ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গার হাতে ডিজিটাল পাসপোর্ট!

প্রকাশিত: ১১:০২, ৪ আগস্ট ২০১৯

রোহিঙ্গার হাতে ডিজিটাল পাসপোর্ট!

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে পাঁচ সহস্রাধিক রোহিঙ্গার হাতে ডিজিটাল পাসপোর্ট রয়েছে। তারা নিজেদের বাংলাদেশী দাবি করে পাসপোর্ট হাতিয়ে নিয়েছে। যেহেতু তাদের কাছে পুরনো পাসপোর্ট, জাতীয় সনদ, ভোটার তালিকায় নাম, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট, নিজ নামে ভিটাবাড়ির দলিল ও রাজনৈতিক নেতার সুপারিশ থাকায় পাসপোর্ট কর্মকর্তার কাছ থেকে ওই রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট পেয়েছে। মিয়ানমারের নাগরিক তারা রোহিঙ্গা-অথচ বাংলাদেশী দাবি করে চট্টগ্রাম শহরে ও কক্সবাজারে দালান নির্মাণ শেষে বসবাস করছে ১০ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা। ইয়াবা, অস্ত্র ব্যবসা ও জঙ্গীপনায় জড়িত ওই রোহিঙ্গারা অবৈধ আয়ের কারণে স্থানীয়দের ওপর দাপট দেখিয়ে থাকে। তারেক উল্লাহ নামে এমন এক ইয়াবা গডফাদার রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ইয়াবা মামলার পলাতক আসামি তারেকুল ইসলাম ওরফে ইয়াবা তারেককে গত শনিবার শহরের লিঙ্ক রোড থেকে কক্সবাজার থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ধৃত তারেক ইয়াবা কারবার ছাড়াও রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সঙ্গে জঙ্গীপনায়ও জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তাকে জামিনে মুক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা। অনুসন্ধানে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে শহরের পাহাড়তলি সাত্তার ঘোনা ও উখিয়া কোটবাজারে বসবাসকারী ইয়াবা গডফাদার তারেক সদর মডেল থানায় দায়েরকৃত একটি মাদক মামলায় গ্রেফতার এড়িয়ে দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকে। রোহিঙ্গা তারেক উল্লাহ নাম পাল্টে তারেকুল ইসলাম প্রকাশ তারেক হয়ে পাহাড়তলি ঘোনারপাড়ার (সাত্তার ঘোনা) বাসিন্দা বনে যায়। তার বাবা, ভাই ও বোনসহ পরিবারের সদস্যরা উখিয়া মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশ্রিত রোহিঙ্গা। ইয়াবা সিন্ডিকেটের বড় গডফাদার তারেক উল্লাহ ওরফে আল-ইয়াকিন তারেক ওরফে তারেকুল ইসলাম বাংলাদেশী সেজে ইয়াবার কারবার জমজমাটভাবে চালিয়ে আসছে। ইয়াবা মজুদের নিরাপদ স্থান হিসেবে পাহাড়তলি ঘোনারপাড়া সাত্তার ঘোনা ও উখিয়া কোটবাজার এলাকায় গড়েছে দুটি আস্তানা। পাকাবাড়ি নির্মাণ করে বিয়েও করেছে দুই রোহিঙ্গা নারীকে। সূত্র মতে, তার বিশাল ইয়াবা সিন্ডিকেট রয়েছে কক্সবাজার শহর, খুরুশকুল, কোটবাজার ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক। মিয়ানমারের বড়বড় কারবারিরা তার তিন ভাইয়ের জিম্মায় শহীদুল্লাহ, শফি উল্লাহ ও আজিম উল্লাহর মাধ্যমে ইয়াবা মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে আসে। সেখান থেকে তারেক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি অননুমোদিত এনজিও’র মালামাল সরবরাহের নামে ক্যাম্পে গিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করে এবং ইয়াবা চালান কোটবাজার নিয়ে আসে। সেখান থেকে সুবিধা মতো পৌঁছানো হয় গন্তব্যস্থানে। তারেক উল্লাহ। পিতা-নছি উল্লাহ, রোহিঙ্গা আরএসও নেতা ছিল। ওই নছি উল্লাহ প্রায় সময় টেকনাফে অবস্থান করে। তারেক মিয়ানমার থেকে কৌশলে কক্সবাজার এসে পাহাড়তলি সাত্তার ঘোনা ৭ নং ওয়ার্ডে জমি কিনে বাড়ি করে। এক রোহিঙ্গা নারীকে খুরুশকুল এলাকা থেকে বিয়ে করে। তার শ্বশুরও বার্মা থেকে পালিয়ে এসে খুরুশকুল অবস্থান নেয়। তার প্রথম স্ত্রীও রোহিঙ্গা। তারেক ওপার থেকে পালিয়ে এসে রামু চাকমারকুল মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছে। এরপর পাহাড়তলি ইসলামাবাদ মাদ্রাসায় কিছুদিন চাকরিও করেন তিনি। জানা গেছে, সদরের খুরুশকুল থেকে ১ম বিয়ের পর উখিয়া কোটবাজার বড়বিল ৭ নং ওয়ার্ড থেকে ২য় বিয়ে করে তারেক। বর্তমানে দুই স্ত্রীই দুই জায়গায় রয়েছে। তাদের নামে কক্সবাজার শহর, কোটবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট। রোহিঙ্গা জঙ্গী তারেক উল্লাহ ইয়াবা ব্যবসা সহজ করার জন্য দুটি বিয়ে ও দুটি স্থানে বাড়ি করে। এদেশে অবস্থান করে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা কারবার করে সম্পদ অর্জন করে। কোটবাজার বড়বিলে টিনশেড পাকা বাড়িতে তৈরি করেছিল জাল টাকার নোট। একটি বাহিনী অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করেছিল। কিন্তু মোটা অঙ্কের টাকায় সেই যাত্রায় বেঁচে যায় তারেক। এই ঘটনাটি এলাকার সবার মুখে মুখে। তারেকের রয়েছে শহরের সাত্তার ঘোনা, পাহাড়তলি, উখিয়ার কোটবাজার ও মধুরশিয়া কেন্দ্রিক রয়েছে বিশাল ইয়াবা ব্যবসায়ী নেটওয়ার্ক। স্থানীয় কিছু বখাটে যুবকদের তার সঙ্গে রাখত বডিগার্ড হিসেবে। এলাকার কিছু জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে রেখেছে। তাদেরও দেয় মাসিক ভাতা। ইয়াবা ব্যবসা নির্বিঘেœ করতে হারবাল কোম্পানির একটি কার্ড কিনে নিয়েছে। হারবাল ব্যবসার অন্তরালে চলে ইয়াবা ও অস্ত্রের কারবার। মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা জঙ্গীদের (আরসা) কাছে অস্ত্র পাঠাত ধৃত রোহিঙ্গা তারেক। তাকে সহযোগিতা করত শহরে বসবাসকারী মৌলবি শফিক, রোহিঙ্গা নেতা হাফেজ হাসিম, মৌলবি আয়াছ, মৌলবি আবদুর রহিম, নয়াপাড়া ক্যাম্পের মৌলবি ইয়াছিন। এ কাজে বিদেশ থেকে অর্থ জোগান দিতেন মৌলবি আবু সিদ্দিক আরমান। রোহিঙ্গা তারেক অবশ্য গত কয়েকবছর আগে আসলেও তার পুরো পরিবার সবাই চলে আসে ২০১৭ সালে আগস্ট মাসে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের পর অন্য রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তার বাবা আরএসও জঙ্গী নছি উল্লাহ, তার ভাই আল ইয়াকিন সদস্য যথাক্রমে আজিম উল্লাহ, এনায়েত উল্লাহ ও শফি উল্লাহ সপরিবারে এসে উখিয়া মধুরছড়া (মধুরছড়া লোহার ব্রিজের পাশে) ১৪ নং ব্লকের রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পে অবস্থান করছে। সূত্র মতে, তার ফুফুরা ও তার পিতা নছি উল্লাহ টেকনাফ সদর ১ নং ওয়ার্ডের মিঠাপানিরছড়া এলাকায় বসতি গেড়েছিল। পুরাতন রোহিঙ্গাদের এদেশীয় আইডি কার্ড দিয়ে তার ফুফু পরিচয় দিয়ে ২ লাখ টাকার বিনিময়ে কাউন্সিলর আশরাফুল হুদা সিদ্দিকী জামসেদ ভোটার তালিকাভুক্ত করেন বলে তারেক উল্লাহর দাবি। সেই তারেক উল্লাহ এখন স্মার্ট কার্ডও পেয়েছে। ভারি অস্ত্রধারী ডাকাত আবদুল হাকিমের ছোটভাই-এর স্ত্রী হচ্ছে তারেক উল্লাহর বোন। পাহাড়তলির মিরু অথবা নিরু মাঝি ও বৌ বাজারের জাফর সওদাগরও তার সহযোগী। তার আরেক সহযোগী কোটবাজারের মনির মেম্বার । এই মনিরও ইয়াবাসহ চট্টগ্রামে গ্রেফতার হয়েছিল। কোটবাজার এলাকার বিভিন্ন দোকানে ও কয়েকটি ইটেরভাঁটিতে ইয়াবা বিক্রির অর্থ লগ্নি করেছে তারেক। সারা বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারে ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তার রয়েছে ইয়াবা বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে আসলেও দুরন্ধর ইয়াবা কারবারি বার বার গ্রেফতার এড়িয়ে গিয়েছিল। সদর মডেল থানায় দায়েরকৃত একটি মাদক মামলায় গ্রেফতার এড়িয়ে এই তারেক দীর্ঘদিন পলাতক ছিল। ওই মাদক মামলাটি তদন্ত করছেন এসআই জহিরুল। কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি (তদন্ত) খাইরুজ্জামান বলেন, তারেককে গ্রেফতারি পরোয়ানামূলে আদালতে সোপর্দ করলে বিচারকের আদেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সচেতন মহল বলেন, রোহিঙ্গারা ডিজিটাল পাসপোর্ট কিভাবে পাচ্ছে, এ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে প্রশাসনকে। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নিতে হবে পরিকল্পনা। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী এসব রোহিঙ্গা এখানে বসতি স্থাপন করে পরিবার-পরিজন রেখে জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছে। বিদেশ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠিয়ে এরা এখন বাংলাদেশী সেজে ইচ্ছা মতো জমিজমা কিনছে।
×