ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইলে বাঁধ, দখল ও দূষণে নদী হয়েছে ভাগাড়

লৌহজং নদী মৃতপ্রায়

প্রকাশিত: ০৮:৫২, ১০ জুলাই ২০১৯

লৌহজং নদী মৃতপ্রায়

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল, ৯ জুলাই ॥ শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে লৌহজং নদী। উৎসমুখে বাঁধ, দখল ও দূষণে এক সময়ের খর¯্রােতা লৌহজং আজ প্রায় মৃত। নদী পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিগত ২০১৬ সালে শহর এলাকায় নদীর পাশে অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও খননের কিছুটা কাজ করা হলেও আবার বন্ধ হয়ে গেছে। তবে নদীটি রক্ষা করে তার প্রবাহমানতা ফিরিয়ে আনার দাবি করেছেন এলাকাবাসী। জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, অতিদ্রুত লৌহজং রক্ষার কাজ শুরু হবে। এক সময় গুরুত্বপূর্ণ এই লৌহজং এর ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে গড়ে উঠে টাঙ্গাইলের যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য। জানা যায়, লৌহজং বাংলাদেশের উত্তর কেন্দ্রীয় অঞ্চলের টাঙ্গাইল ও গাজীপুর এলাকার প্রধান নদী। যার দৈর্ঘ্য ৭৬ কিলোমিটার, প্রস্থ ৪০ মিটার ও প্রকৃতি সর্পিলাকার। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রদত্ত নদী পরিচিতি নং ৫৪। পূর্বদিক থেকে প্রবাহিত হয়ে সরাসরি দক্ষিণে বাঁক নেয়া নদী অববাহিকার আয়তন ১০৪ বর্গ কিলোমিটার। যা শহরের দিঘুলীয়া, কলেজপাড়া, কাগমারা, আকুর টাকুর পাড়া, বেড়াডোমা, কাগমারী ও কাজীপুরসহ টাঙ্গাইলের প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার এলাকা দিয়ে বয়ে গেছে। টাঙ্গাইলের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্রমবিকাশ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে লৌহজং নদীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জনপদ সৃষ্টি ও সম্প্রসারণেও রয়েছে লৌহজং নদীর অবদান। এক সময়ের প্রমত্তা লৌহজং নদী ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাতায়াতের প্রধান পথ। নদীটি সংযোগ স্থাপন করেছিল ঢাকার সঙ্গে কলকাতার। যমুনা ও ধলেশ্বরী নদী হয়ে লৌহজং দিয়ে ব্যবসায়ীরা কলকাতা থেকে টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ যেতেন। জনশ্রুতি রয়েছে এই পথে লঞ্চ, স্টিমারসহ বড় বড় নৌকা অহরহ যাতায়াত করত। বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক রাশেদ রহমান বলেন, আমরা ছোটবেলায় দেখেছি লৌহজং নদী দিয়ে অনেক বড় বড় মালবাহী ও যাত্রীবাহী নৌকা চলাচল করত। নৌকাগুলো বর্তমানে শহরের আমঘাট রোডে ভিড়ান হত। নৌকায় থাকা মালামাল টাঙ্গাইলসহ বিভিন্নস্থানে কেনাবেঁচা হত। বিশেষ করে ধান, পাট, গুড় উল্লেখযোগ্য। নৌকায় যাতায়াতকারী ব্যবসায়ীরা ভাসমান ঘর বানিয়ে কিংবা নৌকার ভেতরে রাত যাপন করতেন। শহরের বুক চিরে লৌহজং প্রবাহিত হওয়ায় নদী কেন্দ্রিক টাঙ্গাইলের যাতায়াত ছিল খুব সহজতর। শহরের জনপদ সৃষ্টিতেও রয়েছে লৌহজং নদীর ভূমিকা। সরেজমিনে নদীর গতিপথের কয়েকটি স্থানে দেখা যায়, নদীর দুপাশে অবৈধ দখল করে গড়ে উঠেছে পাকা, আধা পাকা অনেক স্থাপনা। ফলে বিভিন্নস্থানে নদী পরিণত হয়েছে সরু খালে। আর খনন না করায় নদীর বুক ভরাট হয়ে গেছে। শিল্প বর্জ্য ও আবাসিক দূষণে নদী পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে। এছাড়া ধলেশ^রীর উৎসমুখে বাঁধ ও যুগনী মেইন রেগুলেটরের কারণে নদীতে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হওয়ায় বর্ষা মৌসুম ছাড়া লৌহজং মৃতই থাকে। লৌহজংয়ের মির্জাপুর এলাকায় নদীতে বাঁধ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ইটভাঁটির ট্রাক চলাচলের রাস্তা। টাঙ্গাইলের পশ্চিম আকুর টাকুর পাড়ার রাজু আহম্মেদ ভুট্ট বলেন, নদীর পাশে অনেক ক্ষমতাধর মানুষ অবৈধভাবে বাড়িঘর করেছে। তাই উচ্ছেদ হয় না। নদী আর নদী নাই। আমরা চাই কাগজপত্র দেখে নদীর জায়গা বেদখলমুক্ত হোক। আব্দুল কাদের (৬৮) নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমরা দেখছি এই নদী দিয়ে অনেক বড় বড় নৌকা সিরাজগঞ্জ থেকে টাঙ্গাইল হয়ে মির্জাপুর ও ঢাকার দিকে যেত। মালবাহী ও যাত্রীবাহী নৌকাগুলো শহরের বর্তমান আমঘাট রোডে ভিড়ানো হত। একসময় এই নদী পথেই নির্ভরশীল ছিল বেশির ভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র। নদীতে নিয়মিত ময়লা-আবর্জনা ও তরল বর্জ্য ফেলার কারণে নদীতে মাছ থাকে না। দুর্গন্ধে আমরা আশেপাশে থাকতে পারি না। শুষ্ক মৌসুমে পানিতে নামলে শরীরে কালা দাগ ও ঘা হয়ে যায়। নদী এলাকার আরও কয়েকজন ব্যক্তি জানান, নদীর জায়গা দখল করে বিক্রি ও বাড়িঘর বানিয়ে ভাড়া দিয়েছে অনেকে। বিগত ২০১৬ সালে (১১ নবেম্বর) প্রাক্তন ডিসি (বর্তমানে যুগ্ম-সচিব) মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে শহর এলাকায় লৌহজংয়ের অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান এবং খননের কাজ শুরু হয়। সাধারণ মানুষ স্বাগত জানিয়েছিল এই উদ্যোগকে। তখন নদীর গতিপথ উদ্ধারে কিছুটা অগ্রগতি হলেও বর্তমানে একেবারে বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার সিনিয়র গবেষক ও টাঙ্গাইল জেলা নদী রক্ষা কমিটির সদস্য সোমনাথ লাহিড়ী বলেন, লৌহজং আজ প্রায় মৃত। অবৈধ দখলত চলছেই। আর আলাউদ্দিন টেক্সটাইল মিল ও ইউনিভার্সাল ড্রাইংয়ের তরল বর্জ্য নদীতে ফেলার জন্য পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সদর উপজেলার তারটিয়া, বীরপুশিয়া, ভাতকুড়া, করটিয়ার কিছু অংশ ও বিশেষ করে আকন্দপাড়ার ফসলি জমিতে স্বাভাবিক আবাদ না হওয়া তার দৃশ্যমান উদাহরণ। আমরা চাই নদী রক্ষায় হাইকোর্ট কর্তৃক জনস্বার্থে নদী কমিশনকে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা সব নদীর ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন করা হোক। সিএস দাগ ধরে নদীর জায়গা দখলমুক্ত, উৎসমুখে বাঁধ অপসারণ ও খনন করা হলেও লৌহজং তার যৌবন ফিরে পাবে। লৌহজং নদী রক্ষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী আশিকুর রহমান ইকবাল বলেন, কাগমারী লাল ব্রিজ থেকে এসপি পার্ক পর্যন্ত শহরের লৌহজং বয়ে গেছে। টাঙ্গাইলের সাবেক ডিসি মাহবুব হোসেন বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে সঙ্গে নিয়ে যেটুকু দখল উচ্ছেদ করেছিলেন সেটুকুও আজ বেদখল হয়ে যাচ্ছে। নদীর বর্তমান অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। আমরা চাই নদী দখলমুক্ত করে ফুটপাথ নির্মাণ, খনন করে পানি প্রবাহতা স্বাভাবিক ও দূষণমুক্ত করে মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলা হোক। পরিবেশ অধিদফতর টাঙ্গাইলের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম লৌহজং-এ শিল্প দূষণ অস্বীকার করে বলেন, নদীতে আবাসিক দূষণ রয়েছে। আলাউদ্দিন টেক্সটাইল মিলে বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করা হয়েছে। দূষণ রোধে আমাদের মনিটরিং চলমান আছে। তবে, স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছে ইটিপি ব্যবহার না করে তরল বর্জ্য সরাসরি এখনও নদীতে সরবারহ করা হয়। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, লৌহজংয়ের অবস্থা বর্তমানে খুবই শোচনীয়। নদী দখল ও দূষণের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের নদী রক্ষায় ইতোমধ্যে আমাদের একটি মিটিং হয়েছে। লৌহজং রক্ষায় সার্ভের কাজ চলছে। প্রসাশনের সঙ্গে সমন্বয় করে পানি উন্নয়ন বোর্ড যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম বলেন, লৌহজং টাঙ্গাইলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরনো নদী। শহর গড়ে উঠার পেছনে এই নদীর অনেক অবদান রয়েছে। কিন্তু দখল-দূষণসহ বিভিন্ন কারণে নদীটির অবস্থা খুবই শোচনীয়। লৌহজং রক্ষায় অবৈধ দখল উচ্ছেদ, খনন ও সৌন্দর্যবর্ধনসহ সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ শুরু হবে।
×