ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মেঘনায় জেগে উঠছে নতুন চর, আরেকটি জেলার সমান

প্রকাশিত: ১০:২৬, ১৫ জুন ২০১৯

 মেঘনায় জেগে উঠছে নতুন চর, আরেকটি জেলার সমান

গিয়াস উদ্দিন ফরহাদ, নোয়াখালী ॥ দক্ষিণাঞ্চলীয় মেঘনায় নতুন নতুন চর জাগছে। ইতোমধ্যে জেগে ওঠা অন্তত এক হাজার বর্গকিলোমিটার চরাঞ্চলে মানববসতি গড়ে উঠেছে। আগামী পাঁচ বছরে আরও বিশাল চর জেগে ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে যে হারে চর জাগছে তাতে এই চরের আয়তন হবে আরেকটি জেলার সমান। এতে একদিকে দেশের হাজার হাজার নদীভাঙ্গা অসহায় ভূমিহীন মানুষ চর আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। অন্যদিকে এসব চরে পরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ, বৃক্ষরোপণ ও মৎস্য প্রকল্পসহ বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়া হলে জাতীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতির দ্বার উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নোয়াখালী সদরে মূল ভূখ- থেকে সুবর্ণচর উপজেলার দক্ষিণে হাতিয়া উপজেলার এ অংশে বিশাল বয়ারচর, পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিণে মাইলের পর মাইল ধু ধু চর আর চর। নলের চরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সন্দীপের কাছাকাছি সাগরের বুক চিরে আরও অনেক চর জাগছে। এছাড়া চর মজিদ স্টিমার ঘাট থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরত্বে হাতিয়া দ্বীপের মধ্যবর্তী নদী পথে অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে, যা অচিরে মূল চরে রূপান্তরিত হবে। নলের চর থেকে চেয়ারম্যান ঘাট পর্যন্ত প্রায় আট শ’ একর মেঘনায় নতুন চর জাগছে এবং এতে মানব বসতি ও বৃক্ষরোপণ শুরু হয়ে গেছে। জলদস্যু ও বনদ্যুরা প্রতি একর ভূমি ৩০-৪০ হাজার টাকা করে নিয়ে ভূমিহীনদের কাছে দখল বুঝিয়ে দিচ্ছে। হাতিয়া দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে জেগে ওঠা আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের মৌলভীর চরে চাষাবাদ চলছে। এছাড়া আশপাশে অনেক নতুন চর জাগছে। এগুলোতে চাষাবাদ ও মানব বসতি চলছে পুরোদমে। হাতিয়ার তমরউদ্দিনের পশ্চিমে যে হারে চর জাগছে, তাতে করে আগামী দু-এক বছরের মধ্যে ভোলার মনপুরার সঙ্গে হাতিয়া দ্বীপের মূল ভূখন্ড মিশে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। হাতিয়া দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে রহমত বাজারের পূর্বে ১৪-১৫ বর্গকিলোমিটার ডুবোচর আগামী কয়েক বছরের মধ্যে গোচারণ ভূমিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ দিকে হাতিয়ার রহমত বাজারের বেড়িবাঁধ থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে জাহাজমারা বাজার পর্যন্ত বেড়িবাঁধের বাইরে আবার বিশাল চর জেগে উঠেছে। তার মধ্যে অন্তত ১৫ কিলোমিটার বনবাগান, ২০ বর্গকিলোমিটার মানব বসতি, ৩০ কিলোমিটার আবাদি জমি এবং ২৫ কিলোমিটার গোচারণ ভূমি রয়েছে। এছাড়া দক্ষিণে প্রায় প্রতি বছর ২০-২৫ কিলোমিটার আয়তনের চর জাগছে। এদিকে জাহাজমারা নিঝুম দ্বীপের পাশে অনেক চর জাগছে। এসব চরে মানব বসতি শুরু না হলেও কবিরার চরসহ এসব চরে বনবিভাগ বৃক্ষরোপণ করছে। অন্য দিকে নিঝুম দ্বীপ ছিল সাগরের মাঝখানে। কিন্তু নিঝুম দ্বীপের ১৫-২০ কিলোমিটার দক্ষিণে চর দিয়ে দূরে চলে যায় বঙ্গোপসাগর। শুধু তাই নয়, আরও দক্ষিণ গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিকারী জেলেদের থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানান, মূল ভূখ- থেকে দক্ষিণে চার-পাঁচ ঘণ্টা ট্রলারে যাওয়ার পর নদীর গভীরতা দুই থেকে আড়াই মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ হাতিয়া জাহাজমারা থেকে দক্ষিণে আরও ৪০-৫০ মাইল নদী পথের গভীরতা দু-তিন মিটার। নিঝুম দ্বীপের পশ্চিমে চর কমলা, বদনার চর, চর কালাম, দমার চরে মানব বসতি স্থাপন শুরু হয়নি জলদস্যু ও ভূমি দস্যুদের হাঙ্গামার ভয়ে। কিন্তু বনায়নের কাজ চলছে পুরো দমে। হাতিয়ার বাংলাবাজারের পূর্ব দিকে বিশাল চর জাগছে। জেলার মূল ভূখন্ড চেয়ারম্যান ঘাট থেকে হাতিয়ার নলচিরা ঘাট রুটে কিছু ডুবোচর দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি বিদ্যমান নৌপথে অসংখ্য ডুবোচর দেখা দেয়ায় সে রুটে সি-ট্রাক চলাচল করতে পারছে না। এতে ঘুরে সি-ট্রাক যেতে হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে ১ ঘণ্টা সময় বেশি লাগে। এ ছাড়া আগামী দু-এক বছরের মধ্যে সন্দীপের চর ইসলামের সঙ্গে মিশে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া অনেক চরে মানব বসতির পাশাপাশি জমিন আবাদ হচ্ছে এবং অনেক চর বৃক্ষরোপণ কর্মসূচীর আওতায় আনা হচ্ছে। হাতিয়ায় যে হারে চর জাগছে এতে করে আগামী চার-পাঁচ বছরে এখানকার ভূমির পরিমাণ হবে আরেকটি জেলার সমান। এছাড়া আরও অনেক ডুবোচর এখন ভেসে উঠছে। হাতিয়া নিঝুমদ্বীপ ও আশপাশে যে হারে চর জাগছে, তাতে এসব জায়গায় পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন এলাকার লাখ লাখ নদী ভাঙ্গা অসহায় মানুষকে পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে। হাতিয়া চরাঞ্চলের অধিবাসীরা জানান, জেগে ওঠা চরগুলোতে পলি মাটির কারণে ফসলে সার ও কীটনাশকের তেমন প্রয়োজন হয় না। শুধু তাই নয়, ফসলের তেমন পরিচর্চাও লাগে না। ভূমিহীনরা আরও জানান, তারা জল ও বনদস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তাদের কষ্টে অর্জিত ফসলের ওপর দস্যুবাহিনীকে চাঁদা দিতে হয়। হাতিয়া এলাকায় যে হারে চর জাগছে এবং মেঘনা নদী ও সাগরের পলি মাটির যে উর্বরতা তাতে এখানে ভেড়িবাঁধ নির্মাণ করে পরিকল্পিতভাবে কৃষি প্রকল্প নেয়া হলে এখানে যে ফসল হবে তা পুরো জেলায় খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরে আলমকে জেগে ওঠা চর আবাদে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা আছে কি না জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, চরগুলোর জরিপ চলছে। নিঝুম দ্বীপের দমার চরের জরিপ শেষ হয়েছে। সরকারীভাবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী চলছে। চরগুলো ভূমিহীনদের লিজ দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরে আলম চর জেগে ওঠার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, নতুন চরগুলোতে জরিপের কাজ চলছে। পাশাপাশি বন বিভাগ বনায়নের কাজ করছে। জরিপের কাজ সমাপ্ত হলে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে এটা কি বনবিভাগের অধীনে থাকবে নাকি ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে যাবে।
×