পুষ্টি উপাদান ধরে রাখে, মাটিতে অবস্থানকারী অনুজীবের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বায়োচার একটি উত্তম অনুষঙ্গ। সেমিনারে জানানো হয়, বায়োচার এক ধরনের চারকোল বা কয়লা যা পাইরোলাইসিস (সীমিত অক্সিজেনের উপস্থিতিতে বা অক্সিজেনবিহীন তাপের) পদ্ধতির সাহায্যে বিভিন্ন জৈব পদার্থ, যেমন- ধানের তুষ, কাঠের গুঁড়া, কাঠ, মুরগির বিষ্ঠা এমনকি নালা-নর্দমার বর্জ্য পদার্থ, আবর্জনা থেকে তৈরি করা হয়। বায়োচার পানি বিশুদ্ধকরণ এবং মাটির লবণাক্ততা কমাতে ভূমিকা রাখে। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় বায়োচার একটি অদ্বিতীয় অনুষঙ্গ। সেমিনারে জানানো হয়, বায়োচার জমিতে একবার ব্যবহার করলেই দীর্ঘ সময় আর ব্যবহার করতে হয় না। বায়োচার কার্বনকে বছরের পর বছর মাটিতে ধরে রাখে, ফলে মাটির স্বাস্থ্যের স্থায়ী উন্নয়ন ঘটে। বায়োচার মাটিতে প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। আর শতবর্ষ ধরে এটি মাটির উর্বর শক্তি বৃদ্ধি করে নানাভাবে। সেমিনারে অংশ নেয়া বায়োচার ব্যবহারকারী কৃষকরাও এর কার্যকারিতা ও সফলতা তুলে ধরেন।
×