ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৫৭ হাজার পরীক্ষার্থী আবেদন করেছিল

খাতা পুনর্নিরীক্ষণে মিলল অসংখ্য ভুল

প্রকাশিত: ১০:০০, ২ জুন ২০১৯

খাতা পুনর্নিরীক্ষণে মিলল অসংখ্য ভুল

বিভাষ বাড়ৈ ॥ এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার খাতা পুনর্নিরীক্ষণে এবারও সকল বোর্ডেই অসংখ্য ভুল ধরা পড়েছে। পুনর্নিরীক্ষণে পরিবর্তন হয়েছে বহু পরীক্ষার্থীর ফল। ১০ শিক্ষা বোর্ডে চার হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। এরমধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে প্রায় এক হাজার, ফেল করার পর খাতা চ্যালেঞ্জ করে পাস করেছে প্রায় এক হাজার একশ’ জন। বাকিদের বিভিন্ন গ্রেডে ফল পরিবর্তন হয়েছে। এবারও সবচেয়ে বেশি ফল পরিবর্তন হয়েছে ঢাকা বোর্ডে। গত ৬ মে সকালে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল ঘোষণা করেন। এ বছর মোট অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২১ লাখ ২৭ হাজার ৮১৫ জন। উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৬৫ জন। ফেল করা পরীক্ষার্থীর সংখ্যা তিন লাখ ৭৮ হাজার ৬৫০ জন। ফল প্রকাশের পর থেকেই শুরু হয় পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন কার্যক্রম। সারাদেশে তিন লাখ ৬৯ হাজার খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন জমা পড়ে ১০ বোর্ডে। প্রতিটি খাতা বাবদ শিক্ষার্থীদের ফি দিতে হয়েছে ১২৫ টাকা। সেই হিসেবে পুনর্নিরীক্ষণের খাতা থেকেই বোর্ডগুলোর আয় হয়েছে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় শুধু ঢাকা শিক্ষা বোর্ডেই এক লাখ ৪০ হাজার ৯২৩টি খাতা পুনর্নিরীক্ষার আবেদন জমা পড়েছে। আবেদনকারীর সংখ্যা ৫৮ হাজার ৭০ জন। খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদনের পর শনিবার পৃথক পৃথকভাবে শিক্ষা বোর্ডগুলো নিজেদের ফল জানানো শুরু করেছে। যেখানে ফলের ব্যাপক পরিবর্তনের চিত্রই ধরা পরেছে। শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিসে আলাদা আলাদাভাবে টেলিফোনে যোগাযোগ করে ফল পরিবর্তনের তথ্য পাওয়া গেছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও স্ব স্ব বোর্ডে গিয়ে নিজেদের ফল জানতে পারছেন। কিন্তু কেন ফলে বিশাল এই সংখ্যা পরিবর্তন? এই প্রশ্নের উত্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সকলেই বলছেন, দ্রুত ফল প্রকাশের কারণে তারাহুড়াই এই অবস্থার কারণ। যথারীতি এবারও তিন ধরনের ভুল ধরা পড়ছে। এক. কিছু খাতায় নম্বরের যোগ ফল ঠিক ছিলনা। দুই. কিছু উত্তরের নম্বর যোগ করা হয়নি। আর তিন. ওএমআর ফরমে বৃত্ত ভরাটেও বেশ কিছু ভুল পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষাতেই নতুন করে ২৩৭ জন পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। আর ফেল থেকে পাস করেছে ১৪২ জন পরীক্ষার্থী। শনিবার এসএসসির পুনর্নিরীক্ষণের এই ফল প্রকাশ করেছে ঢাকা বোর্ড। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জ্যেষ্ঠ সিস্টেম এ্যানালিস্ট মঞ্জুরুল কবীর বলেছেন, মোট ৫৭ হাজার ৫৫৫ জন পরীক্ষার্থী পুনর্নিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছিল। তারা মোট এক লাখ ৩৯ হাজার ৩৩১টি উত্তরপত্র পুনর্পরীক্ষণের আবেদন করেছিল। তার মধ্যে ২ হাজার ৮৩ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। এই ফল ঢাকা বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। এখন যাদের ফল পরিবর্তন হয়েছে, আবারও একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির জন্য আবেদনের সুযোগ পাবে। এর জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ ও ৪ জুন।পুনর্নিরীক্ষণের ফল প্রকাশ করেছে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। বিষয়ভিত্তিক পুনর্নিরীক্ষণের জন্য ১৫ হাজার ৯৮৫টি আবেদন করেন আট হাজার ৪৮০ জন পরীক্ষার্থী। ১৩০ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। পাশাপাশি জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৪ পরীক্ষার্থী এবং ফেল থেকে পাস করেছেন ৪২ জন। বরিশাল বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আনোয়ারুল আজিম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে পরিবর্তন হয়েছে ৩৩৫ জন পরীক্ষার্থীর ফল। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১০৫ জন পরীক্ষার্থী। এছাড়া আগের ফল ফেল আসলেও আবেদনের পর এখন পাস করেএছ ৫৫ জন পরীক্ষার্র্থী। যশোর শিক্ষা বোর্ডের পুনর্নিরীক্ষণের ফলও প্রকাশ করা হয়েছে শনিবার। এখানে পরিবর্তন হয়েছে ১৩১ জন পরীক্ষার্থীর ফল। ফেল থেকে পাস করেছে ৪৪ জন এবং নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬ জন পরীক্ষার্থী। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের ফলেও এসেছে পরিবর্তন। এ বোর্ডে ৪৬৪ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। ফেল থেকে পাস করেছে ৮৯ জন এবং নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬৩ জন পরীক্ষার্থী। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের দাখিল পরীক্ষার খাতা পুনর্নিরীক্ষণে ১৭৬ জন শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ছায়েফ উল্ল্যা বলেছেন, ফেল করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাস করেছেন ৪৪ জন, জিপিএ-৫ পাওয়ার তালিকায় উঠেছেন নতুন করে ৩৮ পরীক্ষার্থী। দাখিলের ফল পুনর্নিরীক্ষণের জন্য এবছর ২৩ হাজার ৭৬৪ জন পরীক্ষার্থী আবেদন করেছিল। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, তাদের বোর্ডে মোট পরিবর্তন হয়েছে মোট ৪৯২ জন পরীক্ষার্থীর ফল। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪২ জন, ফেল থেকে পাস করেছে ৮০ জন, গ্রেড পরিবর্তন হয়েছে ৩৩৮ জন পরীক্ষার্থীর। আর আগেও ফেল ছিল আবেদনের পরেও ফেল এসেছে এমন পরীক্ষার্থী আছে ১৩ জন। প্রায় একই হারে পরিবর্তন এসেছে রাজশাহী, সিলেট ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ফলেও। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মু. জিয়াউল হক বলছিলেন, পরীক্ষকদের মধ্যে খাতা দেখার আগ্রহ ও পদ্ধতি দুটি পরিবর্তন হয়েছে। গত দুই বছর ধরে মডেল পদ্ধতিতে খাতা দেখা এবং পরীক্ষকদের খাতা প্রধান পরীক্ষকরা পুনরায় দেখার বাধ্যবাধকতা কারণে খাতায় ভুলের পরিমাণও কমেছে। তিনি বলেন, খাতায় যে ভুলের কারণে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতো এবার সেই জায়গা হাত দেয়া হয়েছে। আস্তে আস্তে খাতা দেখায় শৃঙ্খলা ফিরবে বলে মনে করেন তিনি। বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, পুনর্নিরীক্ষণে সাধারণত মোট ৪টি দিক দেখা হয়। এগুলো হলো উত্তরপত্রে সব প্রশ্নের সঠিকভাবে নম্বর দেয়া হয়েছে কি না, প্রাপ্ত নম্বর গণনা ঠিক রয়েছে কিনা, প্রাপ্ত নম্বর ওএমআর শিটে উঠানো হয়েছে কী না, এবং প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী ওএমআর শিটে বৃত্ত ভরাট ঠিক আছে কিনা। এসব বিষয় পরীক্ষা করেই পুনর্নিরীক্ষার ফল দেয়া হয়েছে। ফল পরিবর্তন নিয়ে অনেক সময় ক্ষুব্ধ ব্যক্তি ও অভিভাবকরা খাতা পুনর্মূল্যালায়নের আবেদন করেন। কখনও কখনও চলে যান আদালতে। কিন্তু লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর খাতা পুনর্মূল্যায়ন করতে গেলে পুরো ফল প্রকাশে কয়েক মাস লেগে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ ও বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও বর্তমানে সরকারী নাজিম উদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সৈয়দ সাদিক জাহিদুল ইসলাম বলছিলেন, আসলে পরীক্ষা ও ফল প্রকাশের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে সরকার একটি যুগান্তকারী কাজ করেছে। এর ফলে একটি দিনেই পরীক্ষা হচ্ছে প্রতিবছর, ফল প্রকাশ হচ্ছে লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে। এর ফলে শিক্ষায় শৃঙ্খলা এসেছে। এখন লাখ লাখ খাতা মূল্যায়ন করতে গিয়ে কখনও কখনও কিছু ভুল ধরা পড়ে। তবে সেই হারও ধীরে ধীরে কমে আসছে। তিনি আরও বলেন, অনলাইনে আবেদনের ভাল ব্যবস্থা থাকায় আবেদনের সংখ্যাও বাড়ছে। এখন কেউ কেউ মনে করেন খাতা নতুন করে দেখা বা পুনর্মূল্যায়ন করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু এটা আসলে সম্ভব নয়। এটা করতে গেলে পুরো ফল প্রকাশই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। মাসের পর মাস লেগে যেতে পারে ফল প্রকাশ করতে। তার পরেও যখন ফল প্রকাশ হবে দেখা যাবে তখনও অনেকে ফল নিয়ে আপত্তি করবেন।
×